আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।
ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ 'ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা'
৩০ জুন, সান্তাল হুলের দিবস। সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে অধিক পরিচিত। আজ থেকে ১৫৪ বছর আগে সাঁওতালরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। তারা এ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ইংরেজদের শাসন-শোষণ, সুদখোর, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।
ভারতে সান্তাল হুলের ১৫৫ তম বার্ষির্কী রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করা হয়েছে। এ বিদ্রোহের মহানায়ক চার ভাই সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরোকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বিভিন্ন বেসরকারী সংগঠন ও আদিবাসী নেতৃবৃন্দ ৩০ জুন থেকে শুরু করবে কয়েকদিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী।
'হুল' আদিবাসী সান্তাল ভাষার শব্দ। এর বাংলা আভিধানিক অর্থ হলো বিদ্রোহ বা সংগ্রাম বা যুদ্ধ। আজ থেকে ১৫৪ বছর পূর্বে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন তারিখে সান্তাল সমপ্রদায়ের চার ভাই সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরোর নেতৃত্বে আদিবাসীরা সর্বাত্বক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
সান্তাল হুলের ইতিহাস হতে জানা যায় দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ। বহু কষ্ট করে জঙ্গল কেটে বন সাফ করে তারা তাদের জনপদ গড়ে তুলেছিল। অতীতে যে মাটিতে কোন মানুষের পা পড়েনি, সে মাটিকে তারা বাসযোগ্য করে গড়ে তুলেছিল আর সে মাটিতে ফলিয়েছিল ধান, ভুট্টা, নানা ধরণের সব্জি আর সোনালী ফসল। সুখে ছিল তারা দামিন-ই কোহতে।
নিজেদের আলাদা একটি জগত তৈরী করেছিল তারা। সে জগতে কোন মহাজন, দালাল, জমিদার ছিলনা। কেউ ঋণী ছিলনা তখন। কিন্তু ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণী দলে দলে আসতে শুরু করল সাঁওতাল পরগনায়। মহাজন ও ব্যবসায়ী শ্রেণী সাঁওতাল পরগনায় ঢুকে বিপুল পরিমাণ ধান, সরিষা ও অন্যান্য তৈলবীজ গরুর গাড়ী বোঝাই করে নিয়ে যেত।
বিনিময়ে সাঁওতালদের দেওয়া হতো সামান্য লবণ, টাকা-পয়সা, তামাক অথবা কাপড়। এখানে বিনিময়ের সময় চরমভাবে ঠকানো হতো সাঁওতালদের। কিছু অর্থ, কিছু চাল বা অন্য কোন দ্রব্য ঋণ দিয়ে সমস্ত জীবণের জন্য সাঁওতালদের ভাগ্য বিধাতা ও দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে বসত মহাজনরা। ফসল কাটার মৌসুম এলে মহাজন শ্রেণী গরুর গাড়ী ও ঘোড়া নিয়ে সাঁওতাল পরগনায় আসত। বার্ষিক আদায়ে আসার সময় মহাজনরা একটি পাথরে সিদুর মাখিয়ে নিয়ে আসত এবং সাঁওতালদের বলত যে, এ পাথরের ওজন নির্ভূল।
এ পাথরের সাহায্যে ওজন করে মহাজনরা সাঁওতালদের সমস্ত ফসল তুলে নিয়ে যেত। কিন্তু তারপরও আদিবাসীদের ঋণের বোঝা সামান্য হ্রাস পেত না। মহাজনদের ঋণের সুদের হার ছিল অতি উচ্চ। একজন সাঁওতালকে তার ঋণের জন্য তার জমির ফসল, লাঙ্গলের বলদ এমনকি নিজেকেও বলি দিতে হতো তার পরিবারের কাছ থেকে। আর সেই ঋণের দশগুণ পরিশোধ করলেও পূর্বে যেরুপ ছিল পরেও সেইরুপ ঋণ অবশিষ্ট থাকত।
মহাজন, দালাল, জমিদার কর্ত্তৃক নিরীহ ও সরল আদিবাসীদের শোষণ ও নির্যাতনে পরোক্ষ মদদ দিতো বৃটিশ সৈন্য বাহিনী। এ কারণে আদিবাসীরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তা শেষ হয়। সাওতাঁলরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলেও ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিলো বন্দুক ও কামান। তারা ঘোড়া ও হাতি যুদ্ধে ব্যবহার করেছিল।
এ যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বৃটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরব পর্যায়ক্রমে নিহত হলে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় ও বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সাঁওতাল জাতির ইতিহাসে সিধো-কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল যুদ্ধই ছিলো সর্বাধিক বৃহত্তম এবং গৌরবের বিষয়। তাদের এই বিদ্রোহই ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ বপন করে গিয়েছিল।
এই যুদ্ধের ফলাফল হলো এই যে, ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করলেন। ম্যাজিট্রেট এডন সাহেব সাঁওতালদের আবেদন শুনলেন। যুদ্ধের পরে সাঁওতালদের সমস্যা বিবেচনা করে আদিবাসী সাঁওতালদের জন্য একটি জেলা বরাদ্দ করা হলো। এই জেলার নাম হলো ডুমকা। এটাই সাঁওতাল পরগনা নামে পরিচিত।
এখানে সাঁওতাল মানঝি্, পরানিক, পরগনা জেলার শাসন পরিচালনার জন্য দারোগা, পুলিশ ও বিভিন্ন সরকারী কমকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতা প্রাপ্ত হলো। সাঁওতালদের বিচার সালিশ তাদের আইনে করার জন্য সরকার ক্ষমতা প্রদান করলেন। খাজনা, কর প্রভৃতি তাদের হাতে অর্পণ করা হলো। তারা জেলা প্রশাসক বা ডিসির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকলো। ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল টেনান্সি এ্যাক্ট অনুযায়ী আদিবাসীরা তাদের জমি সরকারী অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারতো না।
এই আইন এখন পর্যন্ত কার্যকর আছে। ভারত সরকারও ঝাড়খন্ড নামে আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
সান্তাল হুলের মাধ্যমে ভারতের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ২৫ লক্ষাধিক আদিবাসী তাদের নাগরিক অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। আজ থেকে ১৫৪ বছর আগে যে কারণে সিদ-কানহুকে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হয়েছিল।
সেই একই কারণে আজো বাংলাদেশের আদিবাসীদের রাস্তায় নামতে হয় না সত্য। তবে কিছু কিছু ঘটনা সচেতন মহলকে ভাবিত করে। যার বাস্তব উদাহারণ হলো গত ১২ জুন নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলার ছাওড় ইউনিয়নের খাতিরপুর (সোনাডাঙ্গা) গ্রামে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় স্থানীয় ভূমি সন্ত্রাসী নূর হোসেন মাষ্টারের সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক আদিবাসী পল্লীতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতনের ঘটনা। নিজের জমিতে ঘর তোলার অপরাধে আদিবাসীদের ৭৩টি (১৮টি বাঙ্গালীসহ) বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। এ সময় আদিবাসীদের ঘরের ঢেউটিন ও অন্যান্য সম্পদ লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ ক্ষেত্রে পুলিশের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আদিবাসীদের উচ্ছেদের জন্য তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হলেও ঘটনার ১৫ দিনপরও আসামীদের গ্রেফতার না করে বরং আসামীর সাথে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বৈঠক করেছেন বলে আদিবাসিদের অভিযোগ।
বালাদেশের বর্তমান তদবিরবাজি সমাজ ব্যবস্থার সাথে খাপ খেয়ে চলতে না পারায় সকল ক্ষেত্রে আদিবাসীরা পিছিয়ে পড়ছে। আদিবাসীরা বিভিন্ন সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সচেতনতার অভাবে। ভাষাগত সমস্যার কারণে আদিবাসী শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হতে পারছে না।
হাসপাতালে আদিবাসীদের চিকিৎসা সহায়তা অপ্রতুল। এখনও আদিবাসীদের ভূমি ও কবরস্থান থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীদের ঋণের বোঝায় আদিবাসীরা সর্বশান্ত। তাদের জন্য সহজ ঋণ প্রাপ্তি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে কর্মহীন সময় তথা বৈশাখ-জৈষ্ঠ ও ভাদ্র-আশ্বিন মাসে আদিবাসী পল্লীতে সুদখোর ও দাদন ব্যসায়ীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়।
অনেকেই জীবিকা নির্বাহের তাগিদে পানির দামে আগাম শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। এ কারণে আদিবাসীদের অভাব কখনও দূর হয়না।
আদিবাসীরা সহজ সরল জাতি। তারা দিনে আনে দিনে খায়। ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়ে সময় ব্যয় করার সময় মোটেও তাদের নেই।
তাই সাস্তাল হুলের মর্মকথা আজও তারা জানে না। বাংলাদেশে ২০০৫ সাল থেকে উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে সান্তাল হুলের অনুষ্ঠান উদযাপন করা হচ্ছে। প্রতি বছর হুলের অনুষ্ঠানে আদিবাসীদের সমাগম ঘটে। সিদ-কানহুর সংগ্রামী জীবণ কাহিনী শুনে তারা ফিরে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না।
সাঁওতালরা লড়াকু জাতি। জীবণ সংগ্রামই তাদের চলার পথের পাথেয়। তাই আর থেমে থাকা নয়। সান্তাল হুলের ১৫৫ তম বার্ষিকী হতে শিক্ষা নিয়ে সিদ-কানহুর জীবণ আদর্শকে ধারণ করে জনগণের অধিকার আদায়ের পথে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে এবং জনগণের অধিকার নিশ্চিত করণের পাশাপাশি তাদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
তবেই বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যথায় নয়।
(সম্পাদিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।