ভারতবর্ষে সঠিক পন্থায় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন মুসলমান ইতিহাসবিদরা। প্রারম্ভিক স্তরে ৭১২-১১৯২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাসের ঘটনাবলি বহি:ভারতীয় আরব, পারসিক ও মাগরেবের ভূগোলবিদ ও ইতিহাসবিদদের রচনায় পাওয়া যায়। এ সময়কালে ভারু সম্পর্কিত বিবরণ যেসব মনীষী তাদের গুরুত্বপূর্ণ রচনায় লিপিবদ্ধ করেছেন তন্মধ্যে নবম শতাব্দীর আরব পর্যটক ও ভূগোলবিদ সুলায়মান তাজিরের ‘সিলসিলা আল তাওয়ারিখ’-এর কথা প্রথমেই বলে নেয়া যেতে পারে। সুলায়মান একজন আরবীয় বণিক যিনি ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে পারস্য উপসাগর হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ, পার্শ্ববর্তী দ্বীপাঞ্চল এবং চীনে গমনাগমন করেন। এসব ভ্রমণের মধ্যে একটির তারিখ ২৩৭ হি./ ৮৫১ খ্রি. বলা হয়েছে।
সিলসিলা আল তাওয়ারিখের প্রথম খণ্ডের বর্ণনাকারী হলেন সুলায়মান আল তাজির। অপর খণ্ডটির রচয়িতা সিরাফের আবু যায়েদ আল হাসান। এই গ্রন্থের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দ্বীপাঞ্চলের বৃহত্তর জনপদ, শাসক, অভিজাত শ্রেণীর সর্বোপরি সাধারণ জনগণের জীবনাচরণ তিনি বর্ণনা করেছেন। নবম ও দশম শতাব্দীতে ইবনে খুরদাদবিহ রচনা করেন ‘কিতাব আল মাসালিক ওয়া মামালিক’। তিনি আব্বাসীয় খলিফার অধীনে কর্মচারী ছিলেন।
তিনি তার এই গ্রন্থে ভারতবর্ষ সম্পর্কে নানা কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য প্রদান করেছেন। ইতিহাসবিদ আল মাসুদি রচিত গ্রন্থের নাম ‘শুরুজ আল জাহার’। তার এই গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত আকারে বিশ্ব ইতিহাসের ধারণা উপস্খাপিত হয়েছে। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের ভূখণ্ড এবং মানুষের জীবনাচরণ সম্পর্কিত তথ্যাবলি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উপস্খাপন করেছেন। তার গ্রন্থে সমকালীন ৩৩০-৩৩২ হিজরি ৯৪১-৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ এ প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দেশ ও জনগোষ্ঠীর অবস্খান ও পরিবেশের বিবরণ প্রদান করেছেন।
আল ইসতাখরির রচিত ‘কিতাব আল ইকলিম’ গ্রন্থটি ৩৪০ হিজরি/৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে রচিত। ভারু সম্পর্কিত রচনায় তিনি ভারতের প্রধান কয়েকটি শহর, জনগোষ্ঠী এবং নদনদী সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করেছেন। তন্মধ্যে সিìধুর প্রধান শহরের মধ্যে দেবল, মানসুরা, নিরুন, বাল্লারি, কাল্লারি, মানজাবারি, আলোর ইত্যাদি এবং হিন্দের শহরের মধ্যে কামবারা, আমহালা, সিন্দান, সুবারা, মুলতান, সাইমুর, বাসমান্দ, মানদুর প্রভৃতির উল্লেখ রয়েছে।
ইবনে হাওকাল তা ‘আশকালুল বিলাল’ গ্রন্থে সিìধু ও ভারত সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেছেন। তার এই গ্রন্থের সাথে ‘কিতাব আল মাসালিক ওয়া আল মাসালিক’ গ্রন্থের তত্ত্বগত ও ভাষাগত মিল বিদ্যমান।
ইবনে হায়কাল মানসুরা, বালহারা, সুলতান, দেবল প্রভৃতি নগর ও শহরের নাম উল্লেখ করেছেন এবং এসব স্খানে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। নবম ও দশম শতাব্দীর ইতিহাসবিদরা রচিত গ্রন্থের মধ্যে আল ইদ্রিসির ‘নুজহাত আল মুশতাক’ (পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণ আগ্রহীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ গ্রন্থে তিনি সিìধু ও ভারতীয়দের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি আল খুরদাবিহর অনুসরণে ভারতীয় হিন্দুদের সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন। আল ইদ্রিসি তার বর্ণনায় সিìধুর দেবল, নিরুন, মানসুরা আলোরসহ মুলতান, মাকরান, মানসুরা প্রভৃতি স্খানে নাম উল্লেখ করেছেন।
তার বর্ণনায় সিìধু ও হিন্দকে দু’টি আলাদা দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তার বর্ণনার মাধ্যমে আমরা ভারতীয় জনগোষ্ঠীর তৎকালীন জীবনধারা সম্পর্কে অনেকটা ওয়াকিবহাল হতে পারি। নবম-একাদশ শতকের এসব ইতিহাসবিদের বর্ণনার মাধ্যমে ভারতের সিìধু অঞ্চল, উত্তর ভারতের প্রসিদ্ধ স্খান, পূর্ব ভারতের স্খানগুলো, সিìধু ও ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, হিন্দু জনগোষ্ঠীর জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণবিন্যাস, বিভিন্ন স্খানের ভৌগোলিক অবস্খান, আবহাওয়া, কৃষিদ্রব্য, ফল-ফলাদি ভাষা, রাজ্য শাসকসহ নানা ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক তথ্য উপস্খাপিত হয়েছে। এসব ছাড়াও প্রাচীন ভারতের বিশেষত সিìধুর ইতিহাস, ঐতিহ্য, উপাখ্যানের বিবরণ সংবলিত ‘মুজমাল আল তাওয়ারিখ’ গ্রন্থের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। কাশ্মিরের ইতিহাসের ওপর রচিত কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ এবং মহাভারতে বর্ণিত অনেক ঘটনার অবিকল বিবরণ ‘মুজমাল আল তাওয়ারিখে’ দৃষ্ট হয়।
গ্রন্থকার ৫২০ হিজরি/১১২৬ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থ রচনা করতে শুরু করেন এবং ৫৯৮ হিজরি/১১৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইতিহাস এতে সংযোজন করেছেন।
মুসলিম ইতিহাসবিদদের মধ্যে আহমদ বিন ইয়াহিয়া বিন জাবির আল বালাজুরি নামটি বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। তার রচিত ‘ফুতুহ আল বুলদান’ এবং ‘আনসার আল আশরাফ’ গ্রন্থদ্বয়ে মুসলিম উম্মাহ বা জাতির ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। এ ছাড়া এই গ্রন্থদ্বয়ে সিìধু বিজয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি উপস্খাপন করা হয়েছে। বালাজুরি যদিও ভারতীয় উপমহাদেশ সফর করেননি তবুও তিনি আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের সন্তানদের গৃহশিক্ষক হওয়ার সুবাদে সরকারি দফতর হতে তথ্য গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন।
চাচানামা সিìধু অঞ্চলের ওপর রচিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে রাজা দাহিরের পিতা, চাচার সিংহাসন লাভ এবং আরবদের সিìধু বিজয়ের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। পরবর্তীকালে নুরুল হক তার যোবদাত-উত-তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে এবং নিজাম উদ্দিন আহমদ বখশী তার ‘তাবাকাত-ই-আকবরী’ গ্রন্থে এই গ্রন্থ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। চাচনামার মূল আরবি গ্রন্থ থেকে মুহাম্মদ বিন আলী বিন হামিদ বিন আবু বকর কুফি কর্তৃক ১১২৬ খ্রিষ্টাব্দে এটি ফারসিতে অনূদিত হয়।
আবু রায়হান আল বিরুনি ৩৬০ হিজরী/৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি একাধারে একজন জ্যোতির্বিদ, জ্যামিতি শাস্ত্রজ্ঞ, ঐতিহাসিক এবং তর্কশাস্ত্রবিদ ছিলেন। তার রচিত প্রথম গ্রন্থ হলো ‘আসারুল বাকিয়া আল কুরুন আল খালিয়া’। এই গ্রন্থে তিনি প্রাচীন জাতি ও জনগোষ্ঠীর সময় ও বর্ষপঞ্জি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তবে তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব আল হিন্দ’। এই গ্রন্থে তিনি খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকের ভারতীয়দের সাহিত্য, ধর্ম, বিজ্ঞান সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
এই গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি গজনির সুলতান মাহমুদের সাথে ভারতে এসে প্রায় ৪০ বছর এখানে অবস্খান করে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ভারতীয়দের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছেন। আজো গ্রন্থটি ভারতীয় ইতিহাস চর্চার আকড় গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আবু নসর আল উতবি ছিলেন গজনির সুলতান মাহমুদের সচিব। তার রচিত প্রধান ইতিহাস গ্রন্থের নাম তারিখে ইয়ামেনি বা কিতাব আল ইয়ামেনি। এই গ্রন্থে নাসির উদ্দিন সুবক্তগিনের পূর্ণ রাজত্বকাল এবং সুলতান মাহমুদের শাসনকালের কিয়দাংশ ৪১০ হিজরি/১০২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
আল উতবির এই গ্রন্থ গজনি সুলতানদ্বয়ের (আমির সুবক্তগিন ও সুলতান মাহমুদ) ভারত অভিযান ও গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আকড় গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আবুল ফজল আল বায়হাকি রচিত গ্রন্থের শিরোনাম ‘তারিখ-ই-আল সবুক্তগিন’। এটি তারিখ-ই-বায়হাকি নামেও সুপরিচিত। গজনি রাজবংশের ইতিহাস অবগত হওয়ার জন্য এটি একটি আকড় গ্রন্থ। দিল্লির সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি, সম্রাট আকবরের পরিষদ ও ঐতিহাসিক আবুল ফজল এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর তাদের ইতিহাস গ্রন্থে এই গ্রন্থ থেকে গজনি রাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।
এই গ্রন্থটি সুবিশাল এবং তা ৩০ খণ্ডে সমাপ্ত। এভাবে পদ্ধতিগতভাবে ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাস রচনায় প্রাথমিক যুগীয় পারসিক-আরব ভূগোলবিদ এবং ঐতিহাসিকদের অবদান স্বাভাবিকভাবেই অনস্বীকার্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।