"A little knowledge of science makes man an atheist, but an in-depth study of science makes him a believer in God." Francis Bacon.
আসলে আমাদের প্রাচীন ভারতীয় অশুদ্ধ পৌরহিত্য যেমনই উৎকট, আসামাজিক ও অশ্লীল হোক না কেন তার বিরূদ্ধে টুঁ শব্দ করার উপায় ছিল না হয়তো । রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন - " শারদীয় দুর্গাপূজায় বিজয়া দশমীর দিন শাবরোৎসব নামে এক প্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হইত । শবর জাতির ন্যায় কেবলমাত্র বৃক্ষপত্র পরিধান করিয়া এবং সারা গায়ে কাদা মাখিয়া ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে লোকেরা অশ্লীল গান গাহিত এবং তদনুরূপ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করিত । জীমূতবাহন 'কাল-বিবেক গ্রন্হে' যে ভাষায় এই নৃত্যগীতের বর্ণনা করিয়াছেন বর্তমান কালের রুচি অনুসারে তাহার উল্লেখ বা ইঙ্গিত করাও অসম্ভব । অথচ তিনি-ই লিখিয়াছেন, যে ইহা না করিবে ভগবতী ক্রদ্ধ হইয়া তাহাকে নিদারূণ শাপ দিবেন ।
বৃহদ্ধর্মপুরাণে কতিপয় অশ্লীল শব্দ সম্ধন্ধে উক্ত হ্ইয়াছে যে ইহা অপরের সম্মুখে উচ্চারণ করা কর্তব্য নহে, কিন্তু আশ্বিন মাসে মহাপূজার দিনে ইহা উচ্চারণ করিবে- তবে মাতা, ভগিনী এবং শক্তিমন্ত্রে অদীক্ষিতা শিষ্যার সম্মুখে নহে । ইহার সপক্ষে এই পুরাণে যে যুক্তি দেওয়া হইয়াছে, শ্লীলতা বজায় রাখিয়া তাহার উল্লেখ করা যায় না । " [রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৮৯ পৃষ্ঠা]
শ্রী মজুমদার আরো লেখেন - "সে যুগের স্মার্ত পন্ডিতগণ প্রামাণিক গ্রন্হে অকুন্ঠিত চিত্তে লিখিয়াছেন শুদ্রাকে বিবাহ করা অসঙ্গত কিন্তু তাহার সহিত অবৈধ সহবাস করা তাদৃশ নিন্দনীয় নয় । " [পৃষ্ঠা-১৯৩]
তিনি আরো লিখেছেন, "কঠোর জাতিভেদ প্রথা তখন ব্রাক্ষণ ও অন্যান্য জাতির মধ্যে একটি সুদৃঢ় ব্যবধানের সৃষ্টি করিয়াছিল । " [ঐ পৃষ্ঠা-২৩৮]
নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়া নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ভ্রান্তি ।
ভারতের মুসলিম অন্চলগুলোর মধ্যে কেরালায় আজ এত মুসলমান কেন ? সেখানে অস্ত্র দিয়ে বলপূর্বক ধর্মান্তর ঘটানো হয়েছে - এটা যে নিছক বাজে কথা তা আগের আলোচনায় দেখানো হয়েছে । তবুও কেরালা ও রাজস্হানের সামাজিক আলেখ্য আরো দু একটি নিয়ে আসছি ।
"কেরালার নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের অমানুষিক ব্যবহার অকল্পনীয় । রাজস্হানে এই বর্ণভেদ প্রথা যে বাংলার চাইতে কত সহস্র গুণ ভয়াবহ তা আমার স্বচক্ষে দেখা- সাধারণত নিম্নবর্ণের লোকদের বর্ণ অনুসারে পৃথক পৃথক পোশাক ও গহনা আছে এবং নিম্নবর্ণ লোকের পক্ষে এমন সাজ পোশাক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ যা উচ্চবর্ণের লোকের উপযুক্ত সাজপোশাক - ১৯৭৪ এর ডিসেম্বরে লক্ষ্য করেছি যে, শহরান্চলে কিংবা যোধপুর জেলার অর্ন্তগত বোরুন্দার মতো গ্রামে এসব বিধি বিচার শিথিল হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ১৯৬৫তে ঐসব নিয়ম অনেক কঠোর দেখেছিলাম । ১৯৭২-এর ২৭ নভেঃ আনন্দবাজার পত্রিকাতে ব্রাক্ষণদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উত্তর প্রদেশের এক হাজার হরিজনের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের খবর প্রকাশিত হয় , এর কিছুদিন পরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উত্তর প্রদেশের বান্দাতে ধনবান ব্রাক্ষণদের সশস্ত্র আক্রমণে গ্রামসুদ্ধ হরিজনরা ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরে এসে জেলা সমাহর্তার কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে - সেই সময় দিল্লি যাওয়ার পথে এলাহাবাদ থেকে যাত্রীদের মুখে শুনি ।
রাঁচি-চক্রধরপুর রোডে অবস্হিত বাগধাঁওয়ের মিশনারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইকেল ভোদ্রা আমায় বলেছিলেন, তাঁর বাবা একবার উচ্চবর্ণের লোকদের মতো করে হাটুর নিচে ধুতি পরেছিলেন এবং তাঁর ঐ স্পর্ধার জন্য তাঁকে জমিদার বাড়িতে ডেকে প্রচন্ড প্রহার করা হয় এবং তারপরে তিনি খ্রিষ্টান হয়ে যান । " [পৃষ্ঠা-৯৪-৯৫]
এসব অত্যাচারিত , উপেক্ষিত ও লান্হিত মানুষেরা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন তখন তাঁদের আচার-ব্যবহার পোশাক পরিচ্ছদ এবং নাম পর্যন্ত পাল্টে যেত অর্থাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত ।
"আগেই বলা হয়েছে যে, নিম্নবর্ণের লোকদের ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হতো । এককালে কেরালাতে অমুকের স্ত্রী বা মেয়ে ইসলাম নিয়েছে বলার দরকারই হতো না, তার বদলে শুধু 'কুপপায়ামিডুক' শব্দটি ব্যবহার করা হতো - যার অর্থ হলো 'গায়ে জামা চড়িয়েছে ' । অপমানসূচক বা হীনতাদ্যোতক এ রকম বহু আচার প্রথা ইসলামের প্রভাবে কেরালায় সমাজ থেকে দূরীভূত হয় ।
নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহনের ফলে দাস প্রথাও বহূল পরিমানে নিয়ন্ত্রিত হয় । " [দ্রঃ এ পুস্তকের ১৩০,১৩১ পৃষ্ঠা]
'কুলীন' ব্রাক্ষণ নামে যে গোষ্ঠী সেন আমল হতে শক্তিশালী হয়েছিল তাদের আচার-ব্যবহার জানা থাকলে এ যুগের মানুষের অবাক হওয়ার অবকাশ আছে ।
মূল্যবান উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় - "কুলীন ব্রাক্ষণ হিসাবও রাখতেন না তাঁরা ক'টি মেয়েকে বিবাহ করছেন । তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য একটি ছোট খাতায় বিয়ের ও বিয়ের পাওয়া যৌতুকের তালিকা লিখে নিজেদের কাছে রেখে দিতেন । পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্বশুরালয়ে গেলে শ্বশুররা তাদের কি কি জিনিস দিতেন তারও একটা তালিকা রাখতেন ।
" [অধ্যাপক শ্রীবিনয় ঘোষের 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১২০ পৃষ্ঠা , ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা]
ঐতিহাসিক অধ্যাপক শ্রীবিনয় ঘোষ লিখেছেন - "কুলীন জামাতারা যখনই শ্বশুরালয়ে যান তখনই তাদের সম্মানার্থে শ্বশুরকে কিছু অর্থ বা কোন উপহার দিতে হয় । এই প্রথার ফলে বিবাহ বেশ লাভজনক পেশা হয়ে উঠেছে ।
একটি ব্রাক্ষণের যদি ত্রিশটি স্ত্রী থাকে তবে প্রতি মাসে কয়েক দিনের জন্য শ্বশুরালয়ে গিয়ে থাকলেই ভালো খেয়ে ও উপহার পেয়ে এবং জীবিকা অর্জনের কোন চেষ্টা না করে তার সারা বছর কেটে যেতে পারে । বহুবিবাহ প্রথার ফলে কুলীন ব্রাক্ষণেরা এক নিষ্কর্মা, পরাভৃত শ্রেনী হয়ে উঠেছে এবং বিবাহের মতো একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে নীতিহীনতার উৎস করে তুলেছে । "
শ্রী-ঘোষ আরো লিখেছেন, "অতএব কুলীন ব্রাক্ষণের জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন বহুবিবাহ করা ।
কুলীনরা বৃদ্ধ বয়সেও বিবাহ করে । অনেক সময় স্ত্রীদের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎই হয় না বা অথবা বড়জোর ৩/৪ বছর পরে একবারের জন্য দেখা হয় । এমন কথা শোনা যায় যে একজন কুলীন ব্রাক্ষণ একদিনে ৩/৪ টি বিবাহ করেছেন । কোন কোন সময় একজনের সব কয়টি কন্যার ও অবিবাহিতা ভগিণীদের একই ব্যাক্তির সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয় । কুলীন কন্যাদের জন্য পাত্র পাওয়ার খুব অসুবিধা থাকায় বহু কুলীন কন্যাকে অবিবাহিত থাকতে হতো ।
কুলীনদের বহু বিবাহের ফলে - ব্যভিচার, গর্ভপাত, শিশুহত্যা ও বেশ্যাবৃত্তির মতো জঘন্য সব অপরাধ সংঘটিত হয় । ৮০,৭২,৬৫,৬০ ও ৪২টি করে স্ত্রী আছে এমন ব্যাক্তিদের কথা জানা গেছে তাদের ১৮,৩২,৪১,২৫ ও ৩২ টি পুত্র সন্তান ও ২৬,২৭,২৫,১৫,১৬ টি কন্যা সন্তান আছে । বর্ধমান ও হুগলী জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এক এক ব্যাক্তির এতগুলো করে স্ত্রীর অস্তিত্ব জানা গেছে । " [ এই উদ্ধৃতি গুলো 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর' পুস্তকের ১১৬ এবং ১১৭ পাতা থেকে নেওয়া হয়েছে ]
কেউ যেন মনে না করেন এসব কাহিনী শুধু আদিম যুগের , বরং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই এসব ঘটনা ঘটেছিল বলে ১৮৬৭ সালে দেশের লেফটেন্যান্ট গভর্ণরকে দরখাস্ত করা হয় যাতে আইন করে বহুবিবাহ তুলে দেওয়া যায় । সেই দরখাস্তে ঐ রকম সব তথ্যের প্রমান ছিল সেই সঙ্গে একথাও লেখা ছিল যে এইসব রীতি নীতি হিন্দুধর্মে লেখা নাই বরং এগুলো মনগড়া আইন ।
[চলবে]
সূত্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা , মদীনা পাবলিকেশন্স ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।