আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারতবর্ষে মুসলমানদের চেপে রাখা ইতিহাস !! - ৭ (ভারত বর্ষে ইসলামের আগমণ)

"A little knowledge of science makes man an atheist, but an in-depth study of science makes him a believer in God." Francis Bacon.

ভারতবর্ষে মুসলিম আগমণের ইতিহাসে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা সাধারণত এই শিক্ষাই পায় যে, ভারতে মুসলমানদের আগমণ ঘটেছে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময় । এই সঙ্গে আরও ধারণা-মুসলমানগণ বিদেশী, লুন্ঠনকারী এবং অত্যাচারী । তারা বিনা কারণে বা প্ররোচনায় ভারত আক্রমণ করেছেন আর জোর করে ভারতের অমুসলমানদের মুসলমান করেছেন । যারা এসব তথ্য পরিবেশন করেন তাদেরও পুরোপুরি দোষ দেয়া যায় না । যেহেতু ভারতের মূল ইতিহাস উদ্ধার করতে গেলে মুসলমান ঐতিহাসিক ও পর্যটকদের বাদ দিয়ে ইতিহাসকে বাচিয়ে রাখা যাবে না ।

ইংরেজসৃষ্ট বিকৃত ইংরেজি ইতিহাসের অনুবাদ আর ভাবানুবাদ ভাঙিয়ে চলতে হয় বেশিরভাগ ভারতীয় ঐতিহাসিকদের । হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সময়ে খালেদ ইবনে অলিদ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । তিনি ইসরাঈল, আফগান ও নিজের গোত্রের লোকদের পত্র দিয়ে সমস্ত ধর্মগ্রন্হ এর প্রতিশ্রুত পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বাণী ও কুরআনের কথা জানান - 'আমি নিজে এই ধর্মে দীক্ষিত হয়েছি আপনারাও সুনিশ্চিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন আশা করছি । স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টির কাছে নতি স্বীকার করাকে ইসলাম ধর্ম নিষেধ করেছে । সংশোধিত, সভ্য, চরিত্রবান ও উন্নত হয়ে স্বর্গের অধিকারী হওয়ার পূর্ণ পদ্ধতি লাভ করে আমরা উপকৃত হয়েছি ।

তাই আপনাদেরও কল্যাণ কামনায় এই পত্র প্রেরণ ... । ' [তারিখে জাঁহাকুশ ও মাজমাউল আনসার ] উপরোক্ত মর্মের পত্র পেয়ে আফগানিস্তান হতে 'কয়স' নামে একজন প্রভাবশালী নেতা একদল লোকসহ মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । অনেক আলোচনার পর তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । হযরত 'কয়স' নাম পরিবর্তন করে ইসলামী নাম 'আব্দুর রশিদ' রাখলেন । আব্দুর রশিদ সঙ্গে একজন ইসলাম জানা আরবী সাহাবী তাদের সঙ্গে আফগানিস্তান যান এবং সেখানে বহু আফগানিকে ইসলাম ধর্ম পরিবেশন করেন ।

আর তখন এই আফগানিস্তানের সঙ্গেই আমাদের ভারতবর্ষ সংযুক্ত বা অবিভক্ত ছিল । ভারতের মাদ্রাজ বা তামিলনাড়ু প্রদেশের জেলার নাম মালাবার বা মালবার । এই মালবার আরবদের জন্য একটি বিশেষ ব্যবসাকেন্দ্রিক ঘাটি ছিল । মাদ্রাজের এক বন্দরের উপর দিয়ে আরবরা ব্যবাসা-বাণিজ্যের জন্য চীন যাতায়াত করতেন । অবশ্য সারা পৃথিবীতে ইসলাম পৈাছে দেবার দায়িত্ববোধও তাদের ছিল ।

মালবার স্হানটিকে আরবরা -'মা''বারা' বলতেন, আরবীতে এর অর্থ পারঘাট । আরব বণিক, মুবাল্লিগ ও নাবিকেরা এই ঘাটের ওপর দিয়ে মাদ্রাজ, মক্কা, হেযায, মিসর ও চীনের মধ্যে যাতায়াত করতেন । বলাবাহূল্য, মা'বার নাম তাদের-ই রাখা । 'পরাবৃত্ত' পড়ে জানা যায় যে, ভারতের 'চেবর রাজ্যে শেষ রাজা চেরুমান পেরুমল ইচ্ছা করে সিংহাসন ত্যাগ করে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ অভিলাষে মক্কানগরীতে গমন করেন । [দ্রঃ বিশ্ব কোষ ১৪ / ১৩৪ পৃঃ] এছাড়াও একজন মুসলিম লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় - " একজন হিন্দু রাজার মক্কা গমন এবং তার মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিকট উপস্হিত হয়ে স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়ে রাজা কিছুকাল হযরতের নিকট অবস্হান করে প্রত্যাবর্তনের সময় 'শহর' নামক স্হানে পরলোক গমন করেন ।

" [দ্রঃ তুহফাতুল মুজাহেদিন ] অতএব 'তরবারির জোরে ইসলাম প্রচারিত' কথাটুকু ভারতের ঐ রাজার মুসলমান হওয়ার ব্যাপারে যে মোটেই খাপ খাওয়ানো যায় না তা প্রমাণিত সত্য । বর্তমান বঙ্গের বিখ্যাত ঐতিহাসিক, ভারত পর্যটক লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো পরিস্কার করে প্রমাণ করা যাবে আমাদের তথ্যের যথার্থতা । "মালাবার রাজাদের মধ্যে চেরুমান পেরুমল-ই প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । তিনি ছিলেন পেরুমল বংশীয় শেষ রাজা । ....শুধু নিজে ধর্মান্তরিত হয়েই চেরুমান পেরুমল ক্ষান্ত হন নি , প্রজাদের মধ্যেও ইসলাম ধর্ম প্রচারে তিনি সচেষ্ট হন ।

....তবে যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন একজন দক্ষিণ ভারতীয় রাজা অন্তরের আকর্ষণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং তার প্রচারের জন্য বিদেশ গিয়ে চেষ্টা করেছেন, এই ব্যাপারটা অশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । বহু পুরুষবাহিত ধর্ম ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় উদ্দীপ্ত চিত্তে শাসকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেণ এ রকম নজির ভারতবর্ষের অন্যত্র বিরল । " [সুরজিৎ দাশদগুপ্তের লেখা - ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ১২৪-১২৫] মাদ্রাজের মালবারের মুসলিমদের 'মোপলা' বলা হয় । মোপলা সম্বন্ধে বিশ্বকোষ সম্পাদক মহাশয়ের লেখা উদ্ধিতি দিচ্ছি- "ইহারা অধ্যবসায়শীল, কর্মক্ষম এবং বর্ধিষ্ঞু । ইহারা আবার সুগঠিত ও বলিষ্ঠ ....ইহারা দেখিতে সুশ্রী....ইহাদের ন্যায় পরিশ্রমী দ্বিতীয় জাতি ভারতবর্ষে আর কোথাও দৃষ্ট হয় না ।

.....সাহসিকতায় ইহার চিরপ্রসিদ্ধ ....আরবীয় ধর্ম মতে দীক্ষাদানই ইহাদের প্রধান কাজ । ইহারা শ্রশ্রুধারণ করে । কেশ কর্তন করে । সকলেই মস্তকে টুপি দেয় .....ইহারা স্বভাবত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন । " মালবারের প্রাচীন নাম চেরর বা কেরল ।

ওখানে সেই যুগে দশটি স্হানে মসজিদ তৈরী করা হয়েছিল - (১) কোরঙ্গন্নর, (২) কুইলন , (৩) হিলি ধাওয়ায় পর্বত, (৪) পাকনূর, (৫) মঙ্গলোর নগর, (৬) ধর্ম পত্তন বা দরফতন নগর , (৭) চালিয়ান নগর , (৮) কুন্ড পুরম, (৯) পন্হারিনী ও (১০) কন্জর কোর্টে । বিশ্বকোষ প্রণেতা লিখেছেন, "মসজিদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই যে এতুদ্দেশে মুসলমান প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছির, তাহাতে সন্দেহ নাই । এই সকল মসজিদের ব্যয়ভার বহনের জন্য অনেক সম্পত্তিও প্রদত্ত হইয়াছিল । ....ঐ সময় উপকূলবাসী মুসলমান এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত দেশীয় অধিবাসীদিগের সংখ্যায় পরিবৃদ্ধি হইয়াছিল । ক্রমে তাহারা রাজ্যের মধ্যে প্রভাব সম্পন্ন হইয়া উঠে ।

" [দ্রঃ বিশ্বকোষ ১৪ / পৃঃ ৬১৮ এবং তোহফাতুল মোজাহেদিন পৃঃ ২৩ ও ২৪ ] হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পরলোগমনের কয়েক বছর পর হতেই ভারতে ইসলাম ধর্মের আগমণ ঘটে । 'মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর আশি বছর যেতে না যেতেই মুহাম্মদ বিন কাসিমের পূর্বেই অনেক ইসলাম ধর্মবলম্বীর আমগন যে ঘটেছে তার প্রমাণে বলা যায় ইসলামে দ্বিতীয় খলিফা উমর (রাঃ) এর সময়ে ওসমান নামে এক বিজ্ঞবীরকে আম্মান ও বাহরাইনের গভর্ণর নিযুক্ত করা হয় । ওসমান নিজের ভাইকে বাহরাইনে নিজের পদে বহাল রেখে আম্মান হতে একটি সৈন্যবাহিনী ভারত সীমান্তে পাঠান । ওখান হতে অভিযান সমাপ্ত করে তার ভাই মুগীরাকে ভারতের করাচীতে পাঠান । বিপুল বাধার সম্মুখীন হয়েও মুগীরা জয়ী হয়েছিলেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ।

' চতুর্থ খলীফা হজরত আলী (রাঃ) এর অনুমতিতে 'হারিস' সিন্ধু অভিযান করেন । ভারতীয়দের পক্ষ থেকে তীব্র বাধা পেতে হয় । তুমুল যুদ্ধের পর আরবীয়গণ জয়লাভ করেন এবং বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সৈন্যদের বন্দি করেন । তারপর ৪৪ হিজরীতে আমীর মুয়াবিয়ার শাসনকালে মোহল্লাব ভারত সীমান্তে অভিযান চালান । মোহাল্লাবের মৃত্যুর পর মোয়াবিয়া আবদুল্লা ইবনে সওয়ারকে ভারতের দিকে পাঠালেন ।

তারপর ভারত আসেন রাশেদ । অবশেষে ময়দদেবল নামক স্হানে তুমুল যুদ্ধ হয় , তাতে তিনি নিহত হন । ঐ সংবাদ পেয়েই 'সেনান' এসে আবার বিজয়ীদের আহ্বান জানান । পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয় । এবার সেনান জয়লাভ করেন এবং সেখানে শাসনকার্য সম্পাদন করেন ।

সূত্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা, মদীনা পাবলিকেশন্স ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.