গোলজার হোসেন
প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ) অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। বিক্রমপুর ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। আর সে সময় যে কজন শক্তিশালী সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাদের মধ্যে বাবা আদম (রহ.) ছিলেন অন্যতম শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ওলি। বঙ্গ-ভারতে মধ্যযুগে যে কজন সুফি দরবেশ ইসলাম প্রচারের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বাবা আদম তাদের মধ্যে অন্যতম। বাবা আদম শহীদ (রহ.) ১১৪২ খিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান।
প্রাচীন ভারতবর্ষের ইসলামের আবির্ভাব এবং হজরত বাবা আদম শহীদ (রহ.) গ্রন্থের লেখক মুজিবর রহমান মাখন উল্লেখ করেছেন, মুর্শিদের আদেশে প্রাচীন ভারতবর্ষে আসন ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে।
বঙ্গে বাবা আদম নামে তিনজন আউলিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এদের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার বাবা আদাম কাশ্মিরী, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার বাহেরা গ্রামে আদমপীর। আর বাবা আদম শহীদ (রহ.) ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তিত্ব। তিনি জন্মগ্রহণ করেন পবিত্র আরব দেশের তায়েফ নগরীতে।
তিনি কত সালে জন্মগ্রহণ করেন এ ব্যাপারে লেখক কিছু জানাতে পারেনি। তবে ১০৯৯ সালে জেরুজালেম ক্রসডে তার বাবা শহীদ হন এবং পক্ষকাল পরে বাবা আদম জন্মগ্রহণ করেন। খোরসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বাবা আদম (রহ.) উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর বাবা আদম (রহ.) আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বাগদাদে হজরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর সাহচর্যে আসেন এবং তাসাউফের শেষ স্তর অতিক্রম করেন।
বাবা আদম (রহ.) প্রথমে মহাস্থানগড়ে খানকায়ে কাদেরিয়া স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
তার সফরসঙ্গী ১২ জন আউলিয়ার অধীনে ১২টি মিশন গঠন করে এলাকায় পানির অভাব দূর করতে পুকুর খনন, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১২ জন ওলি বাবা আদমের নেতৃত্বে ইসলাম প্রচারে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। বিক্রমপুর, মহাস্থানগড়, চট্টগ্রাম, নাঙ্গলকোট, বাঙ্গাল, দেবকোট, ইন্দ্রপস্ত, প্রয়াগ, পাটুলীপুত্র, নাগপুর, দাক্ষিণাত্য বর্তমানে পু-বর্ধন এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। ১২ জন ওলির মধ্যে ৫ জনের মাজার মুন্সীগঞ্জে অবস্থিত। তাঁরা হলেন : ১. শেখ মখদুম আলমুয়াসসিস (রহ.) মাজার দরগাহ বাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, ২. আযৃযায়িরা বিন সাঈদ (রহ.), ধীপুর, মুন্সীগঞ্জ, ৩. খুবরাত ইবনে মুদাককিক (রহ.) মাজার মুন্সীগঞ্জ, ৪. ইমামুদ্দীন বাগদাদী (রহ.) মাজার মুন্সীগঞ্জ, ৫. মুষাব্রীয়ান আলবসরী (রহ.) মুন্সীগঞ্জ। এছাড়াও বাবা আদম (রহ.)-এর কয়েকজন বিখ্যাত খলিফা বিক্রমপুরে (মুন্সীগঞ্জ) কয়েকটি মিশন পরিচালনা করতেন।
এদের মধ্য কেওয়ার ও রাম গোপালপুর ১১৫২-তে ইসলাম প্রচার করেন। তাদের নামের মাজার শনাক্ত করা যায়নি।
ইসলাম প্রচারের সময় রাজা বল্লাল সেনের রাজকর্মচারীদের সঙ্গে সুফি শেখ মখদুম আল মুয়াসসিসের বিরোধ বাধে। রাজা বল্লালসেন তাকে টঙ্গীবাড়ী ধীপুর থেকে কারারুদ্ধ করেন। এ খবর শুনে রাজা আদম (রহ.) মহাস্থানগড় থেকে বিক্রিমপুর আসেন।
কারাগারে শেখ মুখদুমকে দেখে বল্লাল সেনের ভাগ্নে অজয় সেনের একমাত্র কন্যা মাধরী সেন ইসলাম গ্রহণ করেন শুনে রাজা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১১৭৪ সালে বিক্রমপুরের কালাইচং ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সে ধর্মযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বাবা আদম শহীদ (রহ.)। এভাবে কয়েকবার সম্মুখ ও নৌ-য্দ্ধুও হয়েছিল বাবা আদমের (রহ.) সঙ্গে বল্লাল সেনের। কথিত আছে, ১০ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে মুন্সীগঞ্জে কানাইচং ময়দানে ১০ দিনব্যাপী প্রচ- যুদ্ধে বহু সংখ্যক সৈন্য ও মুজাহিদ নিহত হন।
এ যুদ্ধে বল্লাল সেনের সৈন্য ছিল ২০ হাজার, অপরদিকে মুজাহিদ ও সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। যুদ্ধে পরাজয়ের আশংকায় বল্লাল সেন ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করলে বাবা আদম সরল বিশ্বাসে মেনে নেন। সেদিন রাতে ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা। বিক্রমপুরের দরগাহ বাড়িতে এশার নামাজের পর বাবা আদম (রহ.) মোরাকাবা থাকা অবস্থায় বল্লাল সেন তার তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করে। বাবা আদম (রহ.) শহীদ হওয়ার পর রিকাবী বাজার দীঘিরপাড় সড়কের পাশে দাফন করা হয়।
১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরের শাসক মহান মালিক কাফুরশাহ বাবা আদমের খানকার ওপর একটি চমৎকার মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটির ৬ গম্বুজ পুরাকালের আত্মত্যাগী বাবা আদমের কথা মনে করিয়ে দেয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।