.......অতঃপর মৃত্যুর প্রতীক্ষা
মেকাপযুক্ত মেকি ফর্সার দাপটে ফর্সা শিল্পী আর নেই। অথবা যারা অভিনয়ে পারদর্শী তারা পর্দার সামনে দাড়ানোর মত যথেষ্ট ফর্সা নন বলে, মাঝারি থেকে ভারি চুনকামের প্রয়োজন পড়ে। মুখের সাথে নায়িকার হাতের রঙের তুলনা করলেই এ বীভৎসতা চোখে পড়বে। অন্তত লাভ-ক্ষতির বুদ্ধিসম্পন্ন পরিচালক শ্যাম বর্ণের নায়িকা এনে দর্শকদের হতাশ/বিমুখ করতে চাননা। যারা নিচুজাত বা কাজের লোকের চরিত্রে অভিনয় করেন, তাদেরকে স্ববর্ণে দেখা যেতে পারে।
অথবা পরবর্তীকালে ভাল চরিত্র দেয়া হবে, এ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে কাজের মেয়ের অভিনয় করেন। এটা হয়ত হীনমন্যতার জন্ম দেয়। "আমি এতটা কুশ্রী যে আমাকে দিয়ে কাজের মেয়ে ছাড়া কোন চরিত্র দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা পরিচালকের। "
[/sb
নাটকগুলো উপস্থিত সংলাপ নির্ভর হয়ে যাওয়াতে অভিনয়ের শিল্পগুণ সম্পন্ন শিল্পী খোঁজা হয়না। মডেল নোবেল, শখ ঘরানার ফর্সা চরিত্রগুলো বেছে ধরে আনা হচ্ছে, ভারী মেকাপের সময়, ঝক্কি থেকে সুশ্রী চরিত্রে মানুষগুলোকে বাঁচানোর জন্য।
ফর্সা মানে পরিষ্কার, পবিত্র। কালো মানে গায়ের রঙ ময়লা এ ধরনের বিশেষণ আমাদের শিক্ষিত পাড়ায় শোনা যায়। আক্ষরিক অর্থ, ময়লা মানে কিন্তু নোংরা, সেদিকে মানুষের নজর নেই। পুরুষের আজন্ম ফর্সা নারীর চাহিদা বলে "পুরুষের উৎকট বর্ণভেদী রুচি" নিয়ে বিশেষত ম্যাডামেরা হৈ চৈ করে থাকেন। তবে সত্য হল, ময়লা-রঙ-পছন্দ পাত্র খুব সহজলভ্য না হওয়া সত্ত্বেও কালো মেয়েরা আমৃত্যু চিরকুমারী হয়ে আছেন, এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
পুরুষের কপাল ভাল, নেহায়েৎ আলকাতরা মারা না হলে অসমবর্ণের টাকা ওয়ালা পুরুষে মেয়েদের আপত্তি নেই। অথবা কালা সাইফুল একটু ফর্সা মেয়ে চাইছে, সামনের প্রজন্ম যেন একটু উজ্জ্বল বর্ণের হয়, এই আশায়।
জনৈক ব্লগার প্রবাসে শ্বেতাঙ্গ , কৃষ্ণাঙ্গ এবং উপমহাদেশীয় 'ময়লা বর্ণের' বিবিধ সম্পর্ক বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন। এক ফাকে 'নোংরা কালো' শব্দ দুটো এসে যাওয়াতে, আম জনতা ব্লগারের লেখক সত্তা, রুচিবোধ ধরে এমন তুলোধুনো করলেন যে চমকপ্রদ লেখা ও লেখাতে ঘটনা প্রবাহের সমস্ত বিষয়াদি আড়ালে চলে গেল। সেখানে অবশ্যই 'নোংরা' শব্দটি 'কালো' শব্দটিকে বিশেষায়িত করেনি।
দুটো আলাদা বিশেষণ কিন্তু পাশাপাশি অবস্থানের কারণে আমাদের অবচেতন মনের 'বর্ণবাদ গোত্রীয় হীনমন্যতা ' চাড়া দিয়ে উঠে। কতগুলো বখাটে নোংরা শেতাঙ্গ যুবক--কথাটিতে কিন্তু বর্ণবাদের এক ফোটাও আচ পাওয়া যায়না।
কাউকে ধলা মিয়া ডাকলে, কিন্তু খুব ভদ্রতাই ধরা হয়। কিন্তু কালা মিয়া সম্বোধনে আপত্তি আসতে পারে, "গায়ের রঙ ধরে সম্বোধন কেন?" কাজেই এটা বর্ণবাদ। টু হোয়াইট গাই কেইম ইন এন্ড দেন ওয়ান ব্ল্যাক গাই মুভড আউট।
'ব্ল্যাক' শব্দটা অপরিচিত মানুষ সনাক্তকরণে একমাত্র উপায় হলেও সেই বিশেষণটি আপত্তিকর। 'কালো' বর্ণটি বা শব্দটি নিজে থেকে খারাপ কিছুইনা, বর্ণবাদের আগাম সতর্কতা হিসেবে কাউকে 'কালো' বলে সনাক্ত করাটা, কাউকে 'ল্যাংড়া, কানা, খোড়া' বলে সম্বোধনকরার মত গুরুতর অপরাধ বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।
ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতা, মাদক ব্যবসা, উৎশৃঙ্খলতার কারণে একদল বখাটে, নোংরা কালো লোকদের সনাক্ত করলেও, 'ময়লা বর্ণধারী' উপমহাদেশীয়দের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সজাগ হবে। নোংরা কালোর বদলে বলতে পারতেন, নোংরা আফ্রিকান আমেরিকান, তারপরেও আমাদের মাথায় বর্ণবাদী অভিযোগ টনটন করতো। তাহলে উপায় হল, কালোদের নিয়ে কিছুই বলা যাবেনা, কারণে কোন পুরোপুরি 'বর্ণ নিরপেক্ষ' অভিযোগ করলেও আমাদের সচেতন সমাজ সেটিকে টেনে ঘুরিয়ে নিয়ে , "বর্ণের কারণে অভিযোগ বিধায়-বর্ণবাদ" রায় দিবেন।
দেশের নাগরিক হিসেবে কোন সংখ্যা লঘু আইন ভঙ্গ করার কারণে সরকার তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে, সেটিকে যে কোন বিচারে "সংখ্যা লঘু নিপীড়ন" বলতে খুশি হন অনেকেই। ঠিক এ ধরনের 'আরোপিত হীনমন্যতা' থেকে কালো এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের মত এক ঘরে এক গোত্র নিয়ে বসবাস করে, মূল ধারার জনগোষ্ঠীর সাথে মেলা মেশা করতে পারেনা।
শব্দ হিসেবে 'কালো' আমাদের কাছে 'নোংরা' শব্দটির মতই একটি নেতিবাচক বিশেষণ। সেটির প্রয়োগ এড়াতে গায়ের রঙ চাপা, গায়ের রঙ ময়লা, শ্যামলা বিবিধ শব্দ উচ্চারণ করা হয়ে থাকে। মানুষের গায়ের রঙ একটি সুস্থ, স্বাভাবিক প্রকৃতি প্রদত্ত ব্যাপার, অথচ এটি চলনসই প্রেক্ষাপটে কানাকে কানা বলিওনার, মত কালোকে কালো বলিও নার মত বিষয়।
যেন কালো হয়ে জন্মানোটা একপ্রকার বর্ণগত প্রতিবন্ধকতা। 'জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান' জাতীয় বিদ্যে শিখে কেউ যদি নিরক্ষর বাসের হেলপারের কাছে অশোভনীয় কথা ও আচরণ পাবার পর ভাবেন, "ঠিকই তো ভদ্রতা মনুষ্যত্ব শিক্ষিত লোকের কাছে যতটা আশা করা যায়, অশিক্ষিতের কাছে সেটি আশা করা অন্যায়। " তাহলেই হেলপারের চৌদ্দগুষ্ঠিকে আদরনীয় 'মায়ের ভাই-মামা' সম্বোধন থেকে নামিয়ে পশুর সাথে তুলনা করলাম কোন ধরনের শিক্ষাবোধ থেকে আম জনতা সাথে সাথে প্রশ্নবাণ ছুড়বেন।
নিজেদের ময়লা বর্ণের কারণে উপমহাদেশের মানুষ বর্ণবাদ বিষয়ে বেশ সোচ্চার ও সচেতন। কিন্তু নিজেদের বিয়েতে সবার দাবি থাকে বউটাকে ভারি চুনকাম করে মঞ্চে তোলা হোক।
আমি সাদা মেয়ে বিয়ে করেছি, আর সাদা মানেই পরিষ্কার, সুন্দর, উজ্জ্বল, পবিত্র। কালা ভোলা পাত্রের কিন্তু কোন প্রসাধন লাগেনা। বউ দেখে অতিথিরা বলে যাক, না মেয়েটা সুন্দর, লুকিং গ্রেট, কিংবা ব্যাপক সাজ-সজ্জার পরেও "চুনকাম" করানোটা ফরজ প্রসাধন সেই "সাদা প্রীতি" থেকে এবং আসল কালো, ময়লা, নোংরা রঙ লুকানোর অভিরুচি আমাদেরই। অন্তত বিয়ের দিন সবাই বলুক, নিষ্পাপ শ্বেত শুভ্র পরীর সাথে বিয়ে হল। এই বর্ণ চুরি বা লুকানোই হল বিয়ের অনুষ্ঠানকে সফল করার মৌলিক হাতিয়ার ।
এটা শুধু অভিরুচিই না, আমাদের সমাজ ধর্ম ও সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অংশ। এমন অসংখ্য উদাহরণে ময়লা রঙ ভীতি, সাদা রঙ প্রীতি নিয়ে আমরা আমাদের সমাজ ধর্ম পালন করি।
তাই,
কালোরা নোংরা নয়, তবে একদল নোংরা কালো আছে ---এই পরিষ্কার বর্ণ নিরপেক্ষ, অবর্ণবাদী অভিযোগের পরেও বর্ণবাদী আক্রমণের আতঙ্কে থাকা কিন্তু নিজেদের মাঝে বর্ণবাদ পূজো করে যাওয়া ময়লা গায়ের রঙ ওয়ালা মানুষের মাথা ঠান্ডা হয়না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।