বর্ণবাদ ও মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ
ফকির ইলিয়াস
=======================================
বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার দিকে। এগুচ্ছে মানুষ। মানুষের এই অগ্রগতিতে যতই বাধা আসছে মানুষ তা ডিঙিয়ে গেছে সাহসিকতার সঙ্গে। মানুষ জানিয়ে দিচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়নের পথে কোনো অন্তরায়ই তারা মেনে নেবে না।
ক’বছর আগে ব্রিটেনে একটি ঐতিহাসিক মামলার রায় মানুষকে আবারো আশান্বিত করেছিল।
নেইল বোমা নির্মাণকারী এবং বর্ণবাদী ব্যক্তি ডেভিড কোপল্যান্ডকে ব্রিটিশ আদালত ছয়বার যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেছে। চব্বিশ বছর বয়সী ডেভিড লন্ডনের ব্রিকলেন, পশ্চিম লন্ডনে সোহো এবং ব্রিক্সটনে নেইল বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে তিন ব্যক্তি নিহত এবং ১৩৯ জন আহত হন। ডেভিড আদালতে স্বীকার করে একটি বর্ণবাদী দাঙ্গা ঘটানোর লক্ষ্যেই সে বিস্ফোরণ ঘটায়। সে আরো বলে ওই ঘটনায় নিহত এবং আহতদের ব্যাপারে তার কোনো সমবেদনা নেই।
নাজিতন্ত্রে বিশ্ববাসী ডেভিড কোপল্যান্ডের স্বপ্ন ছিল এশিয়ান, আফ্রিকানসহ সমগ্র কৃষ্ণাঙ্গদের ইংল্যান্ড থেকে বিতাড়িত করা। সেই লক্ষ্যে সে নিষিদ্ধ ন্যাশনাল সোশ্যাল মুভমেন্টের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করে। ইংল্যান্ডের বর্ণবাদী বিএনপি’র (ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি) সঙ্গেও ছিল তার যোগাযোগ।
বর্ণবাদ বিশ্বের একটি সমস্যা। আশার কথা-তা যারা লালন করছে, তারা তা করছে সুপ্তভাবেই মনের কোণে।
বিশ্বের কোথাও প্রকাশ্যে এখন আর বর্ণবাদের কোনো সমর্থন নেই। দু’চারটি দেশে যদিও বর্ণবাদের কিছুটা দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, তবে তার অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে, গোপনে।
বিশ্বের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তী মি. মার্টিন লুথার কিংকে আমি বারবার প্রণাম জানাই। তাকে সম্মান করি এজন্য যে, প্রাণ দিয়ে তিনি যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন- তা প্রতিষ্ঠিত না হলে হয়ত আমিও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারতাম না। এ বিষয়ে আরো স্মরণীয় ব্যক্তিরা হচ্ছেন প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট মি. আব্রাহাম লিংকন, লৌহ পুরুষ মি. নেলসন ম্যান্ডেলা।
সেই পথ ধরে আজকের প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা। বিশ্বের কোনো মানবধর্মই বর্ণবাদকে সমর্থন করে না। মাও সে তুংয়ের একটি বাণী এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলতেন, ‘বর্ণ, জাত, গোত্র এবং সাম্প্রদায়িক দাম্ভিকতা যে মানুষ তার অন্তর থেকে নির্মূল করতে পারবে না- সে নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়া উচিত নয়। ’
বিশ্বের দেশে দেশে বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ায় বর্ণবাদী মানসিকতাকে নির্মূল করার নেপথ্যে কালাকালের সমাজতন্ত্রী নেতারা একটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
মার্কস, লেলিন, মাও সে তুংসহ আরো অনেক নেতা উচ্চকিত কণ্ঠে বলেছেন মানুষ মানেই সব সমান। এ ক্ষেত্রে বর্ণ কোনো বিষয় হতে পারে না। মানুষ বিচার্য হতে তার কর্মগুণে।
এটা অত্যন্ত আশার কথা, বিশ্বে বর্তমানে সমাজতন্ত্রের ক্রান্তিকাল চললেও গণতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক নেতারা বর্ণবাদ প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন। বিশেষ করে বিশ্বের বর্তমান ‘সুপার পাওয়ার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টই বলছে, বর্ণবাদ-নাজিতন্ত্রের নামে কোনো অপতৎপরতা মোটেই বরদাশত করা হবে না।
বর্ণবাদ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সর্বদা প্রস্তুত। ক’বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় রডনি কিং মামলা যুক্তরাষ্ট্র সেভাবেই মোকাবিলা করেছে। নিউইয়র্কের হার্লেস, ব্রংকস কিংবা ব্রুকলিনে যখনই সামান্য কোনো বিষয় নিয়ে বর্ণবাদের প্রেতাত্মা প্রকাশিত হওয়ার চেষ্টা করেছে তখনই তা দমনে এককাতারে দাঁড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাজ্ঞ রাজনীতিকরা।
মানব কল্যাণ, সভ্যতা এবং আধুনিকতাকে সামনে রেখে মানুষ এই যে এগিয়ে যাচ্ছে- তারপরও বর্তমান বিশ্বের কোথাও কোথাও মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর উদাহরণ দেয়া যায়।
ওসব আরব দেশগুলোতে এখনো প্রভু এবং দাসপ্রথা বিদ্যমান। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইনের অনেক লোক কাজ করছেন। এদের মধ্যে অনেক পেশাজীবীও রয়েছেন। কিন্তু এদের সবার সঙ্গেই অ্যারাবিয়ানদের ব্যবহার ‘দাস’-এর মতো। যারা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তারা ওই দেশে পৌঁছেই তাদের পাসপোর্ট, ‘কফিল’ র্অথাৎ যে আরবী তাকে ভিসা দিয়েছে তার কাছে হস্তান্তর করে দিতে হয়।
বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই ওসব দেশে। গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা সে সব দেশগুলোতে রহিত। একেকজন আরবী শায়খ, তাদের শ্রমিকদের সঙ্গে ক্রীতদাসের চেয়েও খারাপ ব্যবহার করে। মেধা, মনন, পুঁজি খাঁটিয়েও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে একজন বিদেশি স্বনামে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে না। ব্যবসা করতে হয় আরবী মালিকের নামে।
মূল স্বত্বাধিকারী বিদেশিকে গলাধাক্কা দিয়ে, ভিসা বাতিল করে উড়োজাহাজে তুলে দেয় পুলিশী হেফাজতে। বিনাপুঁজিতে চমৎকার ব্যবসাকেন্দ্রটি তার করায়ত্ত হয়ে যায়।
বর্ণবাদ না থাকলেও ধূর্ত সামন্তবাদের আদলে মধ্যপ্রাচ্যে এই যে অমানবিক দুর্বৃত্তপনা চলছে এর প্রতিকার দরকার। মৌলিক স্বাধীনতার প্রশ্নে সেসব দেশের নাগরিকদেরকেই জেগে উঠতে হবে। একেকজন মানুষ ‘রোবট’ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না।
জ্ঞানবিজ্ঞানের এই যুগে বিশ্বের মানবতাবাদী নেতাদের এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন। সামন্তবাদ বর্ণবাদেরই যমজ সহোদর। তাই বর্ণবাদের পাশাপাশি সামন্তবাদ ঠেকানোও আজ অত্যন্ত জরুরি।
ইংল্যান্ডের বিচারক, বর্ণবাদী ডেভিডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে যে নজির সৃষ্টি করেছিলেন- তা বিশ্বে বর্ণবাদকে আরো নিরুৎসাহিত করবে। কল্যাণকামী মানুষেরা চান, সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধেও এমন বিচার হোক বিশ্বের দেশে দেশে।
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক ডেসটিনি। ঢাকা । ১৬ মে ২০০৯ শনিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।