Only I know what is my goal, My heart is my temple.
নির্যাতন:০৭
কাজী সায়েমুজ্জামান : ক্ষমতাসীনদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়। তাদের জায়গাজমি দখল করে নিচ্ছে সরকারদলীয় নামধারী কিছু সন্ত্রাসী। পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে কয়েকজনকে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে নালিশ জানিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার বদলে দলীয় দখলবাজ সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নির্যাতিত হিন্দুরা ঢাকায় এসে বেশ কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন করেও অভিযোগ জানিয়েছেন। তারা স্পষ্ট করে বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা হিন্দুদের জমি, বাড়ি দখলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এর মধ্যে অনেককে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সরকারদলীয় কয়েকজন সংসদ সদস্যকেও তারা অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এর মধ্যে পিরোজপুরের হিন্দুরা দলমত নির্বিশেষে গণস্বাক্ষর দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অত্যাচারের প্রতিকারের আবেদন জানিয়েছেন।
চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করার অপরাধে সরকারদলীয় লোকজন অমরেন্দ্র মল্লিকের পরিবারের সদস্যদের নামে চুরি ও মারপিটের মিথ্যা মামলা দেন। পরে তার বাড়িতে হানা দিয়ে সবাইকে বেদম পেটান। অমরেন্দ্র মল্লিককে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সামনে উলঙ্গ করে মারধর করা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন। পরে হাজারো মানুষের সামনে দিয়ে প্রথমে পৌরসভা ভবনে নিয়ে আরেক দফা নির্যাতন করা হয়। অমরেন্দ্রের বিবাহিত কন্যাকে আটকে রেখে অপমান করা হয়।
শেষে তাদের থানায় হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ মিথ্যা মামলায় তাদের আদালতে চালান দেয়। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও সংখ্যালঘূ নির্যাতন হয়েছিল। বর্তমান সরকার ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর হামলার বিচারের জন্য কমিশন গঠন করে বিচারের আয়োজন করছে। অন্যদিকে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের হাতে জমিজমা, বাড়িঘর হারিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘুরা- বিষয়টি দুখজনক।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতা সি আর দত্ত বীরউত্তম এ ব্যাপারে সোমবার এ প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনা সত্য। এগুলো আমি অবহিত হয়েছি। আমরা এর বিরুদ্ধে কাজ শুরু করব। আওয়ামী লীগকে এর মধ্যেই আমরা জানিয়েছি। আমার কথা হলো – সবার বোঝা উচিত সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দুদের ওপর যে হামলা-নির্যাতন হচ্ছে তা দেশের মানুষ পছন্দ করে না।
এগুলো যারাই করুক পার পাবে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ স্থান থেকে সরকারকে যারা বিচ্যুত করছে তারা পার পাবে না। এদের রক্ষার্থে দেশের গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে আহবান জানিয়েছেন সি আর দত্ত।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত মঙ্গলবার বলেন, গত বছরের জুলাই থেকে সংখ্যালঘুদের জমি দখল, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ, মন্দির দখল, মন্দিরে যেতে বাধা ও খুনের ঘটনা লক্ষ্য করছি।
অনেক জায়গায় সংখ্যালঘু নারী অপহরণ ও ধর্ষণ করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতরা বর্তমান সরকারি দলের লোকজন। পিরোজপুর, নাটোর এবং গফরগাঁওয়ের সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাও প্রত্যক্ষভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারে জড়িত হওয়ারও প্রমাণ পেয়েছি। আমরা চার মাস আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রতিকার চেয়েছি। গত বছর ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি জানিয়েছি।
বলেছি, দুষ্কৃতকারীরা সরকারি দলের লোক বলে পরিচয় দিচ্ছে। সরকারি দলের লোকেরা অপরাধ করে বলে থানাও মামলা নিতে চায় না। এ সময় আশরাফুল ইসলাম আমাদের বলেছেন, তিনিও বিষয়টি কমবেশি জানেন। সরকারি দল বদল না হলে দিনবদল হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন। আমরা তাকে পশ্চিমবঙ্গের আদলে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ও দলে একটি সংখ্যালঘু সেল করার প্রস্তাব দেই।
তিনি বলেছিলেন, প্রস্তাব ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। পরে বিষয়টি আর এগোয়নি।
তিন এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ : হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য সরকারি দলের তিনজন এমপিকে সরাসরি দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, এদের প্রশ্রয়েই তাদের অনুসারীরা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করেছেন।
৫ মার্চ নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের তিনটি সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। এ বিষয়ে মামলা করতেও নির্যাতিতদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রাজ্জাকের ছেলে রেজাউল করিমের নেতৃত্বে কয়েকজন সন্ত্রাসী স্থানীয় বাসিন্দা নবকুমারের পুত্র প্রদীপ কুমারকে রামদা দিয়ে কোপায়। এ ব্যাপারে বড়াইগ্রাম আমলি আদালতে রেজাউলসহ তিনজনের নামে মামলা হয়। মামলাটি এখনো চলছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওরা মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। মামলা তুলে না নেওয়ায় সন্ত্রাসীরা তার জমির পাট কেটে নেয়। এ ব্যাপারে নবকুমার আরেকটি মামলা করেন। এতে ওরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে প্রদীপের চাচা শৈলেন্দ্রনাথ প্রামাণিককে কয়েকদফা মারধর এবং বাড়িঘর লুটপাট করে। এসব ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে আরো একটি মামলা হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে সন্ত্রাসীরা প্রদীপ কুমারের বাড়িতে গিয়ে নবকুমারকে মামলা উঠানোর জন্য সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে বলে। তাতে রাজি না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা তার পরিবারের সদস্যদের সামনে বাবা-ছেলে ও মা সুধারানীকে বেদম মারধর করে। তাতেও রাজি না হওয়ায় বাবা-ছেলেকে টেনেহিঁচড়ে আবদুর রাজ্জাকের বাড়িসংলগ্ন রাস্তার পাশে শিমুলগাছের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে বেদম মারধর করে। শেষ পর্যন্ত গলায় রামদা ধরে তাদের কাছ থেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য কাগজে সই নেয়। এরপরও মামলা তুলে না নেওয়ায় তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
নির্যাতনের বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতাদের জানালেও তারা অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে সালিশ করার নামে মামলা তোলার ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। রানা দাসগুপ্ত বলেন, এ ঘটনায় তিনি ওসির সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু স্থানীয় এমপির কারণে মামলা নেওয়া যাচ্ছে না বলে ওসি জানিয়ে দেন। পরে এমপি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে কথা বলি।
তিনি আমাকে বলেন, ওরা তো গয়েশ্বর। আমি তাদের বললাম, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে হিন্দুরা গয়েশ্বর আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে সুরঞ্জিত। তাহলে হিন্দুরা যাবে কোথায়? আর গয়েশ্বর হওয়ার কারণে কি তাদের উচ্ছেদ করে দেবেন? এর কোনো জবাব ওই এমপি দেননি। পরে জানতে পারি আগুন দেওয়ার আগের দিন এমপি ওই সন্ত্রাসীদের নিয়ে থানায় গেছেন। তিনি ওসিকে বলে দিয়েছেন, এরা আমাদের লোক।
এদের কথামতো থানা চলবে। এদের বিরুদ্ধে যেন মামলা না নেওয়া হয়। পরদিনই তারা আগুন দিয়ে তিনটি ঘর পুড়িয়ে দেয়। পরে বিভিন্ন মহলে যোগাযোগের পর এসপি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলা নিতে নির্দেশ দেন।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার দক্ষিণ সোনাখালীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা।
আমড়াগাছিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমান ছায়েদ ও তার বাহিনী ১ এপ্রিল শঙ্করের বাড়িতে হামলা করে তার ভাই সুভাষকে আহত করেন। ছায়েদের এক ছেলে এএসপি ও ছোট ছেলে আশরাফ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। এ কারণে হিন্দুরা প্রশাসনের তেমন কোনো সমর্থন পাচ্ছেন না। মারধরের পর একই এলাকার হিন্দু বলরাম বেপারীর দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর কয়েকদিন আগে বলরামের বড় একটি বলদ গরু ধরে নিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা।
দক্ষিণ সোনাখালীর অনিল চন্দ্র হালদারের পুত্র শ্যামল চন্দ্র হালদার ও সুধীর রঞ্জন হালদারের পুত্র সুশান্ত হালদারের প্রায় ২৫ বিঘা জমি দখলের চেষ্টা করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। এই জমির মালিকানা নিয়ে সুরেন্দ্রনাথ তালুকদার কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা আমড়াগাছিয়া ইউপি মেম্বার বিকাশকেও নির্বাচনে প্রার্থী না হতে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। ১৯ এপ্রিল ওই এলকার হিন্দুরা একজোট হয়ে গণস্বাক্ষর দিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। তারা এ ঘটনার জন্য স্থানীয় এমপিকে দায়ী করেন।
পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হলে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে এমপি প্রতিবাদপত্র পাঠান। এ ঘটনায় মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ জনস্বার্থে একটি রিট হাইকোর্টে দায়ের করে। রিট আবেদনে জমি দখলের ঘটনায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা পালনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পিরোজপুরের এসপি ও মঠবাড়িয়ার ওসিকে ৬ মে হাইকোর্টে হাজির হয়ে তাদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে বলেন হাইকোর্ট।
শুনানিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আনোয়ার হোসেনের প্রতিবাদের বিষয়টি জানানো হলে আদালত বলেন, আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে।
কিন্তু এ ধরনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে স্থানীয় সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের বদনাম করছেন।
রাজধানী থেকে তৃণমূল : শুধু হিন্দু নয়, অন্য সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরাও আওয়ামী লীগের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি রাজধানীর খ্রিস্টান সম্প্রদায় সংখ্যালঘুদের জানমাল রক্ষায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদাসীনতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে নালিশও জানিয়েছে।
গত বছরের ২২ আগস্ট রাজধানীর সূত্রাপুরের ৯৫ ঋষিকেশ দাস লেনে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা এক হিন্দু পরিবারের বাড়ি দখল করতে তাদের নয়জনকে মারধর, লুটপাট এমনকি পরে তাদের অপহরণ করে। এর আগে তাদের বাড়িটি কেনার জন্য ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
পরে দীর্ঘ আট ঘণ্টা চেষ্টার পর সূত্রাপুর থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনায় বিভিন্ন মহলের চাপে আওয়ামী লীগের স্থানীয় চার নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
২ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দাবিতে মানববন্ধন করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সংখ্যালঘুরা তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
২০ এপ্রিল কেরানীগঞ্জে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সম্পত্তি দখল করতে গিয়ে অজিত করাতি ওরফে ক্ষীরমোহনকে (৫৫) পিটিয়ে হত্যা করে।
এ সময় চারটি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয়। অজিত করাতিকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ফুটেজ ক্যামেরায় ধারণ করায় পুলিশ সাংবাদিকদের লাঞ্ছিতও করে।
গত বছর ২২ ডিসেম্বর রাতে সিংড়ার তাজপুর গ্রামে দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে বাড়িতে ও খড়ের পালায় দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ করে। এতে রাজবিহারী ঘোষ নামে একজন বৃদ্ধ দগ্ধ হন। দুই দিন পর তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
ঐক্য পরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত অভিযোগ করেছেন, আমি ওই গ্রামে তদন্ত করতে যাই। পরে দেখি ৯০ একর জমি নিয়েই এ বিরোধের সূত্রপাত। পরিস্থিতি অনুযায়ী উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদেরই স্থানীয় সংখ্যালঘুরা দায়ী করেছেন।
গত বছরের ২৫ জুলাই নরসিংদীর পলাশের চরসিন্দুর গ্রামে শ্মশানের জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের চারটি বাড়িঘর ও মূর্তি ভাঙচুর এবং তাদের বাড়িতে লুটপাট করা হয়।
১১ জুলাই দোহারের নারিশা পূর্বচর গ্রামে সংখ্যালঘু নৃপেন মালাকারের জমিতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দখল করা হয়।
২২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বড়মাছুয়া ইউনিয়নের খেজুরবাড়িয়া গ্রামের সিকদারবাড়িসহ চার সংখ্যালঘু পরিবারের পানের বরজ ও খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
পরিষদ নেতারা অভিযোগ করেন, বরিশালের অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনের মন্দিরে গত কোরবানির সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা গরু ঝুলিয়ে কোরবানি দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের এমপির পুত্র বনবিভাগের গাছ কেটে জায়গা দখল করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি জমিসংলগ্ন জেলেপাড়ার ৭০-৮০টি সংখ্যালঘু পরিবারের চলার পথ বন্ধ করে দেন। এদের উচ্ছেদের জন্য এ পন্থা নেন বলে ওই পরিবারগুলো অভিযোগ করে। পরে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক অবরোধও করেন।
পরে প্রশাসন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মামলা নেওয়ার অঙ্গীকার করলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। মামলার বাদীপক্ষের অ্যাডভেঅকেট অজিত কুমার অধিকারী বুধবারকে বলেন, ওই মামলার তদন্ত এখনো শেষ করতে পারেনি পুলিশ। পরিবারগুলো এখনো এ নিয়ে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন করার অপরাধে নির্যাতন : চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে সংখ্যালঘুদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ, নির্যাতন ও হামলা মামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করায় অমরেন্দ্র মল্লিককে পিটিয়ে এলাকাছাড়া করেছে স্থানীয় এমপি ও পৌর মেয়রের অনুসারী আওয়ামী লীগ নামধারী কিছু নেতাকর্মী। অমরেন্দ্রর বাড়িতে হামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলের সঙ্গে তাকে উলংগ করে বেধড়ক মারপিট করে ওই সন্ত্রাসীরা।
পরে প্রকাশ্যে পেটাতে পেটাতে পৌরভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি কক্ষে আটকে রেখে পৌর মেয়র ডাকাত নায়েক শফির নেতৃত্বে পিতা ও পুত্রকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এসময় অমরেন্দ্রর বিবাহিত কন্যা কাদঁতে কাঁদতে পৌর ভবনে হাজির হলে তাকেও পাশের একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রেখে শ্লীলতাহানী করা হয়। পরে পিতা পুত্রের নামে একই দিন চুরি ও মারপিটের মামলা দিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়।
মধ্যযুগীয় এ ঘটনাটি সীতাকুন্ড পৌর এলাকায় গত ৫ মে ঘটলেও কোন পত্রিকায় সংবাদ হয়নি।
স্থানীয় সাংবাদিকরা সাহসই পাননি- এ নিয়ে কোন সংবাদ লেখার। এর আগে সীতাকুন্ডে তীর্থযাত্রীদের গণডাকাতি করা হলেও কোন খবর হয়নি। অমরেন্দ্র চট্টগ্রামে চিকিৎসাও নিতে পারেন নি। তিনি ঢাকায় পালিয়ে এসেছেন। আজ আমার অফিসে বসে তার ওপর বর্বর যুগের কায়দায় নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের আমিরাবাদ মায়াকুঞ্জের এলাকার অমরেন্দ্র মল্লিক সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের প্রতিবাদে গত ৫ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। তিনি সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধ ও কল্যান কমিটির সভাপতি। ওই সংগঠনের ব্যানারেই তিনি সীতাকুন্ডের স্থানীয় এমপি আবুল কাশেম মাস্টারের ভাগ্নের হাতে শতাধিক সংখ্যালঘু জেলে পরিবার অবরুদ্ধ হওয়ার প্রতিকার চাইতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি ব্যানারে লিখেছিলেন, চট্টগ্রামে নৌকার কান্ডারী ও মাঝিমাল্লা কর্তৃক হামলা মামলা নির্যাতন ও বাপ দাদার ভিটে ভূমি সহায় সম্পত্তি জবরদখলের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন। এমপি ভাগ্নে বন বিভাগের গাছপালা উজাড় করে জাহাজ ভাংগার ইয়ার্ড তৈরী করে সংবাদ শিরোণাম হয়েছিলেন।
কিন্তু সরকারী জমির পর তার লোলুপ দৃষ্টি গিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর জমির ওপর পড়ে। তিনি টাকা নিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে দিতে সংখ্যালঘুদের নির্দেশ দেন। কিন্তু হিন্দুরা নিজেদের বাপ দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র যেতে অস্বীকৃতি জানালে পরিবারগুলোর বাড়ি থেকে বের হওয়ার একমাত্র রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। এছাড়াও শ্মশানঘাটে যাওয়ার রাস্তায় মুরগির খামার তৈরী করে এমপির ভাগ্নে। এর প্রতিবাদে সংখ্যালঘু পরিবারগুলো ঢাকা চট্টগ্রাম সড়ক অবরোধ করে।
একপর্যায়ে প্রশাসন এ ঘটনায় তদন্ত ও মামলা নেয়ার কথঅ বললে তারা অবরোধ তুলে নেন। মামলা হলেও দীর্ঘদিন ধরে তনন্তর নামে ঝুলে রয়েছে। এরই ফাঁকে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি কাড়তেই তারা সংবাদ সম্মেলন করেন। পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হলেই এমপি ও পৌর মেয়র বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
সংখ্যালঘুদের নামে একের পর এক মামলা দেয়া হয়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শচীন্দ্রলাল দের নামেও একটি ৫০৬ ধারায় হুমকির মামলা দেয়া হয়েছে। তিনিও ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
যেভাবে সপরিবারে নির্যাতিত হলেন অমরেন্দ্র
নির্যাতনের শিকার অমরেন্দ্র মল্লিক খোড়াতে খোড়াতে নিউ এজ অফিসে এসেছিলেন। তার এক হাত ভেংগে গেছে।
শরীরে নির্যাতনের অসংখ্য চিহ্ন। কাদতেও যেন ভুলে গেছেন তিনি। একটি সভ্য সমাজে কিভবে জনসমাক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে তা বুঝেও উঠতে পারছেন না। বর্তমানে ঢাকায় গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাসগুপ্ত আমাকে তার সন্ধান দেন।
বলেন, অসুস্থ থাকার কারণে অমরেন্দ্রর পাশে দাড়াতে পারিনি। সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতি করে আওয়ামী লীগ সরকারও এর পাশে দাড়াবে বলে মনে হয়না। আপনারা সাংবাদিকরা এর জন্য কিছু করুন। আমি তাকে আমার অফিসে আসতে বলি। কোনক্রমে অফিসে হাজির হয়ে অমরেন্দ্র তার উপর নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর সরকার দলীয় ক্যাডারদের হামলা মামলা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করায় কর্মকান্ডে স্থানীয় এমপি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন। গত ৫ মে দুপুর আড়াইটায় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী আমার বাড়িতে যান। তারা গিয়েই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়–য়া পুত্র শিমুল মল্লিককে বেধড়ক মারধর শুরু করে। আমি খবর পেয়ে বাড়ি যাই। আমাকে সামনে পেয়ে আমার ওপরেও চড়াও হয়।
আমরা দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা দড়জা লাগানোর সময় দেয়নি। ঘড়ের ভেতর ঢুকে আমাকে ও আমার পুত্রকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে মারধর করতে থাকে। আমাকে পরিবারের সামনেই উলংগ করে ফেলে পেটাতে থাকে। পরে আমাকে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া বেঁধে কিল ঘুষি মারতে মারতে টেনে বাইরে নিয়ে যায়।
আরেকটি গ্র“প ঘরে ভাংচুর ও তল্লাশী চালায়। আমার কন্যার স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়। পরে প্রকাশ্যে রাস্তায় পেটাতে পেটাতে পৌর ভবনের একটি কক্ষে নিয়ে আামকে ও শিমুলকে আটক করে। আমার বিবাহিত কন্যা পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে সেখানে উপস্থিত হলে তাকেও পাশের একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয়। এসময় পৌর মেয়র কক্ষে ঢুকে গালিগালাজ করতে থাকেন।
তিনি চিৎকার দিয়ে বলেন, শুয়ারের বাচ্চা, সংবাদ সম্মেলন করিস। এখন তোর আইন কানুন কই? কথায় কথায় তিনি থাপ্পড় মারতে মারতে নিচে ফেলে দেন। একই সঙ্গে শিমুলকেও মারা হয়। একপর্যায়ে পৌর মেয়র চিৎকার দিয়ে বলেন, চোখ বেধে দুরমুজ দিয়ে এর হাড্ডিগুড্ডি চুড়মার করে দাও। এরপরই আমার চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেধে লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করে কয়েক কাউন্সিলর।
এসময় আমার শরীর অবশ হয়ে পড়ে। আমি তাদের পা ধরে বলি, আমার শরীর অবস হয়ে গেছে। আমি পঙ্গু হয়ে গেছি। এ অবস্থায় মারধর করলে আমি আর বাচবো না। তারা আমার কথায় কোন কর্ণপাত করেনি।
একজন কাউন্সিলর আমার পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল নিয়ে যায়। এরপর মাটিতে ফেলে আমার বুকের ওপর উঠে তামাশা করেই নাচতে থাকে। পাশের কক্ষে আমার মেয়েকে আটকে রেখে তার বুকে হাত দিয়েছে। অশ্লীল গালিগালাজ করে যা করা হয়েছে তা বাবা হয়ে আমি কিভাবে বলবো? বিকাল চারটা পর্যন্ত আমদের সেখানে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়। আমরা নিস্তেজ হয়ে পড়লে আমাদের বেঁধে থানার দিকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যায়।
এসময় হাজার হাজার মানুষ আমাদের করুন দৃশ্য দেখতে থাকে। আমি বলতে থাকি আপনারা দেখুন, আমাদের ওপর কিভাবে অত্যাচার হচ্ছে। আমি ডায়াবেটিসের রোগী। হাত পা নাড়াতে পারছিনা। আমাকে আগে একজন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাও।
তারা আমাকে উল্টো মারধর করে থানায় নিয়ে যায়। পরে আমার অবস্থা দেখে একজন চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয়। চিকিৎসক কিছু এক্সরে করতে দেন। আমি বললাম আমাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করেন। তিনি আমাকে হাসপাতালে রাখতে রাখতে পারলেন না।
আমাকে ফোন করে ওসি মনিরুল ইসলাম গালিগালাজ করতে থাকেন। বলেন, শুয়োরের বাচ্চা হাসপাতাল থেকে স্বেচ্চায় থানায় চলে আয়। নইলে পেটাতে পেটাতে নিয়ে আসবো। রাতে গিয়ে দেখি একজন এসআই একটি মামলা লিখছেন। আমাদের নামে চুরি ও মারপিটের মামলা দেয়া হয়েছে।
আমরা নাকি আমাদের বাড়িতে যেসব লোকজন গেছে তাদের মারধর করেছি। পরের দিন আমাকে ও পুত্রকে আদালতে চালান দেয়া হয়। আমি থানার ওসিকে বলেছিলাম, আমার উপর যে নির্যাতন হয়েছে, তা তো নিজের চোখে দেখেছেন। আমি পুলিশের কর্মকর্তা থাকতে এ ধরনের অনেক মৌখিক এজাহার নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই কর্মকর্তা কোন এজাহার নেননি।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভেঅকেট রানাদাস গুপ্ত বলেন, অমরেন্দ্রর ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তা অকল্পনীয়। আমি তাকে মামলা করতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি নিজেই পঙ্গু হয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি সাংবাদিকদের সহায়তা চান। সংবাদ সম্মেলন করার অপরাধে সংগঠনের সচিব শচীন্দ্র কুমার দে’র বিরুদ্ধেও ৫০৬ ধারায় একটি মামলা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সীতাকুন্ড থানায় যোগাযোগ করা হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ জানান, আমি ১২ মে দায়িত্ব নিয়েছি। আগের ওসি বর্তমানে নোয়াখালীতে বদলি হয়েছেন। তাকে থানায় এসে আমার কাছে অভিযোগ দিতে বলুন।
খ্রিস্টানদের নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা : গত বছরের ৩০ অক্টোবর ঢাকার কাফরুলের একটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বসতবাড়ি বেদখলকারীর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের উদাসীনতার অভিযোগ করা হয় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে। ২ নভেম্বর এনা এ সংবাদটি প্রচার করে।
এতে বলা হয়, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি না পেলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধের আহবান জানিয়েছে দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়।
ঢাকা ক্রিস্টিয়ান ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (সিডিএ) নির্বাহী পরিচালক উইলিয়াম নিকলাস গমেজ এ পত্রটি লেখেন। ওই পত্রের কপি যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন সিনেটর এবং জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকেও দেওয়া হয়। ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নামধারী একদল সন্ত্রাসী বন্দুক উঁচিয়ে কাফরুল থানার পুলিশের সামনেই ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্য রীতা গমেজের বাড়ির অধিকাংশ জমি জবর-দখল করে। রীতা গমেজের পরিবার থেকে পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করতে গেলে তা নেওয়া হয়নি।
রীতা গমেজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জানান, তিনিও আওয়ামী লীগের কর্মী। গত নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন। অথচ এখন আওয়ামী লীগের পরিচিত লোকজনই পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় উপস্থিত আওয়ামী লীগ কর্মীরা এ সময় রীতা গমেজের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেন এবং হুমকি দেন, তারা তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবেনই। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার দলের লোকজনকে নিবৃত্ত না করে উল্টো বলেন, বাংলাদেশে জমিজিরাত দখলের ঘটনা ঘটছে, তাকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে কেন? এটা তো স্বাভাবিক একটি অপরাধ।
আওয়ামী লীগের সদস্যরাও তো এহেন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। আপনারা তো বিএনপি-জামায়াত সরকারের তুলনায় অনেক ভালো রয়েছেন। আর কী চান?
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান সরকারের আমলে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা থেকে ২৫টি সংখ্যালঘু পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জবর-দখল করছেন।
১৫ মে রাতের আধাঁরে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার সহযোগীরা উপজেলার পানপুঞ্জির খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কবরস্থান দখল করে ক্রুশ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।
সাতক্ষীরা থেকে সাংবাদিক সুভাষ চৌধুরী তার পাঠানো রিপোর্টে জানান, চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরের মতো এবারো সাতক্ষীরার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নির্যাতিত হচ্ছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন তারা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের জায়গাজমি দখল করে নিচ্ছে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা। নির্যাতিতরা অভিযোগ দিতেও ভয় পাচ্ছেন।
এসব ঘটনা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নালিশ জানিয়েও ক্ষতিগ্রস্তরা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
তারা জানান, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষাবলম্বন করে। এর ফলে তারা নিজেদের জমি নিজেদের মতো করে আর ব্যবহার করতে পারছেন না।
মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র ক’দিনের মাথায় বিদেশফেরত এক ছাত্রলীগ নেতা পুরান সাতক্ষীরায় দেবেন্দ্র চ্যাটার্জির মালিকানাধীন জমি হস্তান্তরের আইনগত জটিলতার ফাঁকে দখল করে নিয়েছেন। সেখানে বিশাল এক বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি।
২০০৯ সালের মে মাসে সাতক্ষীরার আবাদের হাটের ঘোষাল পরিবারের ৩৮ বিঘা জমি দখল করে নেয় যুবলীগের এক ক্যাডার ও তার সহযোগীরা।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ঘোষাল পরিবার আইন আদালতের আশ্রয় নেয়। পরে গ্রামের পাঁচশতাধিক লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে ওই জমি থেকে দখলবাজদের হটিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ওই নেতাকে সাতক্ষীরা জেলা যুবলীগের সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
কালিগঞ্জের গোবিন্দকাটি গ্রামের আওয়ামী লীগের আরেক নেতা দক্ষিণ শ্রীপুর ইউপির সাবেক মেম্বার স্মৃতি সরকারকে তার ভোগদখলীয় জমি থেকে হটিয়ে দিয়েছেন।
স্মৃতি সরকার জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে ওই জমি আইনি প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করে তার নেতৃত্বে সুফলভোগীরা চাষবাস করে আসছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তা দখল করে নেওয়া হয়। স্মৃতি মেম্বার পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও কোনো সুফল পাননি।
২০০৯ সালের ৩১ মার্চ দেবহাটার কালাবাড়িয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ ঘোষের মালিকানাধীন ৩০০ বিঘার ঘের দখল করে নেয় ভূমিহীন আওয়ামী লীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা। সুভাষ ঘোষ জানান, ১৯৭৯ সালে তার বাবা ওই জমি সরকারের কাছ থেকে নিলামে কেনেন।
দখলে বাধা দিলে তার স্বজনদের পিটিয়ে আহত করা হয় ।
একই বছরের ২০ ডিসেম্বর দেবহাটার ঢেবুখালিতে ৩০০ বিঘার অপর একটি ঘের দখল করে নেয় আরেক ডাকাত বাহিনী। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ১৯৬৮-৬৯ সালে মণিলাল স্বর্ণকার তার পুত্র তপন, স্বপন, শঙ্কর, কিঙ্কর, রমেশ ও তাদের মা মৈত্রী স্বর্ণকারের নামে দানপত্র করে দেন। এর আগে সরকার ১৯৮৩ সালে ওই জমির একাংশ খাস করে নেয়। স্বর্ণকার পরিবার আইনগত লড়াই করে ইনজাংশন লাভ করে।
২০ ডিসেম্বর ওই ডাকাত দল বোমাবাজি করে ওই জমি দখল করে নেয়। এ দুটি ঘটনার পেছনে আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে চলতি মে মাসের ১৪ তারিখে কালিগঞ্জের উজয়মারিতে ২২টি সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখল করে নেন আওয়ামী লীগের আরেক কর্মী। এরপরই ওই জমিতে ইটভাটা তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। এতে বাধা দিতে গিয়ে জমির মালিক রমেশ মন্ডলসহ আহত হন তিনজন।
সদর উপজেলার যুগিপোতা গ্রামের রবিন মন্ডলের ১২ বিঘা জমির চিংড়ি ঘের দখল করে নিয়েছে তিন সন্ত্রাসী। এতে বাধা দেওয়ায় রবিন মন্ডলকে তারা মারধর করে। পরে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার সহযোগিতায় ১৫ মার্চ এ ঘটনায় উল্টো রবিন মন্ডলের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
এদিকে আরেক আওয়ামী লীগ নেতা শ্যামনগরের গোপালপুরের সুরেশ মন্ডলের দুই বিঘা জমি জোর করে দখল করে নিয়েছেন। তিনি সুরেশ মন্ডলের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা ও ফেনী আদালতে একাধিক মিথ্যা মামলাও করেছেন।
শেষ কথা : বর্তমান সরকারের দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচবার ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। ইশতেহারের অগ্রাধিকারের ৫.৪ স্থানে ছিল ‘ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা হবে। ’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে – দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগেরই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এর সঙ্গে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
দিন দিন এটা বেড়েই চলেছে। সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে সব সম্প্রদায়ের মানুষের সমান আইনি সুবিধা ও নিরাপত্তা পাওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের লোকদের দ্বারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাতে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আমরা কোন গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি।
নির্যাতনের শিকার অমরেন্দ্র
নির্যাতন-৬ বেআইনী টিএফআই সেল, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।