আসেন দুর্নীতি করি। আর এই দুনিয়াটাকেই খুচাই!
১.
: কিরে কি খবর?
: এইতো, তেমন কোনো খবর নাই। গোয়িং অন এস ইউজুয়াল।
: জয়েন করছিস কবে? নাকি পাগলামী করবি আবার?
: নাহ, জয়েন করবো ভাবছি। শুধু সপ্তাহ দুই ছুটি নিবো তার আগে।
: হুমমম....দেশে গেলে বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসিস আর কিছু জিনিস পাঠাবো, নিতে পারবি?
: এ তুই কি বলছিস, এটা বলে আমাকে কিন্তু তুই ছোট করলি!
দু'জন চোখে স্বপ্ন নিয়ে বছর ৪ আগে ইউরোপ এসেছিলাম। একই প্লেন একই ফ্লাইট, শহর ভিন্ন। মাটিতে পা ফেলবার মাস ছয় পর আবারো দেখা হয় দুজনের এক জব ফেয়ারে। দুজনেই মরিয়া পায়ের নীচে মাটি শক্ত করবার জন্য। যেখানেই সুযোগ পাচ্ছিলাম, ঢু মারছিলাম, প্রথমে সিভি, পরে এ্যাপয়েন্টমেন্টের চেস্টা আরকি।
কিছুই হয়নি, কোর্স শেষ করে সেই চাকরী খোজা, আবারো সেই নতুন করে সবকিছু শুরু করা। টাকার অভাবে দুজনের কেউ আর দেশে যেতে পারিনি।
আজকে সকালে পোস্ট বক্সে পেলাম জয়নিং লেটার। মেইল এ্যড্রেস দেয়া এইচ আর এর ম্যানেজারের, যে কোনো ব্যাপারে মেইল করা যাবে তাকে। দু'সপ্তাহ পর জয়েন করা যায় কি না ভেবে দেখা যায়।
২.
কখন যে যৌবন পালিয়ে প্রৌঢ়তে পা দিয়েছি বুঝতে সময় লেগেছে। কপাল ঢাকবার মতো পর্যাপ্ত চুল আর নেই, মাথার ছাদে নাকি টাকটা এখন ঢালাই ছাদের মতোই লাগে। ভাবি না তেমন! ভূড়ি বের হয়েছে এটাই একটু আফসোস, সিক্স প্যাকস আর করা হলো না।
: আপনি কি মি. আলি?
: হ্যা। আমাকে আসতে বলা হয়েছিলো।
: হ্যা, আপনার নাম লেখা আছে, আপনার জন্য একটা পেপার আছে। আপনি ঐ বা পাশের রুমটাতে বসে কফি খেতে পারেন এবং এই পেপারটা পড়ে নিতে অনুরোধ করছি।
: অবশ্যই। কফির বদলে যদি একটা ঠান্ডা ফান্টা হয়, তাহলে ভালো হতো!
: অবশ্যই, আপনি গিয়ে বসুন ওখানে, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর কিছুক্ষনের মধ্যে মিস নাদিয়া দেখা করবেন আপনার সাথে।
মিস নাদিয়া হলো এইচ আর এর সেই ম্যানেজার। হাতে পেপারটা নিয়ে গিয়ে বসলাম রূমটায়। সবুজ একটা রুম, টিভি চলছে, পাশেই আজকের সব দৈনিক গুলো, এক কথায় সবকিছু মিলে দারুন একটা ইন্টেরিয়র। একটা চেয়ারে বসে চাকরীর টার্মস এন্ড কন্ডিশন হাতাতে থাকলাম। আজকে সকালে মেইল করে জানিয়েছে ওরা দু সপ্তাহের জন্য পেইড ছুটি দিয়েছে যেটা সামারের ছুটির সাথে ব্যালেন্স করে দেয়া হবে।
তবে আজকের মধ্যে পেপার সাইন করিয়ে রাখতে চায় কারন এখানকার সব ফ্যাসিলিটিজ শেষ করতে সপ্তাহ দুই সময় লাগে। সেটা যাতে মেকাপ করা যায়। আমি সাইন করলাম পেপারে, সমস্যাটা হলো আমার সিগন্যাচার এখনো মিলিয়ে করতে পারি না। নাদিয়ার জন্য ওয়েট করার কোনো দরকার নাই মনে হয়, শুধু ওর হাতে দেয়া আরকি।
৩.
: হ্যালো মা, কেমন আছো?
: রনি, তুমি কেমন আছো, বাবা?
: আমি ভালো।
তুমি?
: আমি ভালো আছি। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো হয় করতো? আজকে সকালে কি খাইছো বাবা? তুমি কি ভালো মতো খাওয়া দাওয়া করো?
এখানে এসে আমি একটু থেমে যাই। জীবনে আমি যতলোক বা বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনকে ফোন দিয়েছি কেউ কখনো জিজ্ঞেস করেনি কি খেয়েছি অথবা এমন দরদ ভরা কন্ঠে বলেনি আমি কেমন আছি! যখনই আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করে,' আমি কেমন আছি?' তখন মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা তার কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন ব্যাপার। যদি আমি ইগনোর করি বা খারাপ উত্তর দেই, মনে হবে এই বুঝি আমার মা কস্ট পেলেন।
: মা, তোমাকে একটা খবর জানাতে ফোন দিলাম।
আমি দেশে আসছি। টিকিট বুকিং দিয়েছি নেক্সট উইক বুধবার। বৃহস্পতিবার রাত তিনটায় আসছি।
: সত্যি? এতদিন পর আমাকে দেখার মনে হইলো তোমার? তুমি কি জা১নো তোমাকে যখন দেখতে মন চায় তখন তোমার ছবি দেইখা কত কানছি নাও তোমার বাবার সাথে কথা বলো।
: বাবা, আমি দেশে আসতেছি, আর মাকে বইলো তার জন্য একটা গিফট আনতেছি।
মার সাথে কথা বললে কেন যেনো চোখটা ভিজে যায়, যতই চেস্টা করি না কেন, আটকাতে পারি না একটা কিছু।
যাই হোক, একটা কাজ এখনো বাকি, মেইল করতে হবে একজনকে....না এখন না। পরে।
৩.
এয়ারপোর্টে বসে আছি। বিশাল দুটা ব্যাগ, শিউর এয়ারপোর্টে এই লাগেজ নিয়ে গন্ডগোল হবে।
যা হবে হোক, দেখা যাবে, কিন্তু দেশে এতো গরমে বাচবো কিভাবে? ভালো কথা, মামতো কি গাড়ি নিয়ে আসবে? গাড়ি নিয়ে আসলে তো একটু সমস্যা। মানা করলাম তবুও আসবেই। সবাই নাকি গাড়িতে করে আসবে। সবাই যদি গাড়িতেই আসে তাহলে আমি বসবো কোথায়, গাড়ির ছাদে?
হঠাৎ করে মাথায় উল্টা পাল্টা চিন্তা, তাড়াতেও পারছি না। একটা এসএমএস করা যায়, যদিও ওকে জানাইনি যে আমি দেশে আসছি।
'এই শোন, আম আসছি কাল রাত ৩টায়, সোজা তোমাদের বাসায় উঠবো, আমার শোবার কি জায়গা হবে? টয়লেট বা ড্রয়িং রুমে শুতে পারবো না কিন্তু'
কিছুক্ষন পর এসএমএস ব্যাক
'সমস্যা নেই, তোমার জন্য আমার বিছানা বরাদ্দ আছে। জানো, আমার বিছানাটা না অনেক বড়। তুমি খুব সহজেই আমার সাথে বেড শেয়ার করতে পারবে!'
৫ মিনিট হাসলাম। রিপ্লাই পাঠালাম।
'তাহলে তোমার বাসার সামনে এসে একটা মিসড কল দিবো, দরজা খুলে দিতে হবে কিন্তু!'
নাহ, এবার মোবাইলটা বন্ধ করি।
ওর ম্যাসেজ আর পড়বো না, উত্তেজনাটা ওপাশে কিছুটা হলেও চলুক।
প্লেনে উঠবার টাইম হয়ে গেলো।
৪.
আহ! কি গরমটাই না পড়েছে! জাস্ট গায়ে একটা ফুল হাতা শার্ট ছিলো, ওটা সিএনজিতে উঠেই খুলে একটা টিশার্ট বের পড়লাম, তবু পিঠটা ভিজে গেছে। লাগেজ কোনো মতে ছাড়িয়ে মামতোদের গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম, অনেক পারাপারি করলো, নাহ, ওদের সাথে যাবার টাইম এখন নয়। যাক সব জাহান্নামে, মিরপুর রোডে আর কতক্ষন লাগবে কে জানে!
একটু পরে নানা অলি গলি ঘুপচি পেরিয়ে ওর বাড়ির সামনে।
এখন একটা মিসড কল। ওহ শিট! ইউরোপের টেলিনর এখানে কাজ করবে কিভাবে!
শিট ম্যান, হোয়াটে ফুল আই এম!কেন যে ভুল করে প্লান করি!
কি করা যায়?
ঐ তো ওদের জানালা, কিন্তু লাইট বন্ধ!
কিভাবে ওকে ডাকা যায়?
এদিকে এই ভোরে কে আমার জন্য দোকান খুলবে যে একটা ফোন করবো?
ইয়েস বুদ্ধি!
খালি গলায় নিজের নাম ধরে ডাকা শুরু করলাম ওদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে,'ঐ রনি, রনি'। তিনটা ডাক দেয়ার পর হঠাৎ পিছনের একটা ফ্লাট থেকে বলে উঠলো,'এই সাত সকালে রনিরে খুজে কেডা?'
: ভাই সরি, আপনাকে না। আমি ঐ বাসার রনিরে খুজতাছিলাম।
: ও আচ্ছা, বেল টিপান, চিল্লাচিল্লি না কইরা।
আমার নামও রনি।
: রনি ভাই, শুভ সকাল, ধন্যবাদ আপনের বুদ্ধিটার জন্য।
বেকুব হইলাম আমিই। বেল টিপলেই হইয়া যায়। মাথা চুল টানতে টানতে ওর জানালয় চোখ পড়তেই দেখি ও চেয়ে আছে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে।
চিৎকার দিবে দিবে করেও মুখটা ঢেকে ফেললো উত্তেজনায়। মূহুর্তের মধ্যে জানালা থেকে সরে গিয়ে নীচতলার কলাপসিবল গেটে এসে পড়লো,'আরে তুমি? একি সত্যি? আমার কি ঘুম ভাংছে?'
: ঐ মিয়া, আমার ঘুম পাইছে। ঘুমামু না তুমার গল্প শুনমু?
: চুপ বেয়াদ্দব কোথাকার! আমাকে কি তুই একটু জানাবি না? তুই আসলেই একটা বান্দর।
: এই বান্দর তোমাকে নিয়ে একটু বেড়ুবো ১ ঘন্টার জন্য। যদি দরকার হয় আজকে অফিসে যেও না আর আন্কেল আন্টির পারমিশন লাগলে আমি নিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
: চোপ শয়তান, আগে মুখ হাত ধো, তারপর তোকে দেখাচ্ছি কত ধানে কত চাল।
৫.
৪৫ মিনিট ধরে রিক্সাট বসে আছি, আর সবার সাথে আমি গন রোস্ট হচ্ছি। ও আমার হাতটা ধরে রেখেছে।
: উমমম.....একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
: বলে ফেলো।
: আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখার কারনটা কি জানতে পারি? কাবিনানামার রিসিটটা আমার পকেটে, ওটা নিয়ে পালিয়ে যাই কিনা এই ভয়ে? হাতের হাড় তো ভেঙ্গে যাবার জো!
: (গালে একটা টাস করে চড় বসিয়ে) তুই আসলেই একটা শয়তান। এভাবে কি কেউ কখনো বিয়ে করে? আমি বাসায় কি বলবো? আর তুই সকাল বেলা আমার মাকে কি বলেছিলি যে আমাকে তোর সাথে যেতে দিলো?
: শুনো মিয়া, আমি হইলাম একখান মহা বান্দর, ঘাড়ে বসতে দিলে কইবো এইবার কান ধর!
এমন সময় জ্যাম ছুটলো।
: এই আমার গরম লাগছে, পরে হাত ধরো, এলাকাতেও ঢুকে পড়েছি, যদি কেউ দেখে ফেলে?
: কি অদ্ভুত কথা, ৪ বছর ধরে সবাও তোমাকে চিনে বসে আছে।
এমন সময় রিক্সার সামনে দিয়ে একটি ছেলে যেতে যেতে,' আরে রনি ভাই, কবে আইলেন?'
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,' দেখো কাহিনী!'
: ঐ শয়তান, আমি তোর বৌ, সবাই দেখলে তোর সমস্যা কি?
: এই রিক্সা, ডানে থামো, আইসা পড়ছি!
দরজার সামনে দাড়িয়ে নক করার আগেই বুঝতে পারলাম এক বিশাল হাউকাউ বাসার ভিতর,'এই তুমি ঘোমটা দিবা না?'
: চুপ শয়তান, বেল টিপ দাও।
আমি পুরোনো অভ্যাস মতো ডান হাতের হাড্ডি দিয়ে জোরে টাস টাস নক!দরজা খুলতে এক দঙ্গল চেনা মুখ আর সবার পিছনে মা।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মার সামনে দাড়িয়ে,' কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার আগে তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি। ওখে দেখতো আমি ওর পাশে মানাচ্ছি কি না?'
এমন সময় বোনটা বইলা বসলো ফিস ফিস কইরা,' কি সর্বনাশ , বিয়া কইরা আসছে, বাচ্চেলোগ, উছকো ঝাড়ুছে মারো!রনালয়কে পিট্টো!'
........................................................................................
নাহ, আর লিখবো না, তাহলে ফ্যান্টাসির মধ্যে আর আনন্দ থাকবে না। ব্লগার ফারজান ওয়াদূদের পোস্ট পড়ে মনে হলো এরকম আমারও তো একটা ফ্যান্টাসি আছে, মনে হয় একটা না আমার, অনেকগুলো ফ্যান্টাসি। লিখে ফেলি তাদের একটা দিয়ে। জানি না আমার ফ্যান্টাসি সত্য হবে কি না, সত্য হলেও কতটুকু হবে, তবে এটা জানি সকল মানুষের ঘর বাধার স্বপ্ন থাকে, খুব কম মানুষের সে স্বপ্ন ভাঙ্গে, আর তারচেয়ে আরো অল্প মানুষ যেই দুভাগাদের দলে থাকে যারা আর ঘর বাধতে পারে না।
আমি এখনও দুর্ভাগাদের দলেই, জানি না ভবিষ্যতে কি আছে।
তবে মাকে খুব মনে পড়ে, মনে পড়ে বাবাকে, বোনটাকে। অনেক কাজ এখনো বাকি, চোখে স্বপ্ন নিয়ে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি, রাতে আবার চোখ বুঝি এসব স্বপ্নকে বাস্তবে কিভাবে রূপ দেয়া যায় তার শ্রমের ক্লান্তি দেহে নিয়ে। একসময় মনে হতো আমার অশ্রু শুকিয়ে গেছে, আমার অতীতে সব স্বর্নময় সময় চলে গেছে, ভবিষ্যতে কিছুই নেই। জানি না, তবু যখন বসন্তের বাতাস গা ছুয়ে যায়, তখন মনে হয় শেষ থেকেও শুরু করা যায়, ধ্বংসস্তুপেও শিল্প তৈরী হয় একসময়!
এগুতে থাকি সময়ের পথ ধরে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।