ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দেশের জীববৈচিত্র্য
ক্রমাগত বন ধ্বংস করা, নদীদূষণ, নদীর নাব্যতা হ্রাস, অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অন্যান্য কারণে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য মারাত্দক হুমকির সম্মুখীন। মিঠা পানির মাছের প্রজাতির সংখ্যা ছয় শতাধিক। বর্তমানে তা দুই শ থেকে আড়াই শর মধ্যে বলে মৎস্যবিজ্ঞানীদের ধারণা। তারও বেশির ভাগ প্রজাতি খুব কম সংখ্যায় টিকে আছে। কিছু প্রজাতি নামমাত্র টিকে আছে।
কালেভদ্রে দু-একটি দেখা যায়। একই অবস্থা পাখির ক্ষেত্রে। প্রাচীন তথ্যাবলি থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের সীমানায় সাত শতাধিক পাখির বিচরণ ছিল। এখন বহু কষ্টে শ চারেক প্রজাতির দেখা মেলে, যার বেশির ভাগই অতি নগণ্য সংখ্যায় তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। শকুন, ধনেশ, ১০-১২ প্রজাতির পেঁচা, ময়না, চার প্রজাতির টিয়ার মতো অনেক পাখিই হারিয়ে যাওয়ার পর্যায়ে রয়েছে।
স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ বা অন্যান্য প্রাণীর অবস্থাও তথৈবচ। একই অবস্থা উদ্ভিদবৈচিত্র্যেরও। ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। আরো অনেক প্রজাতি হারিয়ে যাওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যের এই আশঙ্কাজনক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের সরকার, পরিকল্পনাবিদ, জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ আছে বলে কখনো মনে হয়নি।
তাই এ দেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ খুব কমই দেখা যায়।
বিদেশি দাতা সংস্থা বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশনের কারণে এর আগে সরকার কিছু বনকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছে। এটি হিতে বিপরীত হয়েছে। অর্থাৎ এর ফলে সেই বনগুলো আরো দ্রুত ধ্বংস হয়েছে। আগে বন বিভাগের অধীনে থাকা সেই বনগুলো থেকে কিছু রাজস্ব পাওয়া যেত।
ফলে বন বিভাগ সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যায় কিছুটা হলেও চেষ্টা চালাত। সংরক্ষিত বনাঞ্চল করার ফলে সেখান থেকে গাছ কাটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রাজস্ব আয় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে তদারকি-পরিচর্যাও সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়। সেই সুযোগে কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে চোররা বনগুলোর গাছ কেটে সাবাড় করে দিয়েছে।
টেকনাফ গেম রিজার্ভে ১৯৮০ সালের দিকেও যেখানে শতভাগ বন ছিল, এখন সেখানে প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ভাওয়াল গড়ের যেভাবে দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং যেভাবে বনের জমি দখলের প্রক্রিয়া চলছে, তাতে দু-এক দশক পর একটি প্রদর্শনী এলাকা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। মধুপুর সংরক্ষিত বনাঞ্চলেরও একই অবস্থা। চুনতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নামমাত্র অস্তিত্ব আছে। সামাজিক বনায়নের নামে একাশিয়া নামক বিদেশি প্রজাতির ক্ষতিকর গাছ দিয়ে সেখানে বনায়ন করা হচ্ছে, যা আমাদের বন্য প্রাণীদের আবাসযোগ্যতা নষ্ট করছে।
তদুপরি আইন অনুযায়ী বনাঞ্চলের সীমানার তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটখোলা থাকতে পারবে না। কিন্তু কেবল টেকনাফ ও চুনতি বনাঞ্চলের সীমানা ঘেঁষেই রয়েছে ১৮টি ইটখোলা। এদের ইট পোড়ানোর প্রধান জ্বালানি হচ্ছে এসব বনের কাঠ। এসব নিয়ে পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন নিয়মিত এসব ইটখোলার লাইসেন্স নবায়ন করে যাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বিশেষ কারণে ছাড়পত্র দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। অথচ এর রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা। এই জনসংখ্যা আবার অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলেছে। তাই ছোটখাটো গ্রামীণ বন অনেক আগে থেকেই উজাড় হতে শুরু করেছে।
বর্তমানে গ্রামীণ বনের খুব একটা অবশিষ্ট নেই। অথচ এসব গ্রামীণ বন ছিল বহু প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। জনসংখ্যার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন এসব বন রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। তাই গ্রামীণ বনাঞ্চলের সেসব প্রাণী ও উদ্ভিদ রক্ষা করাটাও সম্ভব হবে না।
অনেককেই বলতে শোনা যায়, আগে মানুষের সমস্যার সমাধান হোক, পরে প্রাণী ও উদ্ভিদের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা যাবে।
এর চেয়ে বড় মূর্খতা আর কিছু হতে পারে না। উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ তথা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে মানুষও যে টিকে থাকতে পারবে না, সেই সত্যটি তাদের অজানা। মানুষের সব সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন নেই_যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষ এমন কথা বলবেন না। প্রকৃতিবিজ্ঞান বলে, মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
কেন?
হাতের কাছের দু-একটি উদাহরণ নিলেই বোঝা যাবে। রাজধানীর ড্রেন বা নালাগুলোতে আগে প্রচুর পরিমাণে ডানকানা বা ছোট ছোট মাছ ছিল, ইংরেজিতে যাকে বলে গাপ্পি ফিশ। এদের প্রধান খাদ্য ছিল মশার শূককীট। ডোবানালায় প্রচুর ব্যাঙ ছিল, ঝোপঝাড়ে প্রচুর মাকড়সা ও টিকটিকি-জাতীয় প্রাণী ছিল, যাদের প্রধান খাদ্য মশা। সেগুলো এখন নেই বললেই চলে।
ফলে মশা বাড়ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। আর অবধারিতভাবে প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। শুধু ডেঙ্গু নয়, মশাবাহিত আরো অনেক রোগই বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া নতুন করে পূর্ণোদ্যমে ফিরে আসছে। ফাইলেরিয়া (গোদ রোগ), এনসেফালাইটিস _এমন অনেক রোগেরই কারণ এই মশা।
একইভাবে বাড়ছে মাছির উপদ্রব। বেলে মাছির কারণে কালাজ্বর এখন অনেক এলাকায়ই বেশ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ফসলে পোকার উপদ্রব ঠেকাতে প্রতিবছর আমাদের টনকে টন কীটনাশক আমদানি করতে হচ্ছে। কীটনাশকের ব্যাপক বিষক্রিয়া ইতিমধ্যেই মানবদেহে লক্ষ করা যাচ্ছে। ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি ফেইলিওরসহ তার বহু পরবর্তী প্রতিক্রিয়াও দিন দিন বাড়ছে।
অথচ আমাদের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা করে প্রায় ৪০ প্রজাতির মাকড়সা শনাক্ত করেছে, যেগুলো ধানক্ষেতে থাকলে পোকার আক্রমণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। কিন্তু আমরা কীটনাশক প্রয়োগ করে সর্বাগ্রে এই মাকড়সাগুলো মেরে ফেলি। তারপর শুরু হয় ক্ষতিকর পোকাদের নিরুপদ্রব রাজত্ব। চীনসহ অনেক দেশেই ধানক্ষেতে বাঁশ বা বাঁশের কঞ্চি পুঁতে রাখা হয় ফিঙে বা অন্যান্য ছোট পাখি বসার জন্য।
এদের প্রধান খাদ্য ফসলের ক্ষতিকর পোকা।
কিন্তু কোথায় সেসব পাখি? আমরা সাপ দেখলেই মেরে ফেলি, অথচ সাপের প্রধান খাদ্য ইঁদুর। তাই বাংলাদেশে ইঁদুরজনিত ফসলের ক্ষতি_কি গোলায়, কি জমিতে_প্রতিনিয়ত বাড়ছে। পেঁচাদেরও প্রধান খাদ্য ইঁদুর, কিন্তু সেই পেঁচা এখন আর চোখেই পড়ে না। একটি পোস্টারে দেখেছিলাম, একটি পেঁচা ইঁদুর মেরে তার জীবনকালে ১৬ লাখ টাকার ফসল রক্ষা করে।
আসলে প্রকৃতি জীবজগতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য কিছু নিজস্ব পদ্ধতি চালু রেখেছিল, যার একটি হলো খাদ্যশৃঙ্খল বা ফুড চেইন।
একটি শৃঙ্খল অনেক রিং বা আংটা দিয়ে গঠিত হয় এবং কোনো একটি আংটা ভেঙে গেলে গোটা শৃঙ্খলটিই অকেজো হয়ে পড়ে। তেমনিভাবে মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত আগ্রাসী তৎপরতার কারণে প্রকৃতির সেই শৃঙ্খল অনেকাংশেই বিনষ্ট হয়েছে। তারই পরিণতিস্বরূপ মানবসমাজকে আজ অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। কে জানে, তাদের মধ্যে কোনো একটি প্রজাতিতে হয়তো এমন কোনো নিদানিক বস্তু ছিল, যা মানবজাতির ভবিষ্যৎ কোনো স্বাস্থ্য হুমকিতে একমাত্র নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারত।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষের কাছে নেইও। তবু বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের আয়োজনের সীমাহীন দৈন্য আমাদের খুবই ব্যথিত করে। আমরা আরো বেশি ব্যথিত হই, যখন দেখি জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্বে থাকা কিছু বন কর্মকর্তা নির্বিচারে বন ধ্বংস করে, বনের চরিত্র নষ্ট করে বিদেশি প্রজাতির গাছ দিয়ে বন ভরে দেন, গাছ চুরিতে সহযোগিতা করে নিজেদের পকেট ভরেন এবং টাকা দিয়ে বালিশ ভর্তি করেন, আবার তাঁরাই যখন আগে মানুষ বাঁচানোর কথা বলেন। আরো ব্যথিত হই, যখন কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে নদীর পানি দূষণকারী এবং মাছসহ জলজ প্রাণী ধ্বংসকারী শিল্পমালিকরা উপদেশ দেন, বন্য প্রাণী রক্ষার আগে মানুষ সংরক্ষণ করুন।
দুঃখিত হই, যখন দেখি কিছুসংখ্যক স্বার্থান্ধ আমলা অর্থের বিনিময়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স দিচ্ছেন এবং মুখে মানুষের জন্য প্রেমের বাণী আওড়াচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ সমন্বিতভাবে ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় বেঁচে থাকা প্রয়োজন। এ জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যক্রম থাকতে হবে।
আসলে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য খুব বেশি অর্থ বা বড় বাজেটের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন আন্তরিকতা ও পরিকল্পনার। এ জন্য বন্য প্রাণীদের আবাসযোগ্যতা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপায় সম্পর্কে সামান্য জানাশোনা আছে এমন কিছু লোককে সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ সারা দেশের এ ধরনের উদ্যোগগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিতে হবে।
তাঁদের কার্যকরভাবে সেগুলো পরিচালনা করার মতো পরিবেশ ও স্বাধীনতা দিতে হবে। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে এ কাজটি সম্ভব নয়। সে জন্য একটি আলাদা বন্য প্রাণী বিভাগ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান সরকারের সামান্য সদিচ্ছাই এ দেশে জীববৈচিত্র্য রক্ষার কাজটি অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।