আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কৃষি খাত

টানা অবরোধ আর থেমে থেমে চলা হরতালের কারণে মাত্র দুই মাসেই দেশের কৃষি সেক্টর ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। শীত মৌসুমে উৎপাদিত ফল-ফসল, সবজিতে চরমভাবে মার খেয়ে কৃষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। অর্থ ও উপকরণের অভাবে চলতি মৌসুমের চাষাবাদও আটকে আছে। ফলে বোরো ধানের উৎপাদনেও সীমাহীন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মাঠে মাঠে হাহাকার শুরু হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

কৃষি সাংবাদিকতার পুরোধা, চ্যানেল আইর পরিচালক (বার্তা) শাইখ সিরাজসহ কৃষি বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, মাত্র দুই-আড়াই মাসের রাজনৈতিক অচলাবস্থায় কৃষি সেক্টর দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ে পড়েছে। কৃষকের সমুদয় ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কোনো বিকল্প পথ না থাকায় সারা দেশকে তার কঠিন জের পোহাতে হবে। উৎপাদন ধসে খাদ্যশস্য সংকট, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, খাদ্যাভাবসহ দেশে নানা ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টির সমূহ আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদেশের কৃষকরা অবরোধ ও হরতালের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে কৃষক তার বহু কষ্টে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে পারছে না। অনেক সময় খেতের পণ্য খেতেই নষ্ট হচ্ছে।

কৃষক কৃষাণির ক্ষোভ-আক্ষেপ সর্বত্রই, এসব প্রশ্নের জবাব কারও কাছে নেই। ঈশ্বরদীর কোটি টাকার কুল বিক্রি করা কৃষক ময়েজউদ্দিনেরও এবার একই আক্ষেপ। ময়েজউদ্দিন বললেন, এবার কুল আবাদ করে তিনি অবরোধ-হরতালের কারণে কোটি টাকা লাভের পরিবর্তে কোটি টাকার লোকসান গুনেছেন। এ ছাড়া অন্যান্য কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও একই ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে। এবার অবরোধ-হরতালে সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে না পারার কারণে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকার কৃষক বেগুনে বড় রকমের মার খেয়েছেন।

ঘাটাইলের গারোবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় এবার বেগুনের কেজি ১ টাকা, কোথাও কোথাও পঞ্চাশ পয়সায় নেমে আসে। অবরোধ-হরতালের কারণে যশোরের সবজি চাষিরা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার লোকসান গুনতে বাধ্য হন। কারণ, খেত থেকে সবজি তুলে স্তূপ করলেও হরতাল-অবরোধের কারণে তা আর বাজারের দিকে পাঠাতে পারেননি। ফলে খেতের ফসল পাশের আইলে পড়েই পচে গেছে, বিনষ্ট হয়েছে। অদূরেই মাটিতে বসে মাথায় হাত দিয়ে গুমরে কেঁদেছে কৃষকরা।

অবরোধ-হরতালকারীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের সাব স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে প্রায় ৬০ হাজার গ্রাহক প্রায় দেড় মাস ধরে বিদ্যুৎহীন রয়েছেন। সেখানেও বিদ্যুৎচালিত কয়েকশ সেচপাম্প বন্ধ হয়ে গেছে, বোরো আবাদ হয়নি বললেই চলে। এমনকি কৃষির সামগ্রিক ক্ষতির কোনো অর্থমূল্যও নিরূপিত হচ্ছে না। কৃষি অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কেবলই 'কৃষি সেক্টরে বেশুমার ক্ষয়ক্ষতি' কৃষকের সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া, 'শত শত কোটি টাকার ফসল ধ্বংস' উল্লেখপূর্বক নানা প্রতিবেদন দাখিল করছেন। কোথাও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি এখনো।

এবার হরতালে কৃষিপণ্য বোঝাই অন্তত তিনশ গাড়ি পোড়ানোর নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। হরতাল-অবরোধের কারণে অস্থিতিশীলতার জন্য চরম খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের অধিকাংশ কৃষককে। একদিকে ঢাকাসহ সারা দেশের বাজারে সবজিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য সরবরাহ না করতে পারার দুর্ভোগ, অন্যদিকে ডিজেল সরবরাহ বিঘি্নত হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ বিল-ঝিল-হাওর বেষ্টিত এলাকাগুলোতেও বোরো আবাদ চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। টানা হরতালে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে বিপিসির ৩টি জ্বালানি তেলের ডিপো থেকে উত্তরাঞ্চলে পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন উত্তোলন ও সরবরাহ বন্ধ থাকায় সেচ ব্যবস্থা পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বাফার স্টক থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে জরুরি সার পাঠানোর ব্যবস্থাও অচল হয়ে পড়ে।

মাঠে মাঠে ক্ষয়ক্ষতি আর ঘরে ঘরে হাহাকার : কৃষক সমাজে শুধু হরতাল অবরোধের ক্ষয়ক্ষতি আর হতাশার হাহাকার। বুকভরা আশায় ৩৬ হাজার টাকায় ৩ বিঘা জমি লিজ নিয়ে আগাম ফুলকপির চাষ করেছিলেন সাতক্ষীরার কৃষক রশিদুল ইসলাম (৩৫)। এনজিও থেকে আরও ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খরচ করেছিলেন সেই ফুলকপির খেতে। গাঢ় সবুজের বুক চিরে সোনালি রঙের ফুল বের হয়েছিল রশিদের খেতে। কিন্তু ফুলকপিগুলো তুলে ট্রাকে ভরেও তা আর ঢাকার বাজারে পাঠাতে পারেননি রশিদ মিয়া।

ফলে সব পুঁজি, শ্রম চোখের সামনে শেষ হয়ে গেছে তার। মাথায় ঝুলছে এনজিও থেকে নেওয়া সুদের ঋণ। সাতক্ষীরার গ্রামে গ্রামেই আবদুর রশীদের মতো সর্বস্বহারা কৃষকদের হাহাকার, আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। হরতাল ও অবরোধের কারণে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন বরিশাল অঞ্চলের কৃষকেরা। মণ প্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কম দরে ধানসহ অন্যান্য উৎপাদিত ফসলাদি বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।

বরিশাল অঞ্চলে আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ার পরও হরতাল-অবরোধের কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ধান বিক্রির জন্য পাইকারি বাজারে নিতে পারেননি তারা, বাধ্য হয়ে স্থানীয় পর্যায়েই প্রায় অর্ধেক দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। কয়েকজন কৃষক জানান, গুদামে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পাইকাররা এখন ধান কিনতে চাচ্ছেন না। হরতালে শুধু উৎপাদিত ফসল, ধান, সবজি নিয়ে যেমন কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন, তেমনিভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন খামারিরাও। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা গবাদিপশুর খামারগুলোতে প্রতিদিনের সংগৃহীত দুধ পর্যন্ত বিনষ্ট হয়ে গেছে।

একটি সূত্র জানায়, মাত্র ১৫ দিনের হরতাল-অবরোধের হিসেবে অন্তত তিন কোটি টাকা মূল্যের দুধ নদীর পানিতে ফেলে দিতে হয়েছে। ঢাকার যেসব কোম্পানি নিয়মিত দুধ সংগ্রহ করে থাকে তারা পরিবহনের অভাবে দুধ ক্রয় পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে ১৫-২০ টাকা লিটার দরে কিছু পরিমাণ দুধ বেচাকেনা চালানো হলেও কয়েকশ মণ দুধ বিনষ্ট হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন দুগ্ধ খামার মালিক জানান, ১৮ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুগ্ধ খামার মালিকরা। সূত্র জানায়, মিল্ক ভিটার ২৩টি সমিতি দৈনিক প্রায় ১০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে।

ঢাকার কয়েকটি কোম্পানি ৯০টি সমিতি থেকে দৈনিক ২০-২২ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে। সংগৃহীত দুধ সরাসরি চলে যায় ঢাকায়। হরতাল অবরোধের কারণে এসব কোম্পানির কোনো গাড়ি যাতায়াত করতে না পারায় দুগ্ধ খামার মালিকরা পড়েন বিপাকে। খামারে উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে না পেরে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে মালিকরা।

উপকূলীয় জেলার চিংড়ি শিল্পও চরম ক্ষতির সম্মুখীন।

চিংড়ি হিমায়িতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা না থাকায় হরতাল অবরোধে এ শিল্পে ধস নামে। সিজন শেষ। মহাজনরা হালখাতার চিঠি দিচ্ছে। যারা দায়দেনা করে চিংড়ি চাষ করেছিলেন তারা আছে মহাটেনশনে। চিংড়ি ঘেরের মালিকরা জানান, হরতাল অবরোধে পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় তারা ধ্বংসের মুখে পড়েছেন।

শুধু চিংড়ি শিল্পই নয়, হরতাল অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র উপকূলীয় এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতি। মাঠে পচে যাচ্ছে কৃষকের সবজি। সরবরাহ করতে না পারায় বন্ধ রয়েছে পোলট্রি ফার্ম ও চাতাল। ভঙ্গুর অবস্থায় আছে হস্তশিল্পসহ সব ধরনের উৎপাদন খাত। পচে যাওয়ার আতঙ্কে পানির দরে মাছ বিক্রি করতেও বাধ্য হচ্ছেন মৎস্য চাষিরা।

কৃষি ও মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবছর ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়ে থাকে। এর মধ্যে শীত মৌসুমে আট হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়। এ ছাড়াও বছরের ১২ মাস বিভিন্ন সবজির আবাদ করেন এখানকার কৃষকরা। এ অঞ্চলে লালশাক, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, করলা, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, ডাঁটা শাক, পেঁপে, কলা, বেগুন, বাঁধাকপি, কুমড়া, পালংশাক ও টমেটো উৎপাদিত হয়। কিন্তু টানা অবরোধে পরিবহন বন্ধ থাকায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে পারছেন না।

অথবা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করলেও তাতে খরচ উঠছে না। হাট-বাজারগুলোতে সবজি বিক্রি করতে না পারা কৃষকের চোখের পানির সঙ্গে ক্ষোভের আগুন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষে প্রায় ৫৪ হাজার টাকা খরচ হলেও বিক্রি থেকে মাত্র ১৬০০ টাকা তুলতে পেরেছেন বগুড়ার গাবতলী এলাকার কৃষক সালাম মিয়া। তিনি বলেন, '৭ টাকা কেজি দরে ফুলকপি বিক্রি করে বাকিগুলো ফেলে দিতে হয়েছে- গাড়ি ভাড়া দিয়ে কে তা বাড়ি ফিরিয়ে নেবে?'

টানা হরতাল আর অবরোধে লোকসানের মুখে পড়ছেন শিম সাগর খ্যাত পাবনার শিম চাষিরাও। অবরোধে পণ্য পরিবহন সমস্যায় মণ প্রতি দুই হাজার টাকার শিম বিক্রি করতে হচ্ছে অর্ধেক দামে।

এতে ফসলের উৎপাদন খরচও উঠবে না বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় চাষিরা। অন্যদিকে, আগের কিনা শিম নিয়ে লোকসানের মুখে পড়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। পাবনার আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার মাঠ ছেয়ে গেলেও কৃষকের চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছায়া। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উপপরিচালক এ বি এম মোস্তাফিজার রহমান জানান, এ দুটি উপজেলা চলতি মৌসুমে ৬ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে শিমের আবাদ হয়েছে। এতে চলতি মৌসুমে শিম বিক্রি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয় করবে বলে ধারণা ছিল- অথচ লোকসানে তাদের সব শেষ হয়ে গেছে।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.