থেমে যাবো বলে তো পথ চলা শুরু করিনি।
অনেককাল আগেকার কথা। আমাদের দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে বা তার সমাপ্তি চলে এসেছে। সে সময়ে একটা কথা শুনতে পেতাম। অনেকদিন পরে তা মনে পড়লো, ভাবলাম আপনাদের জানাই একটু।
সে সময়ে বলা হতো যে আমাদের নেতানেত্রীদের আর আমলাদের জাপানে নিয়ে গিয়ে আর জাপানের নেতা-নেত্রীদের আমাদের দেশে এনে, ওলট-পালট করে বদলী করলে, আমাদের দেশ জাপান হয়ে যাবে, অর্থাৎ আমরা দ্রুত উন্নতি করে যাবো। আর বেচারা জাপানীরা তাদের নতুন নেতাদের বদৌলতে ক্ষয় প্রাপ্ত হতে থাকবে। কথাটা মজা করেই বলা হতো। কেননা, আমাদের নেতানেত্রীদের বদৌলতে যে আমরা এগোতে পারছি না, তা হঠাৎ করে আজকের উপলদ্ধি না, এ উপলদ্ধি বয়স প্রায় বিশ বছর।
কেন কথাটা মনে পড়লো হঠাৎ করে? মনে পড়ার কারন হলো বিগত সাধারণ নির্বাচনে আমরা ভোট দিয়েছিলাম আমাদের দেশে একটা পরিবর্তন হবে এই আশা করে।
কেননা এর আগের দুই বছর সেনাবাহিনীর সমর্থনে যে সরকার শাসন করেছে, তাদের কীর্তিগাঁথা সাধারনের মনে গেঁথে গেছে -- রাজনীতিবিদরা ধোয়া তুলসি পাতা নন। আমাদের সামনে যারা প্রতি পাচ বছর পর পর আসেন জনপ্রতিনিধি হবার খায়েশ নিয়ে, তারা সবাই এক একটা চোর। সে খালেদাই হোক আর হাসিনাই হোক।
আমরা আরও জানতে পারলাম যে আমাদের নেতারা গরিবের ন্যায্য হিস্যাটুকুও মেরে খেয়ে ফেলতেন। তারা [ দুঃখিত যে তাঁরা লিখতে পারছি না ] জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, এবং জনগণের জন্যে কোন-কিছু-না-করার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তাদের চারপাশে থাকে মাস্তান এবং তাদের সাথে প্রায় পাচ বছর কেউ দেখা করতে পারেন না। তাদের ভালমন্দ খাবার অধিকার আছে, তারা কর মওকুফ করে গাড়ি আনেন, অসৎ ভাবে তা বেচেও দেন। তারা সব শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, ফায়দা তোলেন। আর সব ভোগান্তি হয় সাধারণের।
ঈদে বাড়িতে যাবেন, কিন্তু কোথাও কোন টিকেট নাই।
বাজারে যাবেন নিত্য প্রয়োজনের জিনিশ কিনতে, আপনার পকেটের সাথে বাজার দর মিলবে না। সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে যাবেন, কোন সিট পাবেন না। চাকরির কথা তো বলাই যাবে না এ অবসরে, সে তো একটা মহা-বাণিজ্যের নাম। বাস আর লঞ্চ কোম্পানিগুলোর মালিক ঐ জনপ্রতিনিধিরা; শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ঐ জনপ্রতিনিধিরা: আপনাকে যে চাল-ডাল-চিনি-তেল বেচে সেই অশুভ জোটের হোতা ঐ জনপ্রতিনিধিরা; গরিবের জন্যে যে সাহায্য আসে, তা লুট করে ঐ জনপ্রতিনিধিরা।
তাই আমাদের খুব আশা ছিল এ বারে নির্বাচিত সরকার আগের দুই বছরের কিছু সৎ কর্ম বহাল রাখবে।
যেমন দুর্নীতি দমন কমিসন পুরো মাত্রায় চালু থাকবে। র্যাব ক্রস-ফায়ার করে সেই সব অপরাধিদের খতম করবে যাদের বিচার করা আমাদের দেশের আদালতে এক্কেবারেই অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্র রাজনীতি থাকবে না, থাকবে পড়াশুনা আর পড়াশুনা। বাজারে থাকবে সার্বক্ষনিক নজরদারী। সব পরীক্ষাগুলো হবে সময় মতো যাতে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে কোন মূল্যবান সময় হারিয়ে না যায়।
আর জনপ্রতিনিধি হিসাবে যারা আসবেন তারা হবেন সত্যিকারের সৎ ও নিবেদিত প্রাণ।
আমাদের দেশের মানুষ হিসাবে আমরা খারাপ, আমাদের নির্বাচিতরা আমাদের চেয়ে ভাল হবে সেটা আশা করাটাও দোষের। কিন্তু এতো খারাপের মধ্যে কি একটা দুইটা কম খারাপ লোক পাওয়া যাবে না? যে সব জনপ্রতিনিধি আমরা পেলাম, তাদের সবাই কুলষিত। কারোরই গায়ে আতরের গন্ধ নাই, পচা লাশের গন্ধ করে। এরা কেউ বড় মাপের ডাকাত, কেউ বড় মাপের চোর, কেউ বড় মাপের মিথ্যুক, কেউ বা বড় মাপের খুনি।
এদের কাছে আমরা দায়িত্ব দিলাম পাচ বছর এই ভূখন্ডের শাসন করার।
আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত যা অগ্রগতি হয়েছে, তার পেছনে অবদান আছে আমাদের সাধারন মানুষের। তাঁরা তাদের সুবিধা মত কাজ করে গেছে। সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে তাদের জন্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা করেছে। আজ যে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা জোর গলায় বলছেন আমাদের সাথে জনগণ আছে, সেটা নিছক কথার কথা।
আসলে জনগণ তাদের প্রত্যাখান করেছে। একটু কান পাতলেই জনপ্রতিনিধিদের সমন্ধে ভাল কিছু শোনা যায় না, শোনা যায় সব কুকীর্তির রসালো গল্প।
আইনের শাসন কায়েম করা হলে নির্বিচারে ধর্ষণ, রাহাজানি, ডাকাতির মামলা খালাস করা হতো না। সরকারের অনেক দায়িত্বের মধ্যে একটা দায়িত্ব হলো সুবিচার নিশ্চিত করা। গণহারে মামলা থেকে স্বজাতীয়দের খালাস করে দিলে যাঁরা ভুক্তভোগি তাঁদের ন্যায় বিচার কে নিশ্চিত করবে? সর্দি হলে তা বড়লোকদের যেমন ভোগায়, দরিদ্রদেরও তেমনি ভোগায়।
ক্ষুধা, নিদ্রা, ভালবাসা, ঘৃণা -- এই অনুভূতিগুলো সবার জন্যেই সমান। আপনি আলিশান বাড়িতে থাকবেন বলে আপনার দুঃখ বেশি দামি হবে, আর আমি ভাঙ্গা ঘরে থাকি বলে আমার দুঃখ হবেই না, এটা যারা ভাবেন বা ভাবতে পারেন -- দুঃখের কথা তারাই আমাদের জনপ্রতিনিধি বা সমাজের অধিকর্তা।
আমাদের বুদ্ধিবাজেরা জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে কোনও অংশে কম না। তারা কোনও ভাল কথা বলতে পারে না। নিজের পক্ষের কোন দোষ দেখলে না দেখার ভান করে।
পারলে একটু মলম লাগিয়ে দেয় সেই ক্ষতের উপরে। তারা থাকে ক্ষমতাবানদের হালুয়া আর রুটির [ নাকি রুপির ] আশায়। তাদের একচোখ ঘোড়ার মত করে ঠুলি দিয়ে বন্ধ করে রাখা। এটা তাদের সুবিধার্থেই তারা ‘ভ্যাসেকটমি’ অপারাসনের মতো করে করেনিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই সব লোকদের হাতের তালুতে কোন রেখাই অস্তিত্বই নাই -- সারাক্ষণ হাত কচলালে কি হাতের তালুতে রেখা থাকবার কথা! যেহেতু এরা সত্যি কথা বলতে পারে না, তাই মনে হয় এরা নপুংসক -- এদের শিশ্নের উত্থান হয় না।
রাগ মোচনের একমাত্র উপায় হলো মিথ্যা কথা বলা।
আরেক দল আছে যারা পবিত্র ধর্মকে নিয়ে বেসুমার রাজনীতি করছে। তাদের দেখলে সাহাবীরা বা প্রথম চার খলিফারা তো পালাবেনই, মনেহয় স্বয়ং রসুল (সঃ) বলবেন বাংলাদেশে যা ধর্ম নামে চর্চা করা হয়, তা আর যাই হোক ইসলাম না। ইসলাম যেখানে সাম্যের কথা বলে, সবাইকে শান্তির পথ দেখায়, বাড়াবাড়ি থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বলে; সেখানে আমাদের দেশের ইসলামের ঝান্ডাধারিরা বলে ঠিক উল্টা কথা। তাদের চোখে ইসলাম মানে জেহাদ, ইসলাম মানে নেকি আর পূণ্যের কড়ায় গন্ডায় হিসাব, লম্বা লম্বা দাড়ি আর মধ্যপ্রাচ্যের অঢেল ‘মাল-ই গানিমাত’-এর যথেচ্ছ ব্যবহার।
রসুল নিজে কাজ করে জীবিকা অর্জন করেছেন, অন্যকেও উৎসাহ দিয়েছেন। ইসলামের প্রথম চার খলিফা রসুলের পথে থেকে সৎ ভাবে জীবনযাপন করে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। আমাদের যারা ইসলামের নামে আজ ভন্ডামী করে, তারা শান-শৌকতের মধ্যে বুঁদ হয়ে ডুবে আছে। তাদের না কোন পার্থিব অভাব আছে, না আছে কোন আর্থিক অভাব। আমার জানা মতে তারা কোন দিন আধপেটা খেয়ে ইসলামের মহানবীর মতো একটা দিনও অতিবাহিত করে নাই।
আজ তারা তাদের উপরে নেমে আসা বিপর্যয়কে রসুলের ধর্মপ্রচারের প্রাথমিক কালের সাথে তুলনা করে! হায়রে ইসলামের খাদেম নামের ইবলিসরা। কোথায় মহানবী আর কোথায় তুই ইবলিসের বাচ্চা। বিলাস আর ব্যসন তাদের নিত্য সঙ্গি। তাদের দিয়ে এদেশে ইসলাম কায়েম হবে না।
আবার তাবলিগ দিয়েও ইসলাম প্রচার হবে না।
তাবলিগ ইসলাম প্রচার করে খালি বড় বড় বাড়িতে যেয়ে। তারা তো বস্তিতে যায় না। বস্তিতে তারা ইসলামের শিক্ষা দিতে ভয় পায়। তাদের কাছে ইসলাম হলো জুমার নামাজে পাড়ার মসজিদে পাড়ার মাতব্বরকে ধরে আনা, যে কিনা ঘোষণা দিয়ে জেনা করে বেড়ায়। তাদের ধারণা পাড়ার মাতব্বর এসে গেছে সুতরাং পাড়ায় ইসলাম কায়েম হয়ে এল বলে।
অথচ আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। তাদের ভেতরে তাবলিগ প্রচারণা চালালে ধর্ম ব্যবসায়ীরা হালে পানি পেত না। ইসলাম মানে খালি জাহান্নাম আর জান্নাত নয়, ইসলাম মানে এটা নিষেধ ওটা নিষেধও নয়; ইসলাম আরো বৃহত্তর আঙ্গিকে, সবাইকে নিয়ে চলতে শেখায়। তবলিগ সেখানে ব্যর্থ হয়েছে।
এইভাবে এই দুই দলই সাধারন মানুষের কাছ থেকে ইসলামকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে না জনপ্রতিনিধি না ধর্ম -- কোন খানেই আমাদের আর আশ্রয় নাই। আমাদের কি করা লাগবে, আমরা তা বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু মানুষের জীবন যে খালি ভোগ করাতেই শেষ, তা একটু গভীর ভাবে ভাবলে অসার বলে প্রতিপন্ন হয়। তাই মানুষের জন্যে পার্থিব এবং পারলৌকিক দুই জগতের ‘খাদ্য’ প্রয়োজন আছে। আমাদের কোন উপযুক্ত নেতা নাই যে কিনা আমাদের পার্থিব জগতকে সার্থক করে তুলতে পারবে।
আর পারলৌকিক জগতের সমন্ধে উপযুক্ত কথা বলারই তো কোন লোক আমাদের মাঝে নাই।
আজ আমরা এক দিশাহারা জাতি। আমাদের সামনে যা কিছু দেখতে পাচ্ছি তা নগদ; এখানে কোন বাকি নাই, কোন সঞ্চয় নাই। সব ভোগ আর ব্যয়। দুনিয়ায় এসেছি মজা আর ফূর্তি করতে, দুই দিনের দুনিয়ায় যা পারি ভোগ করে যাই।
এমন করে চললে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।