ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের জন্য গত সোমবার থেকে নয় পর্বের লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। চলবে ১২ মে পর্যন্ত। প্রায় ৮১ কোটি ৪০ লাখ ভারতীয় নাগরিক এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে এই বিপুল ভোটার তো বটেই, অন্যান্য দেশের নাগরিকেরাও যথেষ্ট উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। যার প্রমাণ প্রতিদিনই মিলছে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে।
তবে খবরের কেন্দ্রে আছেন একজনই। তিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদি।
ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নিয়েও অল্পবিস্তর আলোচনা হচ্ছে। তবে সে আলোচনা উত্তাল হয়ে উঠছে না। কংগ্রেসের পারিবারিক নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে তা নিয়ে খুব বেশি উৎকণ্ঠা নেই। দলটির নেতৃত্ব বহু বছর ধরে নেহরু বা গান্ধী পরিবারের হাতে। এ ব্যবস্থার অবসান ঘটুক এবং সেখানে গণতান্ত্রিক ও যোগ্যতাভিত্তিক নেতৃত্ব দেওয়ার প্রথা চালু হোক, এ প্রত্যাশা খোদ কংগ্রেসের বিরাটসংখ্যক নেতার। তবে এটা নির্বাচনের প্রধান আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়নি। এমনকি কংগ্রেসের সহসভাপতি রাহুল গান্ধীও খুব একটা আলোচনায় নেই।
কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, দিশাহীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, মন্দাবস্থা, বেকারত্ব ইত্যাদিতে জনগণ ক্ষুব্ধ। আলোচনায় না আসার এটি একটি কারণ হতে পারে।
অন্যদিকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির সাফল্য তাঁকে এগিয়ে দিচ্ছে তরতর করে। গণমাধ্যমগুলোর নানা জরিপ বলছে, হাওয়া এবার বিজেপির পালেই। জনগণ তো বটেই ব্যবসায়ী সমাজও চাইছে বিজেপি ক্ষমতা আসুক, এমনটাই বলা হচ্ছে গণমাধ্যমে।
বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা বলছেন, ক্রমেই শ্লথ হয়ে আসা ভারতের অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে মোদির কোনো বিকল্প নেই। তিনি আসবেন গেরুয়া বসনে, দেবী লক্ষ্মী ও দেবতা গণেশের আশীর্বাদ নিয়ে।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মোদি এমন এক প্রশাসন ও শিল্প কাঠামো গড়ে তুলেছেন, যা তাঁকে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের আস্থাভাজন করেছে। প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অবসান ঘটিয়ে মোদি গুজরাটকে এক মডেলে পরিণত করেছেন।
পুরো ভারত যখন অর্থনৈতিক স্থবিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ব্যবসায়ী সমাজের কাছে মোদিই হয়ে উঠেছেন আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে বাকি ভারতেও একই ধরনের উন্নয়ন হবে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অবসান ঘটবে, এমনটা প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও অর্থনীতির হিসাব বলছে, আহমেদাবাদ ও তার আশপাশের এলাকা দিয়ে পুরো ভারতের বিচার করা অনুচিত।
কিন্তু মোদির আবির্ভাবে যদি সম্পত্তি ও সমৃদ্ধির প্রচুর্য ঘটে, তবে তাতে ভারতসহ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর উল্লসিত হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যক্তিটি মোদি বলেই উৎসাহের চেয়ে উৎকণ্ঠা জাগছে বেশি।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য গণমাধ্যমের একাংশের সহায়তায় তিনি নিজেকে যথেষ্ট উদার হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
এমনকি তাঁর ‘চিরশত্রু মুসলমানদের’ কাছেও তিনি ভালো ও বদলে যাওয়া একজন মানুষ হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে তাতে ঘাটতি আছে। তিনি আজও পরিষ্কার করেননি যে ধর্ম বিষয়ে তাঁর সরকারের অবস্থান কী হবে।
মোদির এই মুখ বুজে থাকাই আশঙ্কা জাগিয়ে দিচ্ছে। ২০০২ সালে মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করার অভিযোগে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে।
এতে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। সেই ঘটনা আজও মোদিকে তাড়া করে ফিরছে। এখনো যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ভিসা না দেওয়ার ব্যাপারে অনড়।
এর আগে ১৯৯০ সালে মোদি যে ‘অযোধ্যাযাত্রা’র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেটি ভারতে নতুন করে ধর্মীয় বিদ্বেষের বীজ বপন করে। তার ফল মেলে বছর দুয়েক পরই।
সে সময় দাঙ্গায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
অভিযোগ আছে, হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলমানদের হত্যার পেছনে মোদির হাত আছে। তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন বলেই, অত বড় ঘটনা ঘটতে পেরেছে। দিনের পর দিন তিনি হিন্দু ধর্ম বাদে বাকি ধর্মগুলোর বিষয়ে বিদ্বেষ ছড়িয়ে উগ্র হিন্দুবাদীদের মদদ দিয়েছেন এবং তাদের উগ্রতর করে তুলতে সাহায্য করেছেন।
মোদির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের একটিও কিন্তু আদালতে টেকেনি।
বারবার তদন্ত হওয়ার পরও প্রমাণ করা যায়নি যে তিনি এসব ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঘটনাগুলোর সময় অথবা তার কিছুদিন পরে হয় তিনি নয়তো তাঁর দল ক্ষমতায় ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সে সময় তাঁর সম্পৃক্ততার সব প্রমাণ সুকৌশলে ধ্বংস করা হয়েছে। আর প্রমাণ পাওয়া না গেলেও মোদি হরহামেশা এমন কথা বলে আসছেন, যাতে তাঁকে হিন্দু মৌলবাদী ও চরম অসহিষ্ণু ছাড়া আর কিছু বলে মেনে নেওয়া যায় না।
এমন একজন ব্যক্তিকে বহু জাতি-বর্ণ-ভাষার একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করাটা কেবল ঝুঁকির বিষয়ই নয়, ভয়াবহও বটে।
তারপরও বিভিন্ন গণমাধ্যমের জরিপ বলছে, মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছেন। যদি তা সত্যি হয়, তবে এটাই প্রত্যাশিত হবে যে মোদি নিজেকে নিরপেক্ষ ও যোগ্য বলে প্রমাণিত করবেন। তিনি যে ধর্মের পরিমণ্ডল ছেড়ে একটি মানবিক দুনিয়ার দিকে যেতে চাইছেন, সেটি কেবল কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে।
তার আগ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে বিচারের পথ একটাই—তাঁর অতীত কৃতকর্ম। মোদি যা করে থাকেন, তাতে পুরো ভারত আহমেদাবাদ হবে কি না, সেটি বলা মুশকিল।
তবে নানা আশঙ্কা যে তীব্র হচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।