আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাওরের কান্নাঃ যে কান্নায় আমাদের দায় কম নয়!

যেখানে বাঁধ সেখানেই বিপর্যয়। তাই বাঁধ মুক্ত জীবনের জন্য চাই বাঁধ মুক্ত পৃথিবী

হাওর এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে ধান ডুবে যাওয়া সংক্রান্ত খবর বিগত কয়েকদিন ধরে জাতীয় পত্রিকায় আসছে। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য! যারা কখনও ধান বা কৃষির সাথে সরাসরি জড়িত থাকেননি তাদের পক্ষে তা অনুধাবন করা খুবই কঠিন একটি বিষয়। কারণ এই ধান ডুবে যাওয়ার সাথে শুধু ফসলই ডুবে যাচ্ছে না, ডুবে যাচ্ছে চাষীর সকল চাওয়া-পাওয়া আর স্বপ্ন। অবধারিতভাবে এর ফলাফল কান্না এবং তা কেবল শারীরিক নয় বরং অনেক বেশী মনের।

কিন্তু আমার প্রশ্ন, এই কান্নায় আমাদের দায় কতটুকু? দেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের একভাগ জুড়ে এই হাওরাঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। এখানকার জনগণ মূলত দুটি ঋতুকে প্রধান করে ভাগ করেন, একটি বর্ষা যখন উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি বালিসহ পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে ভেসে যায় হাওরের নিম্নাঞ্চল আর হেমন্তে শুষ্ক ভূমি। হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলের মানুষ এমনই পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়ে চাষাবাদ করে আসছিল। প্রতি বর্ষায় তারা নানা জাতের গভীর পানির ধান উৎপাদন করতো আর এর সাথে ছিল দেশীয় মাছের এক বিশাল ভাণ্ডার। এই হাওরগুলোতে উন্নয়নের কথা বলে বাঁধ দিয়েছে কে? আমারই তো দিয়েছি।

এই অপরিকল্পিত বাঁধ আমাদের কি দিয়েছে? দেয়নি কিছুই বরং হাওরের প্রাকৃতিক জলাভূমির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করেছে। সেই সাথে আমরা হারিয়েছি আমাদের গভীর পানির ধান আর দেশীয় মাছের নিজস্ব ভাণ্ডার। এই বাঁধ তো হাওর এলাকা বন্যামুক্ত করতে পারেই নি বরং তা বন্যার ধরণ, সময় ও স্থানের পরিবর্তন করে আমাদের পরিবেশের বারটা বাজিয়ে দিয়েছে। আগে বন্যার পানি হাওরে আসতো ধীরে ধীরে ধান গাছও বেড়ে উঠত তার সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে। আর সেই ধানগাছে পূর্ণ জলাভূমিই ছিল দেশীয় ছোট মাছের সবচেয়ে পছন্দনীয় প্রজননক্ষেত্র।

সে সবের বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। তার স্থানে এসেছে অপরিকল্পিত বাঁধে ঘেরা অনিরাপদ অনুর্বর (পলি না জমায়) চাষের জমি তাও আবার অতি মাত্রায় সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিগ্রস্ত। সেই জমিই কোনটি কোনটি প্রতিবারই ডুবছে বাঁধ ভেঙ্গে হঠাৎ আসা বন্যায়। হাওর ভেসে যাচ্ছে কান্নায় সেই সাথে ভাসছে হাওরের স্বপ্নও। আমার প্রশ্ন কে চাষীদের শেখাল এই ভিনদেশী ধান চাষ করা? কে শেখাল সার আর কীটনাশকের ব্যবহার? যে ধান আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে টিকে থাকতে পারে না, শুধুমাত্র উৎপাদন বাড়ানোর পেছনে ছুটে সেই ধান যত্রতত্র চাষ আজ আমাদের শুধু নিঃস্বই করে নি করেছে আমাদের পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি।

তার দায় কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয়। এর পরিবর্তে বরং দেশীয় জাতের ধানের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গবেষণা করা ছিল আমাদের একান্ত করণীয়। বিদেশী হাই-ব্রীড ধান কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে চাষ করার সিদ্ধান্তের দায় আমরা এড়াতে পারি না কিছুতেই। তা হলে কি আমরা উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করবো না? আবশ্যই করবো তবে তার হাওরের মতো নীচু এলাকায় নয়। বিদেশী এই ধান উৎপাদনের জন্য যে পরিবেশ দরকার তার কাছাকাছি পরিবেশ দেশের যেখানে রয়েছে সেখানে আমাদের তা চাষ করতে হবে।

সবশেষে বলি ধানের উপর আমার জ্ঞান সীমিত। কিন্তু মাছের উপর আমার যেটুকু জ্ঞান রয়েছে তার প্রেক্ষিতে বলি বাঁধ দেয়ার ফলে আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয়ের (যেমন হাওর, বিল, প্লাবনভূমি) পরিবেশ পরিবর্তিত হওয়ায় আজ দেশীয় মাছ হারিয়েছে তার মূল ঠিকানা যার প্রভাব পড়েছে মাছের জীব বৈচিত্রের উপর। গর্ব করার মতো ধান আমরা হারিয়েছি আগেই। এখন আমাদের ঐতিহ্যময় মাছও হারিয়ে যেতে বসেছে। তার দায় আমরা এড়াতে পারি না কিছুতেই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.