দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...
সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এখন 'চেঙ্গিপোনা' ধরার ধুম পড়েছে। বোরো ধানকাটার পর ন্যাড়া ক্ষেতে ঠেলা জাল নিয়ে হাওরপাড়ের চাষীরা নতুন ধানের ভাতের সঙ্গে আয়েশে রসনা তৃপ্তির জন্য শুধু এই মাছের পোনাই ধরছেন। বোরো মওসুমে ধান তোলার পর সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের কৃষকরা অল্পপানির ন্যাড়া ক্ষেতে যুগযুগ ধরে এভাবে টাকি মাছের পোনা ধরে আসছেন, যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে। এক দশক আগেও ‘ কোরা অছু’ দিয়ে পোনা ধরা হলেও এখন কারেন্টের ঠেলাজাল দিয়ে পোনা ধরা হচ্ছে। যার ফলে কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার চিরায়ত লোক উপকরণ ঐতিহ্যবাহী 'অছু’।
আলাপকালে হাওরপাড়ের কৃষকরা জানান, এক দশক আগেও তারা ‘অছু’ (পোনা ধরার বাশবেতের তৈরী ত্রিকোণাকৃতির বস্তু) দিয়ে পোনা ধরতেন। কিন্তু এখন কৃষকের ঘরে আর অছু দেখা যায়না। কেউ আর নতুন করে বাঁশবেতের শৈল্পিক যন্ত্র ‘অছু’ তৈরী করেনা। অছুর বদলে কারেন্টের ঠেলা জাল শোভা পাচ্ছে তাদের ঘরে ছাঙ্গে (ছাদে)। অথচ এক সময় প্রত্যেক কৃষকের ঘরেই একটি অছু অনিবার্য ছিল।
যা দিয়ে তারা পোনাসহ নির্দিষ্ট মাছ ধরতেন। পুরোপুরি বর্ষা না আসা পর্যন্ত পুরো বৈশাখ-জৈষ্ট মাস কৃষকরা জমিতে পোনা মাছ ধরেন। এ মওসুমে এখন পর্যন্ত বর্ষার পানির বিস্তৃতি না ঘটায় হাওরে তুলনামূলক পোনামাছ একটু বেশি ধরা হচ্ছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। তবে টাকিমাছের পাশাপাশি শোল ও গজার মাছের পোনাও মাঝে মাঝে ধরতে দেখা যায়।
শেষ বিকেলে যখন হাওরে মৃদুমন্দ হাওয়া বয় তখন কৃষকরা কাধে জাল আর খলুই নিয়ে পোনা ধরতে বের হন।
এই বাতাস তাদের কান ঘেষে শিষ কেটে হাওরের সোদাগন্ধময় পানিতে নামতে উদ্ধুদ্ধ করে। তখন বিভিন্ন বয়সের কৃষকসহ তাদের কিশোর যুবক সন্তানরাও পোনাধরা অভিযানের সঙ্গী হন। হাঁটুসমান পানিতে নেমে খুব ধীরে ধীরে চলে পোনার ‘পাল’ (দল) খুজেন। আর পাল খুজে পেলেই তারা খেউ (ঝাপ) দিয়ে এলোমনিয়ামের পাত্রে চরম তৃপ্ত নিয়ে পোনা তোলেন। এভাবে গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমের বিকেলবেলা দলে দলে হাওরে পোনা ধরতে নামেন হাওরপাড়ের কৃষকরা।
তারা তখন মনের আনন্দে গুনগুনিয়ে হাসন, করিম, রাধারমণসহ বাউল গান গেয়ে থাকেন। আগে কেবল কৃষকরা পোনা ধরলেও এখন তাদের পাশাপাশি নিন্ম আয়ের কিছু লোক বিক্রির জন্যও পোনামাছ ধরেন।
কৃষক যখন পোনা ধরতে বের হন তখন থেকেই রান্নার প্রস্তুতি শুরু করেন কৃষকঘরের বউঝি। তারা কাচামরিচ, রসুন, পিয়াজ বাটা করে রেখে ঝোলহীন রান্না করে নতুনচালের ধোয়া উঠা ভাত পরিবারের সাবার পাতে পরিবেশন করেন। পোনার তরকারিতে কাচা মরিছ বেশি না হলে খাওয়া জমেনা।
কৃষক পরিবারের ছোটবড় সবাই তৃপ্তির ঢেকুর তোলে ভাত খেয়ে বোরো ধানের ভাড়ারঘেষা বিছানায় দেন তৃপ্তির ঘুম। এভাবেই যুগযুগ ধরে সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের কৃষকরা টাকিমাছের পোনা ধরে আয়েশে রসনা তৃপ্তি করে আসছেন। এই মওসুমে এই পদ্দতি পোনাধরা ও খাওয়া এই অঞ্চলের চিরায়ত সংস্কৃতিতে স্থান করে নিয়েছে। যা এই অঞ্চলের লোক সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
সুনামগঞ্জ সদর থানার মোহনপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক মোঃ নছিব উল্লাহ বলেন, ‘ ১০ বছর আগেও হখলের ঘরে অছু থাকতো পনা ধরার লাগি।
এখন ১০০ কৃষকের ঘরের মাঝে একজনরে কাছেও কোন অছু নাই। অছুর বদলে জাগা নিছে কারেন্টের জাল। ’ তিনি বলেন অছুর পোনার স্বাদই আলাদা। একই গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বেশি খুজাখুজি লাগেনা...জুইতমতো সকালে-বিকালে এক খেউ দিলেই অয়...! তার মতে ভাকেতর সঙ্গে পৃথিবীর শ্রেষ্ট মজাদার তরকারি হলো পনার সালুন...!
শাখাইতি গ্রামের কৃষক সমুজ আলী বলেন, ‘নতুন গরম বোরো ভাতের সঙ্গে পয়লা পয়লা পনা না অইলে খাওয়া জমেনা। ’ তিনি জানান, সারা বছরটাই যেন এর জন্য তার ফাকা ফাকা লাগে! তাই নতুনভাতের সঙ্গে সপরিবারে ঝোলহীন কাচামরিছ বহুল পোনামাছের তরকারি দিয়ে এই সময়ে ভাত না খেলে ভাত হজম হয়না তার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।