আহত উড়াল
'অন্ধকারের সৌন্দর্য্য দেখতে হয় অন্ধকারের মধ্যে থেকে'-এমনতর নিয়ম মানলে আলোর সৌন্দর্য্য দেখতে হবে আলোর মধ্যে গিয়ে। নির্ভেজাল আলো, স্বচ্ছ আলো, জ্ঞানের আলো, চেতনা ও বিবেকের আলো - ভীষন আলোয় পৃথিবী ছেয়ে দেব বলে সেই কোন দূর শৈশব থেকে আনমনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাবার হাত ধরে প্রথম ইশকুলে..ছোট্ট পায়ে সেই যে আলো অন্বেষনের যাত্রা শুরু, প্রিয় মায়ের যত্নশীল হাতে সেই যাত্রার মমতাময় পরিচর্যা। তারপর কু-ঝিক-ঝিক শব্দতুলে গহীন অন্তরালে ছুটে চলেছে স্বপ্নালোকের ইঞ্জিন, কত তার ইষ্টিশন! উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় - আশৈশব লালিত স্বপ্নের সম্ভাবনাময় উল্লাস, তুলনাহীন কিছু সময়ের অগোছালো গ্রন্থায়ন।
তাবৎ চরাচর থেকে ছুটে আসা শিশির বিন্দুর মত স্বচ্ছ-সরল অচেনা স্বাপ্নিক মুখগুলো, বন্ধুতার কী ভীষন টানে দূরত্বের আড়াল ভেঙে ফেলা! অতপর একই সারিতে এসে দাঁড়ানো, পায়ের ছন্দে পা মিলিয়ে যৌথ পথচলা। তারপর কত শত বেলা-অবেলার বয়ে যাওয়া হৃদয়ে অমল আহবানে, তুখোড় আড্ডায়, কবিতা/গান/পথনাটক/চারুকলা/নববর্ষ মেলা। প্রিয় সেই অলস আশ্রয় - রোকেয়া হলের গোল চত্বর, ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের রবীন্দ্র ভবন, আর তার উঠানের নীপবৃক্ষ - বর্ষার গন্ধমাখ মেঘমন্থিত কদম, আমাদের বৃষ্টিবেলার নিরব সাথী। পাঠমধ্যাহ্নে আমতলায় রানার দোকানে ছলকে ওঠা চায়ের কাপে আড্ডার ঝড়, আলোচনা, বিতর্ক, হুল্লোড় - আমাদের সিঁটি বাজানো দিন। কত ক্লান্ত দুপুর লাইব্রেরিতে ভাতঘুমে ঢুলুঢুল চোখে ক্লাসএ্যাসইনমেন্ট, অন্তরে উচাটন, বিকেলের জন্য প্রতীক্ষা।
শেষমেষ সেই প্যারিস রোড, ফ্লুরেসেন্ট সন্ধ্যা, উদাত্ত কন্ঠে সমগীতি - সুমন/অঞ্জন/নচিকেতা, ব্যান্ড থেকে ভাওয়াইয়া কিংবা হাসন/লালন। দিশেহারা পথ হাঁটা - শহীদ মিনার/ ইবলিশচত্বর/বধ্যভূমি/শাবাশ বাংলাদেশ, কৃষ্ণচূড়া আর জারুলফুলে নুইয়ে পড়া 'ওয়ে টু হেভেন' তারপর ঘুরে ফিরে আবারো সেই প্যারিস রোড। আহা, প্যারিস রোড! দেবদারু আর গগনশিরিষের ছায়াময় আমাদের মন ও মননের পথ, কত জোসনা রাতে হেঁটেছে আমাদের পায়ে পায়ে। কত গল্প, কত কল্প,কত উল্লাস, সর্ম্পকের বোঝাপড়া, খুনসুটি, কত ভুল আর ভুলবুঝাবুঝি, ছেলেমানুষি, কত বড়মানুষি, কত সুখ ও অসুখে বন্ধুতার নির্ভারতায় উড়িয়ে দেয়া আমাদের দীর্ঘশ্বাস। ক্লাস এ্যাসইনমেন্ট, টিউটোরিয়াল, প্রেজেন্টেশান,পরীক্ষা, টেনশান, রেজাল্ট - আনন্দ উদ্দীপনা - আহা, সবকিছু শেষ।
অবধারিত নিয়মেই সবকিছুতে এক অচিন ধুলোপড়ে যাচ্ছে। পুরোনো হয়ে যাচ্ছে মগ্ন এক গল্প, আমাদের গল্পের প্রেক্ষাপটে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে নবীন মুখের মুখর উচ্ছাস। প্রাণের এই বিদ্যামন্দিরে বেজে গেছে আমাদের বিদায়ঘন্টাধ্বনি। মায়াময় 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়' ছেড়ে আমাদের গন্তব্য বাস্তবতার আলো-আঁধারী কোন অসীম বিস্তারে। ভবিতব্যের নিরন্তর দোলাচলে তবু মতিহারে সবুজ চত্বরে কোথাও আঁকা আছে আমাদের নস্টালজিক পদচিহ্ন।
*রচনাকাল-আগস্ট ২০০৬
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।