আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কালি ও কলম পুরষ্কার পাওয়া উপন্যাস অন্ধ জাদুকর নিয়া দুই-চাইর কথা।

কতো কী করার আছে বাকি..................

অন্ধ জাদুকর উপন্যাসটা আগে একবার পড়ছিলাম। পুরষ্কার পাওয়ার খবর শুইনা আবারো পড়লাম। উপন্যাসের শুরুর দিকটা পড়তে পড়তে মাহমুদুল হকের কালো বরফের কথা মনে হইতেছিল। অন্ধ জাদুকরেও মাহমুদুল হক আছেন বেশ ভালো ভাবেই। আছেন ইলিয়াস, ভিটগেনস্টাইন, ছফাসহ অন্যান্যরা ।

কিন্তু মাহমুদুল হক আছেন বড়ো একটা অংশ জুইড়া। তার মৃত্যুর পরে লেখকের অনুভূতির অংশ বর্ণনাটা দারুণ। এই অংশটুকু কাব্যময়তায় আর চিত্রনে অসামান্য আবেগের ফুল হয়ে ঝরে ঝরে পড়ে। কিন্তু মাহমুদুল হকের প্রভাবটা কাটানো যাইতো। তাছাড়া এই অংশটুকু নিয়া লেখক একটা গল্পও লিখছেন, কোন পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় সেই গল্প ছাপানোও হইছে।

উপন্যাসের একটা অংশ হুবুহু তুইলা দিয়া সেটারে গল্প হিসেবে চালান করার আইডিয়াটা ভাল্লাগে নাই। এই অংশটারে আমার কাছে কুমির ছানা মনে হইছে। এছাড়াও বিভিন্ন লেখক ব্যক্তিত্বের অংশ আলোচনায় মোস্তফা কামাল নির্মোহ হইতে পারতেন। এতে পাঠকের সুবিধা হইতো। তিনি এখানে কায়সার নামের আড়ালে নিজেরে আড়াল করতে পারেন নাই।

আবার প্রকাশ ঘটাইতেও পারেন নাই। এই ক্রাইসিসটা মাধ্যবিত্তের। উপন্যাসটাও মধ্যব্ত্তিরে নিয়া। কমন ধাঁচের মধ্যবিত্ত। এই ধাঁচটা পড়তে গিয়াও হুমায়ুন আহমেদরে মনে হইছে।

এই জন্যে না যে তিনি হুমায়ুন আহমেদের মতো কইরা তুইলা ধরছেন চরিত্রগুলারে। শরীর আর সমাজ পরিবার নিয়া হুমায়ুন আহমদীয় চরিত্রের সাথে উপন্যাসের নায়ক কায়সার, তার আত্মহত্যা করা বোন কাজল, মারা যাওয়া বড়ো ভাই, ছোট বোন নিশা, দুই সন্তানের জননী ভাবী, প্যারালাইজড বাবা, মা এদের মিলানো যায়। এইখানে একটা সংকটে পড়ছেন লেখক। এই চরিত্রগুলারে জল নদী আকাশ কীট পতঙ্গের আবহে গড়তে গিয়ে ভাঙতে পারেন নাই ভালো মতো। তাদের ভেতরে ক্ষয় ক্ষত কষ্টগুলা কায়সারের চোখে দেখা।

ঠিক তাদের ভেতর থেকে দেখা না। যেমন কায়সারের ভাবী। জামাই মইরা যায়ার পরে তার সংকটগুলারে কায়সার এভয়েড করছে। দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া দেখছে। ভাবীর শ্রম ভোগ করলেও মনের বিষয়ে দুরত্ব ছিল তার।

ভাবী এবং তার দুই বাচ্চা সংক্রান্ত বিষয়ে এতোটা নির্মোহ থাকার বিষয়টা চোখে লাগে। এমন কোনো বাঙালি দেবরের সন্ধান হয়তো পাওয়াই যাবে না যে তার গোপন মুহূর্তে তার ভাবী/বৌদিকে একবারও কামনা করেনি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সম্পর্ক আর বেশিদূর এগোয় না, আফটার অল ভাইয়ের বউ, আর কতদূরই বা এগুনো যায়? বিশেষ করে ব্যাপারটা যখন সিরিয়াসলি সামনে চলে আসে, তখন দেবরদের মধ্যে এক ধরনের ক্রাইসিস দেখা যায়, সেটা প্রধানত কামজ অনুভূতির- যে শরীরে আমার ভাই উপগত হয়েছে সেখানে আমি... কিভাবে? কিভাবে সেটা সম্ভব? অন্তত কায়সারের ক্ষেত্রে অনুভূতিটা এমনই। কিন্তু এগুলো ওই কুচক্রি মানুষগুলোকে বোঝাবে কে? এইখানে বাঙালি দেবরদের শরীরে নিজের চেহারা প্রতিস্থাপনের চেষ্টা ভালো হয় নাই।

ভাবীর সাথে ঘনিষ্ঠতা মানেই যৌনতা হবে এমন কোন বিষয় নাই। ভাবীর ভেতরের কান্না লেখক শুনতে পান নাই। কারণ ভেতের প্রবেশের বিষয়ে তার অনাগ্রহ এই উপন্যাস জুইড়াই আছে। ছোট বোন নিশার সাথে কায়সারের সম্পর্কটাও বিকশিত না। বরং স্তব্ধ মনে হইছে।

বাবার প্যারালাইজড হওয়া শরীর পুরা পরিবারেই ভর করছে। কায়সারও প্যারালাইজড। সে লিখতে পারে না। মানতে পারে না, খালি বুঝার চেষ্টা করে। সম্পর্ক নিয়া লিখবে বইলা শুরু করলেও কায়সার আসলে নিজেরে নিয়া লিখছে।

এক পাক্ষিক সম্পর্ক তৈরি হইছে। বন্ধুদের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হওয়া, তার নানা সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রেমগুলা নিয়াও এতো সংশয় কায়সারের যে শেষমেষ সে একাই থাকে। এখানেও মাহমুদুল হকের ভুত ভর করছে বইলা সন্দেহ হয়। লেখক বলতেছেন-সব সম্পর্ককেই মানুষ কোনো-না-কোনো নাম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। সম্পর্কের বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাস নেই তার, নেই আস্থাও, কিংবা বহুমাত্রিক সম্পর্কের বিষয়টি সে বোঝেই না।

ফলে একটি নাম না দিলে সে অস্বস্তিতে ভোগে, অশান্তিতে ভোগে। কিন্তু যখনই একটি সম্পর্কের নাম দেয়া হয় তখনই তাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়, সেই সম্পর্কে নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। সম্পর্ক হয়ে পড়ে স্থির, বদ্ধ। অথচ সম্পর্ক বিষয়টিই পরিবর্তনশীল, বিবর্তনশীল। এক জায়গার দাঁড়িয়ে থাকার জিনিস নয় এটা।

সম্পর্ক ক্রমাগত তার ধরন পাল্টায়, তার স্বভাব পাল্টায়- যদি না পাল্টায় তবে তা পরিণত হয় অভ্যাসে। সম্পর্কের সঙ্গে অভ্যাসের পার্থক্যটা এখানেই। সম্পর্ক বিবর্তনশীল, পরিবর্তনকামী, নতুন মাত্রা যোগের সম্ভাবনাপূর্ণ; আর অভ্যাস স্থির, পরিবর্তনহীন, একঘেঁয়েমিপূর্ণ। সম্পর্ক বিষয়ে এমন ভাবনার সমস্যা হইলো তাতে জীবন থাকে না। জীবন বরংচ সম্পর্করে নিজের কইরা নেয়ার চেষ্টায় রপ্ত থাকে অথবা জীবন আসলে সম্পর্কের জটিলতা তৈরি কইরা মানুষের বাঁইচা থাকনের উপলক্ষ্য খুঁজে আনে।

যেমন এখানে কায়সার তার জীবনের এতো জটিলতা এতোগুলো সম্পর্কের ভাঙ্গন গড়ন দূরত্ব আবার কাছে আসা এসব নিয়াই বাঁইচা আছে। এগুলোই তার লেখার বিষয়। এছাড়া উপন্যাস তৈরি হয় না। সম্পর্ক বিষয়ক নিশ্চয়তা, নির্দিষ্টতা বিরক্ত তৈরি করে। কিন্তু সম্পর্কসমূহের পাঠ একপাক্ষিক বইলা তাতে নানা বাঁক আর পরিবর্তন কায়সারের আড়াল হয়।

ফলে যে সম্পর্করে তিনি অভ্যাস বলতেছেন তা আসলে বৈচিত্রহীন একঘেয়ে নির্বিষ কায়সারের পর্যবেক্ষণ। বিচিত্রতা মানুষ না খালি নেচারেরই স্বভাব। যেমন কায়সার লেখক বইলা তার দেখার আরেকটা চোখ জাগে। এখানে সেই চোখরে অন্ধ বলার ব্যাখ্যা কোনটাই যুতসই হয় নাই। লেখক অথবা পুরুষ হিসাবে কায়সাররে অন্ধ মনে হয় নাই।

এক চোখা বলা যাইতে পারে। উপন্যাসের নাম হিসেবে অন্ধ জাদুকর যে দ্যোতনা তৈরি করে পাঠ শেষে তা আর থাকে না। কিছু চরিত্র যত্ন পাইতে পারতো। একজন কায়সারের ভাবী। কায়সারের মাও।

মাকে স্মৃতিকথনে জড়ানোতে যে সমস্যা হইছে তা হইলো মা পূর্ণাঙ্গ হন নাই। কাজলা দিদির মরার ঘটনা আধপেটা হইছে। এমন একটা জটিল সম্পর্কের খোঁড়ল সামনে আসলেও তা অন্ধকারই রয়া গেছে। কায়সারের সাথে কয়েকজন নারীর সম্পর্কের মাঝে প্রেম ছিল নাকি ওই যে নামহীন সম্পর্ক ছিল তা বুঝা যায় নাই। কি বলবো? ওকে নিয়ে আসলেই কিছু বলার নেই আমার।

আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি-ও আমার কে! এবার সে ঘোরগ্রস্থ, বলতে থাকে- ওই যে একটা কবিতার লাইন আছে না- 'তুমি মোর আঁখিপাতে চিরদিন জমে থাকা জল'- হয়তো মৃন্ময়ীও আমার কাছে তাই। এটা দূর্বলতা, অথবা দ্বিধাগ্রস্ততা। মৃন্ময়ী কে নিয়া এতো লম্বা ঘটনার বর্ণনা শেষ পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস হওয়ার পেছনে যুতসই কারণ পাওয়া গেল না। প্রশ্ন জাগে কায়সারের দূর্বলতাটা আসলে কার। ফলে কাহিনীর বিচারে জমে নাই এই উপন্যাস।

তাছাড়া লেখক নিজে সওয়ার হওয়াতে বিশ্লেষণ করতে গিয়াও এইটা ওইটা ঝামেলা আছে। বিভিন্ন লেখকের উদ্ধৃতি উপস্থাপন খাপছাড়া না হইলেও একেবারে কোটেশন তুইলা দেয়াটা পাঠকের জন্য সমস্যার হইতে পারে। উপন্যাসটা আসলে কি নিয়া আগাইছে তা মাঝে মাঝে বুঝা যায় না। শুরুটা দুর্বল হইছে। শুরুতে লেখক যা বলতে চাইছেন তা আরো গভীর এবং গম্ভীর হইতে পারতো।

লেখক লিখছেন-এমনি একটি লক্ষ্যহীন-আদর্শহীন-নীতিহীন-স্বপ্নবিহীন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা বেড়ে উঠেছি। কোথাও ছিলো না কিছু আশাবাদী হবার মতো, কোথাও এমন কিছু ছিলো না যাকে অবলম্বন করে একজন তরুণ জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারে। এমন একটি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাদের কৈশোর ও তারুণ্য কাটে, তারা ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কোথাও কোনোকিছুর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয় না। আমাদের সময়টি আসলে সম্পর্কহীনতার সময়। এই সময়ের মানুষগুলো কোথাও সম্পর্কিত নয়, আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে থাকে অবিশ্বাস, আমাদের প্রেমগুলো তুচ্ছ কারণে ভেঙে যায়, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে- এমনকি পরিবার থেকেও- আমরা একটি নিরাপদ দূরত্ব রচনা করে চলি।

যেন পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি কার্যকর ভাষা নির্মাণের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি আমরা। কীভাবে প্রেম হবে আমাদের, হবে বন্ধুত্ব? এই প্রশ্ন থেকে বের না হতে পারার ব্যার্থতা আছে উপন্যাসে। লেখক যে বিষয়টার গুরুত্ব দিছেন গোটা উপন্যাসে , যে আকাঙ্ক্ষার তা থেকে পাঠকসুদ্ধা বের হয়ে আসার মানসিক শক্তি কায়সারের নাই। নাকি লেখকের। বিভ্রান্ত হইতে হয়।

শেষে কায়সারের মদ খায়া মাতলামির অংশটুকুও মাহমুদুল হকের সাটির জাহাজ উপন্যাসের জয়নালরে মনে পইড়া যায়। তবে এই উপন্যাসের সফলতা তার চিন্তায় আর বক্তব্যে। আকাঙ্ক্ষায়। যাকে বলে টোন, টোনটা খুব চমৎকার। তবে আমার কাছে উপন্যাসটারে আধপেটা মনে হইছে।

লেখককে ধন্যবাদ কালি ও কলম পুরষ্কারের জন্য। আশা করি আরো বিষদ কোন বিশ্লেষণ করতে পারবো এই উপন্যাস নিয়ে। পড়তে হইলে ক্লিক করেন-

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।