নেতৃত্বের বিবর্তন ও আগামী দিনের রাজনীতি
ফকির ইলিয়াস
=======================================
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক, সামাজিক জীবন প্রক্রিয়ায় একটি স্থবিরতার ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার, যা জনজীবনের জন্য একটি সঙ্কটের সৃষ্টি করছে। এ নিয়ে বিরোধীদল ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে। বিরোধীদল বিএনপি বলছে, সরকার নাকি বিচার বিভাগকেও কুক্ষিগত করার ফন্দিফিকির আটছে। এদিকে জয়েশ-ই-মোহাম্মদ নামে একটি পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের অন্যতম হোতা রেজোয়ানসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা বাংলাদেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে তৎপর ছিল কিংবা আছে।
খালেদা জিয়ার অফিসের সামনে বোমা নিক্ষেপের ঘটনা নতুন তথ্যচিত্রে মোড় নিয়েছে। ঘটনাস্থল থেকেই ছাত্রদলের জনৈক নেতা প্রদীপ সাহাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তার ভাষ্য অনুযায়ী শোভন নামে আরেকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ শোভন বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের পুত্র 'পবন'-এর বন্ধু।
শোভনের বক্তব্য অনুযায়ী পবনই এ ঘটনার মূল কারিগর। সে নাকি একটা সিনক্রিয়েট করার জন্য এ বোমা হামলার আয়োজন করেছিল! একটি দলের মহাসচিবের পুত্রের এমন আচরণ কি প্রমাণ করে না দলটি মূলত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি সঙ্কট সৃষ্টির জন্যই তৎপর রয়েছে?
বিএনপির নেতাপুত্রদের এমন আত্মঘাতী কর্মকান্ড নতুন নয়। এর আগে বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা তানভীর আহমদ সিদ্দীকির পুত্র দলের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। তার এ বক্তব্যের পর তানভীর আহমদ সিদ্দীকিকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এখন তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়।
খন্দকার দেলোয়ারের জন্যও এমন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে কি না তা সময়ই বলে দেবে। তবে বিএনপি যে অসুর শক্তি লালন করে, এ ঘটনা তা প্রমাণ করেছে।
সরকার খালেদা জিয়ার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মামলা পুনরুজ্জীবিত করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল। তা আবার স্থগিত হয়েছে। একটি কথা ওয়ান-ইলেভেনের পর খুব স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে, উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক মামলা ধোপে টিকে থাকতে পারে না।
বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, তাদের অন্তরীণ করেও তাদের আটকে রাখা যায়নি। বরং মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। বাংলাদেশে চাইলেই তারেক-কোকোর আধিপত্যকে পুরোপুরি উপড়ে ফেলা যাবে না। বরং কারণে-অকারণে বিভিন্ন বিতর্ক তৈরি করা হবে মাত্র। যা ইতোমধ্যেই দেশে শুরু হয়েছে।
তার অর্থ এই নয় যে, অপরাধের বিচার করা যাবে না। বিচার অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি না দেখিয়ে সুষ্ঠু বিচারের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার দিকেই এগোতে হবে সরকারকে।
বাংলাদেশে তারেক-কোকোর ত্রাস-রাজত্বের কোমর ভেঙে দিয়েছে ওয়ান-ইলেভেন। ওয়ান-ইলেভেন এটাই প্রমাণ করেছে রাজনীতিকরা রাজনীতি করবেন; কিন্তু কোন অবৈধ আধিপত্য কিংবা দীর্ঘমেয়াদি দুঃশাসনের পরিকল্পনা বাংলার মানুষ মেনে নেবে না।
রাষ্ট্রের মানুষের পক্ষে, রাষ্ট্রসত্তার পক্ষেই সেদিন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা যৌথভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার মতে, এর খুবই প্রয়োজন ছিল। তা না হলে দেশে 'হাওয়া ভবনের' পেশিশক্তি চিরস্থায়ী রূপ নেয়ার গোড়াপত্তন হতো।
দুই
প্রায় একই ভাবনায় আমি ভাবিত ছিলাম সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনের শেষকালেও। দীর্ঘ ৯ বছরেরও বেশি সময় এরশাদের শাসনে পিষ্ট মানুষের কথা ভেবে আমার বারবার মনে হতো- এ জগদ্দল পাথরকে বাংলার বুক থেকে কীভাবে সরানো যাবে? কে সরাবে?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও সম্ভব করেছিল বাংলাদেশের মানুষ।
হাওয়া ভবনের দুঃশাসনের পতন ঘটাতেও এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। পথ খোলা ছিল দুটি। ব্যাপক রক্তপাত অথবা জোরপূর্বক ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক খারিজ করা। জে. মইন উ আহমেদের নেতৃত্বে দ্বিতীয় কাজটি সাধিত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতি মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ঠিক একই সময়ে চরম দুর্নীতিবাজ কিছু চক্রকে চিহ্নিতকরণ, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল বাংলাদেশে।
কিন্তু অবস্থাটি ঠিকমতো সামাল দিতে পারেননি সে সময়ের নেপথ্য নায়করা। ফলে জাল ছিঁড়ে রাঘববোয়ালরা বেরিয়ে আসতে পেরেছিল খুব সহজে।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে একটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষণীয়, শেখ হাসিনাপুত্র সজীব আহমেদ ওয়াজেদ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। রংপুর আওয়ামী লীগ তাদের বর্ধিত সভায় তাকে সদস্যপদ দিয়ে দলে স্বাগত জানিয়েছে। এ ঘটনার পর বিএনপিপন্থি কিছু সাংবাদিক এটা বলে বেড়াচ্ছেন, তারেক রহমানের পথ অনুসরণ করে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ রাজনীতিতে এসেছেন।
এটা বলার একটা নেপথ্য উদ্দেশ্য আছে আর সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, রাজনীতিতে তারেক রহমান সিনিয়র (যেহেতু তিনি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন!) তা প্রমাণ করা। মনে রাখা উচিত, প্রকৃত রাজনীতি আর রাজনীতিকের কর্মকান্ড, প্রজ্ঞা, মেধা, মনন দিয়েই বিবেচিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বয়স মাত্র ৪৮ বছর।
সজীব ওয়াজেদ বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম সমন্বয় করে বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার আগমনী সংবাদ তাই জাতির জন্য আনন্দের কথা তো বটেই।
অন্যদিকে রাজনৈতিক কারণেই হোক তারেক রহমানকেও ইংল্যান্ডে রেখে নতুনভাবে প্রস্তুত করে যাচ্ছেন তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মাঝে পারিবারিক রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের যে প্রতিযোগিতা তা আপাতত মেনেই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশের আগামীর রাজনীতি।
গোটা বিশ্বেই নতুন ধ্যান-ধারণা চেতনার রাজনীতি প্রসারমান। এগিয়ে যাচ্ছে প্রজন্মের ভাবনাও। তাই রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি খেলার আগে প্রতিপক্ষের আগামী দিনের কৌশল নিয়েও ভেবে দেখা খুবই জরুরি।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দল পরিচালনার ভুল থেকে প্রকৃত রাজনীতিকরা শিক্ষা নেন। তারেক রহমান তার ভুল কতটা বুঝতে পেরেছেন, তা সময়েই প্রমাণিত হবে। তবে তার অনুসারীরা তাকে যে দেবত্বের আসনে বসাতে চাইছেন তাতে অনুমান করা খুবই সহজ তারা তাদের অতীত ঘৃণ্য কর্মগুলো সম্পর্কে মোটেই অনুতপ্ত নন।
রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিবর্তন প্রয়োজন। কারণ তা না হলে জাতি এগিয়ে যেতে পারে না।
তবে মনে রাখতে হবে দমন-পীড়ন কিংবা মিথ্যা অজুহাতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নীতি ক্রমেই ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে এবং জনগণ সব চালাকি ধরতে পারে।
এটা খুবই পরিতাপের কথা বাংলাদেশে সব শাসকগোষ্ঠীই প্রতিপক্ষকে দমাতে যতটা ব্যস্ত, জনগণের সমস্যা সমাধানে ততটা মনোযোগী নয়। প্রায় চার দশকের সমান বয়সী বাংলাদেশে তা মোটেই কাম্য নয়। আজ ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে সামরিক শাসকের শাসনকে অবৈধ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় এসে আবার যে পরিবর্তন করবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
এদেশের মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কাজটিকেই প্রধানত গুরুত্ব দিতে হবে।
কারণ প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের ভোট কেউ ছিনতাই করতে পারে না, সে উদাহরণ আমরা সুসভ্য, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রতি বছরই দেখছি। মানুষকে অশিক্ষিত করে রাখার যে বনেদি পরিকল্পনা, তার ভিতে আঘাত করতে এ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতেই হবে।
নিউইয়র্ক, ৩ মার্চ ২০১০
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ৫ মার্চ ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।