আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিড়ম্বনা



বিড়ম্বনা টাকা দিবার কথা ছিল জানুয়ারির তেইশ তারিখে, ঘোষণাটাও দেওয়া হইয়াছে অনেক আগেই, কিন্তু তেইশ তারিখের একদিন আগে জানা গেল নির্ধারিত দিনটি শুক্রবার; দিনমজুর ব্যাতিত আর সবার কর্মক্ষেত্র বন্ধ। সুতরাং সেদিন টাকা আদান-প্রদান করা গেল না এবং নূতন তারিখ নির্ধারিত হইল পঁচিশে জানুয়ারি। আমি দিনমজুর নই আবার অন্যকোন প্রকারের উপার্জনকারীও নই, ছাত্র মানুষ; আয় না থাকিলেও ব্যায়টা কখনো স্থগিত হয় না। তেইশ তারিখে টাকা প্রপ্তির যে কথা ছিল তাহা বৃত্তি বাবদ। ইহাও এক প্রকার আয় এবং তাহা কোন কোন খাতে ব্যায় করিব তাহার রূপরেখা কয়েকদিন পূর্বেই ডিজাইন করিয়া রাখিয়াছি।

যে প্রতিষ্ঠান হইতে বৃত্তির টাকা প্রদান করা হইয়া থাকে তাহার কর্মকর্তাদের সময় জ্ঞান অতিশয় উঁচু মাত্রার নহে। সুতরাং নির্দিষ্ট দিনটিতে একটু দেরি করিয়াই ঘুম হইতে উঠিলাম। সাড়ে দশটা বাজিয়াছে তবুও সূর্য ওঠে নাই। আমি শীতবস্ত্র পরিধান করিয়া বাহির হইলাম। বৃত্তি এই এলাকা হইতে আমি একাই পাই নাই, পাশের গ্রামের অন্য একজনও পাইয়াছে।

আগের সন্ধ্যাতেই তাহার সহিত কথা হইয়াছে যে আমরা একইসঙ্গে টাকা লইতে যাইব। গতদিনের কথা ভুলিয়াছে ভাবিয়া তাহাকে ফোন করিতেই বলিল,‘‘ ভাই আপনি বাসস্ট্যান্ডে গিয়া দাঁড়ান আমি এক্ষুণি আসছি। ’’ আমি বাসস্ট্যান্ডে গিয়া অনেক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিলাম কিন্তু উহার আগমন ঘটিল না। আমি আবার ফোন করিতেই বলিল,‘স্যরি ভাই আমার দেরি হবে, আপনি চলে যান। ’ যে দেরি করিতে চায় তাহাকে পীড়াপীড়ি করা অনুচিত।

আমার দেরি করা সম্ভব নহে, অনেক কাজ পড়িয়া আছে, নেগেটিভ হইতে ছবি ওয়াশ করিতে হইবে, ফোনের সীম সংক্রান্ত ব্যাপারে ফোন অফিসে যাইতে হইবে, হাসপাতালে চর্মরোগের ডাক্তারের কাছে যাইতে হইবে আর এক বান্ধবীর সহিত দেখা করিতে হইবে। সুতরাং আমাকে অধিক সময়জ্ঞানী সাজিতে হইল। যতগুলি কাজ সমাধা করিব বলিয়া স্থির করয়িাছি তাহার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হইতেছে বান্ধবীর সাক্ষাৎলাভ। শুধু সাক্ষাতই ঘটিবে না, আমার অন্যান্য কাজে সেদিন সে স্বশরীরে উপস্থিত থাকিবে বলিয়াও কিছুদিন আগে ফোনে কথা হইয়াছিল। কিন্ত এই প্রাপ্তিযোগ যে আমার জন্য অতিশয় ভাগ্যের ব্যাপার এবং অসম্ভব তাহা অনেক আগেই অনুমিত হইয়াছিল।

এইরকম মনে হইবার উপযুক্ত কারণও বিদ্যমান আছে। বেশ কয়েক মাস পূর্বে উক্ত বান্ধবীটির আমন্ত্রণে আমার এক বন্ধু সহযোগে তাহাদের কলেজে গিয়াছিলাম। এই কলেজে আমি একসময় পড়িয়াছি কিন্তু অতিথি হইয়া আসিয়া পূর্বেকার একই কক্ষ এবং উহার মধ্যস্থিত আসবাব নূতন উৎসাহে নিরীক্ষন করিতে লাগিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকিতে পারিলাম না, বান্ধবীর ব্যাবহারিক ক্লাস থাকায় আমাদের স্থান হইল মাঠে। আমি একখানা খবরের কাগজ কিনিয়া মাঠে বসিয়া পড়িতে লাগিলাম।

ক্ষাণিকবাদে পাশেই কিছু দূর্গন্ধ আবিষ্কার করিলাম। আমি ইহার তোয়াক্কা না করিয়া পড়িতেই থাকিলাম। কিন্তু দূর্গন্ধ যখন প্রকট আকার ধারণ করিল তখন আশেপাশে নিরীক্ষণ করিতেই একখানা মৃত চিকার অর্ধগলিত মৃতদেহ খুঁজিয়া পাইলাম। আমি তৎক্ষনাৎ ঐ স্থান ত্যাগ করিয়া অন্য একটি ছায়াযুক্ত স্থানে বসিলাম, কিন্ত ছায়া বেশিক্ষণ থাকিল না, রৌদ্র আসিয়া তাপ ছড়াইতে লাগিল। এইরকম হরেক ঝঞ্ছাটে আমার অনেক্ষণ সময় পার হইল।

আমি অবস্থা জানিবার জন্য বান্ধবীকে যতবারই ফোন করিলাম ততবারই সে বলিল,‘এই হয়েছে,যাচ্ছি, আর আধ ঘন্টার মত। ’ এইরূপে প্রায় চার ঘন্টা সময় অপেক্ষায় কাটিয়া গেল। এই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করিয়া চিত্ত যে সম্পূর্ণ ক্রোধান্ধ হইয়াছে তাহা নহে বরং আমি ভাবিতেছিলাম অমর প্রেমিক মজনুও যেইখানে তাঁহার প্রেমিকার জন্য এতক্ষণ এইভাবে সময় অপচয় করিবার প্রয়াস পায় নাই সেইখানে সামান্য বান্ধবীর জন্য এই ধৈর্য্য বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। যে বন্ধুটি আমার সহিত আসিয়াছিল ব্যাক্তিগত কাজে সে বেশিরভাগ সময়ই দূরে ছিল। ব্যাবহারিক ক্লাস শেষে তাহারা যখন বাহিরে আসিল তখন দুইটা বাজে।

এতক্ষণ বসিয়া থাকিয়া পূনর্বার বসিবার ইচ্ছা যদিও আমার ছিল না তবুও মনে বড়ই আশা ছিল, এই কলেজে থাকিতে কোন সহপাঠীনির সহিত কথাটি পর্যমত্ম বলিতে পারি নাই, কিন্তু আজ যাহার জন্য চার ঘন্টা অপেক্ষা করিলাম সে বান্ধবীসমেত অথবা ছাড়া অমত্মঃত চার মিনিট সময় ধরিয়া আড্ডা দিবে। সময় অবশ্য পরে চার মিনিটের বেশি ধরিয়াই পাইয়াছি; আড্ডারূপে নহে, অন্যরূপে। ভাগ্য যিনি নিয়ন্ত্রন করেন তিনি দেবতা নাকি দেবী জানিনা কিন্তু যাহাই হোন না কেন তাহার সহিত আমার শত্রতা আজন্মকাল, তিনি এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যে, আমি নিগৃহীত হই ঠিকই কিন্তু নিগৃহকারীকে দোষারোপ করিবার উপায় থাকে না। একে তো তখন ছিল রমজান মাস, বৈকালে মেয়ে মানুষের গৃহস্থালি কাজ বাড়িয়া যায় তাহার উপর সকাল হইতে ক্লাস করিয়া আবার আড্ডা দিবার ধৈর্য্য তাহাদের না থাকাই স্বাভাবিক। ক্লাস শেষে উহারা যখন হাঁটা দিল তখন আমরাও দুই বন্ধু তাহাদের সহিত মিলিত হইয়া নিঃশব্দে চলিতে লাগিলাম।

এই স্থলে আমার বেশভূষার কথা বলা দরকার; মুন্ডণকৃত মাথায় ছোট ছোট চুল গজাইয়াছে কিন্তু পাঁচড়াযুক্ত ত্বক সহজেই দৃশ্যমান, গাল বসিয়া মুখমন্ডল নবীন গাঁজাখোরের ন্যায় হইয়াছে আর হাড্ডিসার দেহ যে শার্ট দ্বারা আবৃত ছিল তাহা আবৃত বস্ত্তর চেয়ে অধিক উন্নত নহে, সর্বোপরি থালা হস্তে ঘুরিলে অতিশয় কৃপনও পয়সা দিয়া করুণা করিতে দ্বিধা করিত না। যাহাই হউক আমরা সরাসরি বাসস্ট্যান্ডে গেলাম না, কাহার জন্য যেন শার্ট কিনিবার দরকার হইলে মার্কেটে গেলাম। আমি এবং আমার বন্ধু তাহাদের সঙ্গ ত্যাগ করিলাম না এই জন্য যে বান্ধবী থাকিতে বলিয়াছিল তাই, আর তাহার সহপাঠীনিদের চোখ স্পষ্ট বলিতেছিল ‘আপদ পিছু ছাড়িতেছে না কেন’ কিন্তু মুখে কিছুই বলিল না। শার্ট পর্ব শেষ হইলে আমরা আসিলাম বাস ধরিতে। অনেক্ষণ অপেক্ষার পরও বাস যখন আসিল না তখন ভ্যান ঠিক করিতে হইল।

আমার মনে হইল কলেজ মাঠে বসিতে পারি নাই, এইবার ভ্যানে একসাথে বসিয়া দইয়ের সাধ ঘোলে মিটাইব। কিন্তু তাহাও ভাগ্যে জুটিল না। ভ্যানে ইতিমধ্যে পাঁচজন বসিয়াছে; এক ভ্যানে সর্বোচ্চ ছয় জনেরে জায়গা হইবে, শেষে বেশি হইলাম আমিই। ঐ মুহুর্তে আমার ‘সোনার তরী’ কবিতাটা মনে পড়িল। রবি ঠাকুর উহা যদি না লিখিতেন তবে ‘সোনার ভ্যান’ শিরোনামে ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে ভ্যান’ কবিতা রচনা আমার পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না।

শেষে বান্ধবীসমেত ভ্যান স্থান ত্যাগ করিল কিন্তু যে বন্ধু আমার সহিত আসিয়াছিল সে আমাকে ত্যাগ করিয়া তাহাদের সহযাত্রী হইল না। আমরাও একখানি ভ্যান ঠিক করিয়া তাহাদের ভ্যানের সঙ্গে সঙ্গে যাইবার জন্য ভ্যানওয়ালাকে বলিলাম, কিন্তু মাত্র দুইজনকে লইয়া যাইতে তিনি সম্মত হইলেন না । বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন আর যাত্রী জুটিল না তখন সকল বিরক্তি অবসান ঘটাইয়া আমাদের যাত্রা আরম্ভ হইল। আমাদের ভ্যান যখন বান্ধবীদের ভ্যানের কাছাকাছি আসিল তখন দেখিলাম যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করিতেছে আর অবসরে আমার সহিত যাহা কিছু কথা হইল তাহা নিত্যান্ত ভদ্রতাবশঃত। আমাদের ভ্যানওয়ালার ইচ্ছা ছিল ঐ ভ্যানের সাথে সাথেই গমন করা, আমিও অনুরূপ ইচ্ছাই পোষণ করিয়াছিলাম; কিন্তু হঠাৎ আমার ভীষণ জিদ চাপিল, দর্পিত বিধি আমাকে পদে পদে অপমান করিতেছে করুক কিন্তু অপমানের ষোলকলার যে স্বাদ, তাহাকে কোনক্রমেই তাহা পাইতে দিব না।

আমি পকেট হইতে মোবাইল বাহির করিয়া এক ফুপাতো বোনকে ফোন করিলাম আর ভ্যানওয়ালাকে বলিলাম ধীরে চালাইয়া আপনার সময় নষ্ট করিবার দরকার নাই, জোরে চালান। এতক্ষণে আমার কথা বলা আরম্ভ হইয়াছে এবং আমাদের ভ্যান উহাদের ভ্যানকে পাশ কাটাইয়া দ্রততর গতিতে চলিতে লাগিয়াছে যেন আমিই ইহাদের কাউকে পাত্তা দিলাম না। সেই দিন কলেজের মরা চীকার দূর্গন্ধ হইতে দুরে সরিবার বুদ্ধি আমার হইয়াছিল কিন্তু মরিচীকা আমার পিছু ছাড়িল না। অনেকদিন পরে জানিয়াছি যে আমাকে দেখিয়া সহৃদয়বান বান্ধবীর এমন মায়া হইয়াছে যে, তাহার ফোনবুকে আমার ফোন নম্বর উঠিবার সৌভাগ্য অর্জিত হইয়াছে। আরো একখানা গোপন কথা যাহা আমার কল্পনাতেও আসে নাই এই যে, আমি সেদিন যে চার ঘন্টা সময় ব্যায় করিয়াছি তাহা এমনি এমনিই নহে, বান্ধবীর এক সহপাঠীনির জন্য এরূপ ধৈর্য্য ধরিয়াছি।

সেই সহপাঠীনির বিবাহ হইয়াছে তবুও তাহার আশা ছাড়িতে পারি নাই বলিয়াই এমন অপকর্ম আমার দ্বারা সংঘটন সম্ভবপর হইয়াছে। হায়! স্বপ্নেও যাহার আশা কখনও করি নাই, তাহার ক্ষেত্রে আশা ছাড়িবার প্রশ্নটা আমার জন্য কতখানি পীড়াদায়ক এবং দূর্বোধ্য তাহা কেবল উপরওয়ালাই ভাল বুঝিবেন। তবে আমি যাহা হৃদয় দিয় অনুভব করিলাম তাহা হইতেছে এই যে, সেইদিন ষোলকলার স্বাদ বিধিকে পাইতে দিই নাই কিন্তু তদস্থলে সতেরকলার স্বাদ কখন যে তিনি আস্বাদন করিয়াছেন তাহা ঘুণাক্ষরেও টের পাই নাই। আমি মনে মনে বলিলাম, ‘‘ ঈশ্বর অত রঙ্গশালী হইও না, তোমার বিচার করিবার কেহ নাই বলিয়া আমাকে যেমন খুশি তেমন অপদস্থ করিতেছ, কর; কিন্তু যেদিন নজরুলের বিদ্রোহী হইব সেদিন আমিও তোমার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া উল্লাসে ফাটিয়া পড়িব। ’’ ইহার পরে বহুদিন গত হইয়াছে, উক্ত ঘটনা যখনই মনে পড়িত তখনই বুকের ভিতর খচ্খচ্ করিত।

আজও ঐরূপ যে ঘটিবে না তাহার কোন নিশ্চয়তা নাই, সুতরাং মনে করিলাম আমি যাচ্ছি আমার কাজে, বান্ধবীর সহিত দেখা হইলে সেটা হইবে উপরি পাওনা। আমি যখন বৃত্তি অফিসে পৌঁছাইলাম ততক্ষণে বৃত্তি প্রদান শুরু হইয়াছে। আমার সিরিয়াল নম্বর সবার শেষের দিকে, টাকাও পাইব শেষের দিকে। কিন্তু অতক্ষণ দেরি করিলে কোন কাজই হইবে না, বিশেষত যে বান্ধবীর সহিত দেখা করিতে যাইতেছি সে একটার মধ্যেই ক্লাস শেষ করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিবে। আমি স্থির করিলাম সিরিয়ালের তোয়াক্কা না করিয়া আগেই যোগাযোগ করি, কিন্তু সাহস হইল না।

অস্বস্তির মধ্যে অনেক্ষণ সময় পার করিলাম। অবশেষে ধৈর্যের বাঁধে যখন ফাটল দেখা দিল তখন সুযোগ আসিল। আমার এক পরিচিত বৃত্তিভোগীর নাম যখন ডাকিল তখন আমিও তাহার পিছু পিছু উঠিয়া গেলাম। নাম ডাকিল একজনের কিন্তু গেল দুইজন; দুইজনের হয়তো একই নাম কিন্তু একজনকে যথাস্থানে ফিরিয়া আসিয়া আবার অপেক্ষা করিতে হইবে, যে ফিরিয়া আসিবে তাহার বিড়ম্বনা কল্পনা করিয়া ঘরের আর সবাই মৃদু শোরগোল উৎপন্ন করিল। কিন্তু অনুরোধ গ্রাহ্য করিয়া আমাকেও যখন টাকা প্রদান করা হইল তখন সবাই নিশ্চুপ হইল; এ স্থলে কোন রঙ্গ হইল না।

অতঃপর টাকা পাইয়াই সঙ্গে সঙ্গে জেরা সদর অভিমুখে রওয়ানা হইলাম। আমি যখন পৌঁছিলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে বারোটা বাজিয়াছে। শুরুতেই ছবির কথা মনে পড়িল। যে দোকানে ভালভাবে ছবি ওয়াশ করা হয় সেইখানে গিয়া দেখিলাম দোকান সম্পূর্ণ খালি, সামনের দিকটা কতিপয় ব্যানার দ্বারা আচ্ছাদিত। ইহা যে কোনকালে ছবি ওয়াশের জায়গা ছিল তাহা তাহা শুধু ঘর মধ্যস্থিত দেয়ালসংযুক্ত শেল্ফ দ্বারা প্রতীয়মান হইতেছিল।

এককালে যাহা সুন্দর সুন্দর ছবি দ্বারা সুসজ্জিত ছিল আজ আমার বেলায় তাহা ধুলাবালিতে পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। আমি অন্য দোকান না খুঁজিয়া বান্ধবীর অবস্থান জানিবার জন্য ফোন করিতেই সে বলিল ‘নিউমার্কেটের সামনে দাঁড়াইয়া থাক। কিন্তু আমি যে নিউমার্কেট চিনিনা তাহার উল্লেখ করিতেই সে তাহা চিনিবার উপায় হিসাবে বলিল, ‘দেখ মার্কেটের প্রধান ফটকে এক নং গলি কথাটা লেখা আছে্। ’ অনেক্ষণ অন্বেষণ করিবার পর যখন এক নং গলি খুঁজিয়া পাইলাম তখন দেখিলাম যে আমি এতক্ষণ ধরিয়া নিউমার্কেটের পাশেই ঘুরপাক খাইতেছি। কিছুক্ষণবাদেই বান্ধবী তাহার সহপাঠীনি সহযোগে আবির্ভূত হইলে আবিষ্কার করিলাম দলে শুধু মেয়ে মানুষই নাই, এক প্রাক্তন বান্ধবীর নূতন বিবাহিত স্বামীও দলের শোভা বাড়াইতেছে।

দুলাভাইয়ের সাহচর্যে শ্যালিকার আপেক্ষিক মুল্য অন্যান্য সময়ের তুলনায় অত্যন্ত বেশি এবং যে শ্যালিকা বউয়ের বান্ধবী তাহাদের ভাব বর্ণনা করা সাধ্যাতীত ব্যাপার। শ্যালিকারূপী বান্ধবীর সহিত সৌভাগ্যের জোরে আমার কিছু কথা হইল এবং ক্ষাণিকবাদে যখন রেস্তোরায় চা খাইবার সম্ভাবনা প্রবল থেকে প্রবলতর হইতে লাগিল তখন বান্ধবীসহযোগে আপন কর্মসম্পাদনের আশা সম্পূর্ণ ত্যাগ করিয়া ছবি ওয়াশের দোকান সন্ধান করিতে পাশের গলিতে আমি দ্রুত মিশিয়া গেলাম। ক্ষাণিকক্ষণ চরকির মত এদিক সেদিক ঘুরিয়া অবশেষে একখানা উপযুক্ত দোকান খুঁজিয়া পাইলাম। কোন নেগেটিভ ওয়াশ করিতে হইবে তাহা দোকানদারকে ভালোমত বুঝাইয়া দিয়া হাসপাতালের উদ্দেশ্যে আমি রিক্সা ধরিলাম। হাসপাতালের বহির্বিভাগে ডাক্তারের কাছে যাইবার টিকিট বিক্রয় হয় যেইখানে, সেইখানে গিয়া দেখিলাম টিকেট বিক্রেতা নাই কিন্তু উহার পাশে লেখা ‘পুরুষদের টিকিট জরুরী বিভাগের সামনে দেওয়া হইতেছে।

’ নির্দেশমত জরুরী বিভাগের সামনে গিয়া দেখিলাম শূন্য টিকেট কাউন্টারে একখানা চেয়ারও নাই। জরুরী বিভাগের সবাই জরুরী কাজে অন্য কোথাও গিয়াছে ভাবিয়া আমি আবার পূর্বের স্থানে আসিয়া কর্তৃপক্ষের এক লোককে ব্যপারটা জিগ্যাসা করিতেই বলিল ‘টিকিট এখানেই দেয় তবে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। ’ আমি তাহার কথা শুনিয়া স্তব্ধ হইয়া গেলাম। ইস আর বিশ মিনিট আগে আসিলেই এই সর্বনাশ হইত না, রাগের চোটে মনে হইল মাথার চুল টানিয়া ছিঁড়ি; কিন্তু তাহা হইল না, কারন সময় নাই, আরো অনেক কাজ পড়িয়া আছে । হাসপাতাল হইতে ফোন অফিসে গিয়া আমি বলিলাম যে, প্রত্যেকদিন আমার ফোনে একটি করিয়া কৌতুক পাঠানো হয়, প্রত্যেকবারই অনেক টাকা কাটে; টাকা দিয়া কৌতুক খরিদ করিবার সামর্থ্য আমার নাই, পত্রিকায় ইহা বন্ধ করিবার যে নিয়ম দেয়া আছে সেই নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করিয়াছি কিন্তু তাহাতেও টাকা গচ্ছা গিয়াছে উপরন্তু কৌতুক প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সহিত যে আমি সংযুক্ত নই এই ডাহা মিথ্যা তথ্য দিয়া আমার কাছে বার্তা পাঠানো হইয়াছে কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে ইহার পরেও যথারীতি কৌতুক আসিতেছে এবং টাকা কাটিতেছে।

অভিযোগ শুনিয়া চাকমা মতন সেবাদানকারিনী একখানা ফোন নম্বর দিয়া বলিলেন, ‘‘এই নম্বরে ফোন করে নির্দেশমত কাজ করুন। ’’ আমি নম্বরটা লইলাম ঠিকই কিন্তু সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না। কোন একটি নম্বরে ফোন করিয়াই যদি তাবৎ সমস্যার সমাধান মেলে তবে তাহা পত্রিকার মাধ্যমে সবাইকে জানালেই হয়, গ্রাহকসেবা অফিস বানাইবার দরকার কি ? কৌতুক সবাই করিল, প্রকৃতিও যে আমার সহিত কৌতুক করিতেছে তখনও তাহা টের পাই নাই। হাসপাতালে কাজ হইল না, সীমের সমস্যাও মিটিল না; আমি গেলাম ছবির দোকানে। এক ঘন্টা পরে ছবি দিবার কথা, আমি একঘন্টা পরেই আসিয়াছি কিন্তু দোকানী বলিল আরো আধাঘন্টা পরে আসিতে।

কো কাজই ঠিকঠাক হইতেছে না, আমার মাথা বোঁবোঁ করিয়া ঘুরিতে লাগিল। যে বান্ধবীকে অনেক্ষণ আগে ছাড়িয়া আসিয়াছি, অবস্থান জানিবার জন্য তাহাকে আবার ফোন করিলে সে বলিল যে তাহারাও অনুরূপ সময় পরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হইবে। আমি আবার অপেক্ষা আরম্ভ করিলাম। আধাঘন্টা পরে আমার পছন্দের সেই ছবি আসিল। কিন্তু একি ! এতক্ষণ ধরিয়া পন্ডশ্রম করিয়া ভাবিলাম ছবি লইয়া খুশি মনে বাড়ি ফিরিয়া যাইব, হায় পোড়া কপাল আমার তাহাও হইল না।

আমি যে ছবি ওয়াশ করিতে দিয়াছি তাহাতে আমি ও আমার বড় বোন আছে, অনুরূপ একটা ছবি একই সারির বিপরীত প্রান্তে ছিল যেইখানে শুধু আমার স্থলে আমার এক বন্ধু আছে। নির্বোধ দোকানদার আমারটা না করিয়া তাহারটা করিয়াছে। এইরূপ যে ঘটিতে পারে তাহা আশংকা করিয়া দোকানীকে বারবার সাবধান করিয়া দিয়াছি কিন্তু ফল হইল একই। এইবার আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া গেল, কিন্ত প্রকৃত বীরেরা নাকি রাগের সময়ও সংযমী থাকে তাই আমি অসংযমী হইলাম না, তথাপিও দোকানদারকে রাগের কিয়দংশ দেখাইতে ছাড়িলাম না। সকল কর্ম সাঙ্গ হইয়াছে, এইবার গৃহে ফিরিয়া যাইবার পালা।

যাহার সঙ্গ পাব বলিয়া আশা করিয়াছিলাম তাহর সহিত ভালো মত কথাই হইল না। শেষকালে তাহার সহযাত্রী হইব এই ঢের। আমি আবার বান্ধবীকে ফোন করিলাম, ফোন ধরিতেই ‘ভটর ভটর’ শব্দ শুনিয়া ভাবিলাম ইহারা হয়তো টেম্পোর পাশে দাঁড়াইয়া আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। কিন্তু আমার নাম সম্বোধন করিয়া বান্ধবী যখন বলিল, ‘‘আমি টেম্পোতে যাচ্ছি, তুমি বাস ধরে চলে আসো’’, তখন আমার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। আমি ফোন রাখিয়া আকাশপানে তাকাতেই অনুভব করিলাম কেহ একজন অট্টহাস্যে বিপুলবেগে শরীর দোলাইতেছে।

আমিও হাসিলাম কারণ শেষে আমারও আশা ভঙ্গ হয় নাই। মনে অনেক বিরক্তি আসিলে গান শুনিতে হয়। পকেট হইতে ইয়ার ফোন বাহির করিয়া গান জুড়িতেই কানে ভাসিয়া আসিল ‘তুমি কি কেবলই ছবি, পটে লিখা নাম..........। ’ যে ছবি লইয়া এতকিছু হইল আবার সেই ছবিরই গান। ‘ধুর’ বলিয়া আমি গান বন্ধ করিলাম।

বাস আসিলে চলিয়া যাইব, কিন্তু বাস আসিল না, অপেক্ষাও শেষ হয় না। সামনে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত টেম্পু দুইজন যাত্রি লইয়া দাঁড়াইয়া আছে; আমি তাহাতে উঠিলাম না কারন অনেক দিন আগে ঐরূপ টেম্পু দূর্ঘটনায় আমার এক আত্মীয় মারাত্মক যখম হইয়াছিল এবং সেই থেকে তাহাতে চড়িবার কথা মনে হইলেই ভীষণ ভয় করিত। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করিতে করিতে একসময় চীরপ্রতিযোগী ফুফুত বোন মহুয়াকে ফোন করিলাম। ইহার সহিত আমার স্নায়ুযুদ্ধের খবর সর্বজনবিদিত। আজ এত হেনস্থার দিনে কেন জানি এই শত্রুর কথা গভীরভাবে মনে পড়িল।

আমি তাহাকে ফোন করিয়া বলিলাম ‘আজ দারুণ একটা দিন পার হল, তোকে মনে পড়ল তাই ফোন করলাম। ’ জবাবে প্রতিপক্ষ স্নায়ুযোদ্ধা আস্তে করিয়া বলিল ‘‘মনে তাহলে পড়ে ?’ সরল কথার খোঁচাটা কেবল আমিই অনুভব করিলাম, বলিলাম ‘ঠিক মনে পড়ে না তবে এই মুহুর্তে আমি এত আনন্দিত যে একখানা কোদাল পাইলে বিনা স্বার্থে পাতাল পর্যন্ত খুঁড়িবার সামর্থ রাখি। একসময় দাঁড়িয়ে থাকা সেই টেম্পুটি ভোঁ ভোঁ শব্দে চলিয়া গেল। বাস এতক্ষণেও আসিল না আবার সেই টেম্পুটিও চলিয়া গেল; আমি রাগে উঁহু বলিয়া পরের টেম্পুতে গিয়া বসিলাম। এমনিভাবে বিচিত্ররকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়া যখন আমি বাড়ি পৌছাইলাম তখন বৈকাল হইয়াছে।

অবশ্য যাত্রাপথের কিছু অংশ সেই বান্ধবীর সহিত একসাথে আসিয়াছি, সমগ্র দিনের পাওনা বলিতে ওইটুকুই। আমি ভাবিলাম যাহা হইল ভালই হইল, খারাপ অনেক কিছুই ঘটিলে ঘটিতে পারিত; কত যান দূর্ঘটনা তো ঘটে, আমিও তাহার শিকার হইতে পারিতাম কিন্তু হই নাই সেটা তো উপরওয়ালার মর্জির জোরেই। আমি পকেট হইতে মানি ব্যাগ বাহির করিয়া অবাক নয়নে দেখিলাম বৃত্তির টাকা অক্ষত আছে, হারাইয়া যায় নাই; আমার কানের কাছে তখন কে যেন ফিস্ফিস্ করয়িা বলিল,‘ আহ! শেষ ভালো যার সব ভালো তার, মাঝখানে যাই ঘটুক। আমি আকাশের দিকে তাকাইলাম, কিছুক্ষণ আগে অট্টহাস্যে শরীর দোলাইতেছিল যে, তাহাকে আর দেখিতে পাইলাম না; মাথা নামাইয়া ভূমিমুখী করিয়া আমিও মৃদু হাস্য করিলাম কিন্তু তাহাতে শরীর দুলিল না। এফ এইচ রিগ্যান ২৬.০১.০৯


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।