আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি প্রেমের গল্প



"বস! ইনি আমার মা। মা! ইনিই আমার বস। " তৌসিফ খুব গর্বভরে নিজের মায়ের সাথে তার বসের পরিচয় করিয়ে দিল। তার বস, কমেট ক্যামিক্যালসের বাংলাদেশ শাখার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইমতিয়াজ আহমেদ খুবই বিনীত স্বরে বললেন, "আপনিই তাহলে এই গর্বিত সন্তানের মা! আপনার সাথে দেখা করার সাধ আমার অনেক দিনের। আজকে পরিচিত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।

" বড় বড় কোম্পানির বড় সাহেবদের মুখের ভাষা প্রয়োজন অনুযায়ী অতিরিক্ত মিষ্টি আবার অতিরিক্ত তিক্ত হয়ে থাকে। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা সেটা বোঝা মুশকিল। তবু তাদের মিষ্টি কথা বিশ্বাস করতে বরই ভাল লাগে। স্বপ্নাও খুব বিনীত গলায় বললেন, "আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। " ইমতিয়াজ আহমেদ উত্ফুল্ল গলায় বললেন, "আমাদের দোয়ায় কি হবে? আপনার দোয়াই যথেষ্ট! আপনার ছেলের পেছনে আপনার দোয়া না থাকলে কি সে এত দ্রুত এত সফলতা পেত?" স্বপ্না বললেন, "সব সন্তানের সাথেই তাদের মা বাবার দোয়া থাকে।

আমার ছেলের সাথে তার মা বাবার দোয়ার পাশাপাশি তার নিজেরও কঠোর পরিশ্রম আর সততা মিশে আছে। তাই সে এত সফল হয়েছে। " ইমতিয়াজ মুগ্ধ স্বরে বললেন, "বিচক্ষন! আপনার থেকে এমন পারিবারিক শিক্ষা পেয়েছে বলেই আপনার ছেলে এমন সফল হয়েছে!" তারপর তিনি তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, "ইয়াংম্যান! তোমার মা একজন মহিয়সী নারী! মায়ের কথা মেনে চলবে। তাহলে জীবনেও পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। " তৌসিফ বিনীত ভাবে হাসলো।

মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সেও বসের সাথে একমত। আজকের এই ঘরোয়া পার্টি তার কাজে প্রমোশন পাওয়া উপলক্ষে। চার বছরের চাকরি জীবনে এটি তার চতুর্থ প্রমোশন। ইতিমধ্যে সে তার ডিপার্টমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে। কোম্পানির ইতিহাসে এত কম বয়সে ও এত দ্রুত এই পদে কারও দাখিল হওয়ার নজির এই প্রথম।

ছেলেটি বাবার মত পরিশ্রমী হতে শিখেছে। মানুষটিও অমানুষিক খাটুনি খাটতে পারতেন। পেশায় ছিলেন স্কুল মাস্টার। সকাল আটটা থেকে দুটা পর্যন্ত স্কুল শেষে আবার বিকাল চারটা থেকে স্টুডেন্ট পড়াতে বেরোতেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা এগারোটা।

আফসোস! পরিশ্রমের প্রতিদান দেখে যেতে পারেননি। অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা আসতে আসতেই তিনি বিদায় নিয়েছেন। ছেলের সফলতা উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে আজকে তিনি থাকতে পারলে কতই না খুশি হতেন! সবার সাথে বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে কথা বলতেন। ছোটখাট বিষয় নিয়েই তাঁর গর্বের সীমা ছিল না। যেমন সংসার জীবনের প্রথম দিকে, যখন তাঁদের আর্থিক অবস্থা একদম তলানীতে, ঈদ উপলক্ষে তাঁরা কোন নতুন জামাকাপড় কিনতেন না।

পুরনো কোন শার্ট-প্যান্ট লন্ড্রি করে বাইরে বেড়াতে যেতেন। এক ঈদে স্বপ্না নিজের হাতে বানিয়ে তাকে একটা শার্ট উপহার দিয়েছিলেন। হালকা গোলাপী রংয়ের শার্ট পেয়ে লোকটির আনন্দ ও বিস্ময় ছিল দেখার মত! জীবনে কারো কাছ থেকে উপহার না পেয়ে অভ্যস্ত তাঁর স্বামী বারবার চোখ বড় বড় করে বলছিলেন, "তুমি কবে শার্ট বানানো শিখলে? এত সুন্দর শার্ট তুমি কি করে বানালে? বিউটিফুল হয়েছে!" কথায় কথায় 'বিউটিফুল হয়েছে' বলাটা ছিল তাঁর একটা মুদ্রাদোষ। শার্টটির মোটেও ভাল সেলাই ছিল না। বোগলের দিকটাতে একটু টাইট হয়ে গিয়েছিল।

তাতে তাঁর আনন্দের বিন্দুমাত্র কমতি নেই। তিনি বিপুল উত্সাহে সেই টাইট শার্ট পড়ে শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। পরিচিত যার সাথেই তাঁর দেখা হয়েছে, তিনি বলেছেন, "আমার স্ত্রী নিজ হাতে বানিয়ে দিয়েছে। বুকপকেটে ফুলের সেলাইয়ের কাজটাও তারই করা। হাতের কাজ দেখেছেন? বিউটিফুল হয়েছে না?" আজকে ছেলের পার্টিতে তিনি কি বলতেন? গর্বভরে সবার কাছে ছেলের সুনাম করে বেড়াতেন।

"জানেন ভাইসাহেব। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার আগে আগে ছেলের টাইফয়েড হয়ে গেল। জ্বরে একদম উথাল পাথাল অবস্থা! বিছানা ছেড়ে নড়তে পারেনা এমন অবস্থা! এমন সময়ে পরীক্ষার দিন সকালে সে জেদ ধরলো সে পরীক্ষা দিতে যাবে। আমি ভাবি, 'কয় কি আমার পোলা!' আমরা যতই বুঝাই, তার একটাই জেদ, সে যাবেই। কি আর করার।

ছেলেকে কোলে বসিয়ে রিকশায় করে নিয়ে গেলাম পরীক্ষা কেন্দ্রে। ছেলে পরীক্ষা দেয়, আর আমি বাইরে বসে দোয়া কালাম পড়ি! পরীক্ষা শেষে ছেলে মলিন মুখে বেরিয়ে আসলো। আমি বললাম, 'বৃত্তি পাওয়াটা বড় কথা না। অংশ গ্রহণই বড় কথা! ইনশাল্লাহ, জীবনে আরও অনেক বৃত্তি পরীক্ষা দেয়া যাবে। ' বৃত্তির রেজাল্ট বেরোলো।

আমার ছেলেটা বৃত্তি পেল না। পাবে কি করে? টাইফয়েড নিয়ে কেউ বৃত্তি পরীক্ষা দিলে পাশ করতে পারে? জীবন কি সিনেমা নাকি যে নায়ক কিছু না পড়েই সবসময়ে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হবে? হাহাহা! আমার ছেলে বৃত্তি না পাওয়ায় কান্না করেনি। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম ওর মাথায় কিছু একটা চলছে। ক্লাস এইটে উঠে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল। আর এসএসসিতে করলো স্ট্যান্ড! পুরো বোর্ডে দ্বিতীয়! বুঝুন অবস্থা! স্টোরিটা বিউটিফুল না? গল্পটি শ্রোতার কাছে বিউটিফুল লাগুক কি না লাগুক, লোকটির বলার উত্সাহেই তিনি 'হ্যা' বলতে বাধ্য হতেন।

তৌসিফ এসে এক ফাঁকে মাকে বলল, "মা! একটু আসবে?" স্বপ্না স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরলেন। ছেলে মাকে নিয়ে আড়ালে সরে গেল। স্বপ্না পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, "কিরে? কিছু বলবি?" সে কাচুমাচু মুখ করে বলল, "মা! তোমার কি আর কোন ভাল শাড়ি নেই?" স্বপ্না চোখ কপালে তুলে বললেন, "হঠাৎ শাড়ির প্রশ্ন উঠলো কেন?" তৌসিফ অভিযোগ করলো, "আজকে আমার অফিসের সব বড় বড় অফিসাররা এসেছেন। অথচ তুমি এই পুরনো মলীন শাড়িটা পড়ে আছো!" স্বপ্না বললেন, "কেন? এই শাড়িতে দোষের কি দেখলি?" "এটা অনেক পুরনো আর খুবই শস্তা শাড়ি। এটাই এর দোষ।

" স্বপ্না আহত গলায় বললেন, "তোদের কাছে কি সবকিছু পয়সা দিয়েই তোলা হয়?" তৌসিফ বলল, "হতে পারে এই শাড়ির সাথে তোমার অনেক ইমোশন জড়িত। কিন্তু সেই ইমোশনের কথা শাড়িতে ছাপা নেই। কাজেই আমার বসেরা দেখছেন আমার মা একটি পুরনো শস্তা শাড়ি পড়ে আছেন। এইদিকে আমার বউ পড়ে আছে পঞ্চাশ হাজার টাকার জামদানী! তাদের সবার ধারনা হবে আমি আমার বেতনের পুরো টাকা বউর পেছনে খরচ করি। মাকে ফকিরনির মত রাখি।

" স্বপ্না মৃদু হাসলেন। "এই বয়সে কি আমাকে ঝলমলে পোশাকে মানাবে? লোকে হাসাহাসি করবে তো!" "হাসলে হাসুক। যে আমার মাকে নিয়ে হাসবে, আমি তার দাঁত ভেঙ্গে দিব। তুমি এখনই গিয়ে শাড়ি পাল্টাও। " "হঠাৎ শাড়ি পাল্টালে লোকের চোখে প্রশ্ন জাগবে না?" "কেউ প্রশ্ন করলে বলবে শাড়িতে মাংসের বাটি উল্টে পড়েছে।

এখন তর্ক বাদ রেখে যাও তো!" তৌসিফ অতিথিদের কাছে ফিরে গেল। স্বপ্না নিজের ঘরে চলে এলেন। আলমারি খুললেন। আলমারী ভর্তি শাড়ি। দামী দামী শাড়ি।

তাঁর ছেলে তৌসিফ চাকরী পাবার পড়ে প্রতি মাসের বেতনের টাকা দিয়ে মায়ের জন্য একটা করে শাড়ি কিনে আনে। ছেলেকে তিনি প্রতিবারই নিষেধ করেন। তিনি বুড়ো মানুষ। এত এত নতুন শাড়ি দিয়ে কি করবেন? কিন্তু ছেলে বড় হয়ে গেলে কি আর মায়ের বাধ্য থাকে? মাঝে মাঝে কিছু কিছু অবাধ্যতাও সুখের অনুভূতি দেয়। ছেলের মনে একটি ঘটনা গেঁথে আছে।

এক ঈদের আগে সে জেদ ধরলো তাকে একটি নতুন জুতা কিনে দিতে হবে। তার একটিই জুতা ছিল। সেটা পড়েই স্কুলে যেত, সেটা পড়েই দাওয়াতে। বিশেষ বিশেষ দিন উপলক্ষে সেটাকে কালি করে চকচকে বানানো হত। ওর জন্য সাধারনত এক দুই সাইজ বড় জুতা কেনা হত।

বাড়ন্ত শরীর। সঠিক মাপের জুতা কিনলে বছর ঘুরার আগেই ছোট হয়ে যায়। একটু বড় দেখে কিনলে আরামসে দুতিন বছর কেটে যায়। কিন্তু বড় মাপের জুতা পড়ে আসার জন্য স্কুলের ছেলেরা যে ওকে ক্ষ্যাপাত, সে কথাটি ছেলে কখনও মুখ ফুটে বলেনি। তৌসিফের বাবা ঈদের আগে আগে যথারীতি ছেলের জুতা কালী করিয়ে এনেছেন।

সবসময়ে কালো কালী করানো হয়। এবার বুদ্ধি করে চকলেট রং করিয়েছেন। বাড়িতে ঢুকেই বিপুল উৎসাহে ছেলেকে কাছে ডেকে বললেন, "এই যে দেখো! বাবা তোমার জন্য কি এনেছে!" তারপর খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে খবরের কাগজের মোড়ক সরিয়ে জুতা বের করলেন। জুতাটি দেখে চেনাই যায়না। মনে হয় অন্য আরেক জোড়া।

জুতার চেয়ে বাবার চোখ বেশী চকচক করছে। "বিউটিফুল লাগছে না?" কিন্তু ছেলের মুখ ভোতা। সে থমথমে গলায় বলল, "আমার এবার নতুন জুতা লাগবে। " বাবা ছেলেকে বোঝাতে বললেন, "এই যে দেখো! এইটাওতো নতুনের মতই। " ছেলে ঘার বাঁকিয়ে বলল, "আমার নতুন জুতা লাগবে।

" যতই বোঝানো হোক, ছেলে অনড়। তার এই ঈদে নতুন জুতা লাগবেই। শেষমেষ স্বপ্না মায়ের চিরায়ত ভূমিকা পালন করলেন। নিজের শাড়ি কেনার জন্য জমানো টাকা স্বামীর হাতে দিয়ে বললেন, "শাড়ি পরের ঈদে কেনা যাবে। " এক সময়ে তৌসিফ বড় হলো।

বুঝতে শিখলো যে তার সেই ঈদের জুতার মূল্য ছিল মায়ের শাড়ি। হয়তো অপরাধ বোধ জাগলো মনে। সে জ্বালা জুড়াতেই এখন মায়ের আলমারীকে শাড়ির দোকান বানিয়ে ফেলেছে। স্বপ্না ধীরে ধীরে একটির পর একটি শাড়িতে হাত বুলাতে লাগলেন। ঢাকাই জামদানী, কলকাতার বেনারসী, রাজশাহী সিল্ক, টাঙ্গাইলের কাতান....একটির চেয়ে একটি দামী ও সুন্দর শাড়ি।

অথচ কোনটিই তাঁর পরনের শাড়ির সমকক্ষ নয়। স্বপ্নার জন্ম ঢাকা শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন জাঁদরেল ব্যারিস্টার। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র বোন সে। সবার আদরের মধ্যমনি।

সবার তাঁকে নিয়ে অনেক আশা। বাবা তার জন্য ইংল্যান্ড প্রবাসী এক পাত্রের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন। ছেলে ম্যানচেস্টারে থাকে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। প্রচুর নাকি টাকা পয়সা।

দেখতেও নাকি রাজার কুমার। বিয়ে নিয়ে প্রচুর উৎসাহের সাথে আয়োজন চলতে লাগলো। দলে দলে আত্মীয় গ্রাম থেকে তাদের শহরের বাড়িতে ভিড় করতে লাগলো। বয়ষ্কা আত্মিয়ারা তার গাল টিপে খুব রসাত্মক রসিকতা করে। লজ্জায় তার গাল লাল হয়।

আবার শুনতে ভালও লাগে। রাতের বেলা ঘুম আসেনা। অজানা উত্তেজনায় বুক দুরু দুরু করে কাঁপে। আর মাত্র দুসপ্তাহ পরে বিয়ে। কেমন হবে নতুন জীবন? এবং নতুন জীবনের সঙ্গী? সে তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসবে।

লোকটাও তাকে ভালবাসবে তো? বিয়ের যখন সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, ঠিক তখনই এমন সুন্দর সাজানো ভবিষ্যত সুখের সংসার ফেলে, কি কারনে কেবল মাত্র একটি চিঠি পড়ে, একই পাড়ার শুধুমাত্র মুখ-পরিচয়ের এক অতি সাধারন দর্শন আর অতি গরীব এক ছেলের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, সে রহস্যের পেছনের যুক্তি এখনও কেউ জানে না। একে কি ক্ষনিকের আবেগ বলা ঠিক হবে? প্রেম? নাকি ছেলেমানুষী? নাকি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সময়ে নেয়া একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত? না। একে আর যাই বলা হোক, 'ভুল' কখনই বলা যাবেনা। তাঁর স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না- এটা ঠিক। তবে লোকটির সৌন্দর্য্যদর্শনের চোখ ছিল প্রশংসা করার মত।

তাঁকে নিয়ে দেশ বিদেশে ঘুরতে পারেননি বটে, তবে শান্ত দীঘির জলে পূর্নিমার চাঁদের প্রতিবিম্ব তাঁর স্বামীই তাঁকে প্রথম দেখান। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি ঝরা দুপুরে তাঁরা দুজন সেই দীঘির জলে গা ডুবিয়ে ভেসে থাকতেন। উপর থেকে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, আর তাঁদের শুধু মুখ পানির উপরে ভাসছে। এসব স্বর্গীয় সুখ কি টাকা দিয়ে কেনা যায়? একসাথে পথ চলতে চলতে তাঁরা ভালবাসার জন্ম দিয়েছেন। একই থালে ভাত খেয়েছেন।

কেউ কোথাও ভাল কিছু খেলে অপরের জন্য সেটা নিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর যা কিছু ভাল আছে, সব দুজনে মিলে ভাগাভাগি করে ভোগ করেছেন। বিপদ যখন এসে দুয়ারে কড়া নেড়েছে, দুজনে একসাথে তার মোকাবিলা করেছেন। আমেরিকা প্রবাসী ছেলেটির সাথে যদি তাঁর বিয়ে হতো, তাহলে কি এভাবে জীবনকে উপলব্ধি করার সুযোগ তাঁর হতো? হয়তোবা হ্যা, হয়তোবা না। স্বপ্না যখন তাঁর সদ্য বিবাহিত স্বামীর হাতধরে চিটাগংগামী ট্রেনের বগিতে উঠছেন, তখন তাঁর হাতের ব্যাগে আটপৌড়ে কিছু জামাকাপড়।

স্বামীর পকেটে হাওয়া খেলছে। ট্রেনে চড়ার টিকিট পর্যন্ত তাঁরা কাটেননি। "শুন্য থেকে শুরু" বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। স্বপ্নারা শুরু করেছেন 'নেগেটিভ' থেকে। সম্পূর্ন অচেনা এক শহরে তাঁদের বাসর রাতে মাথার উপরে ছাদ পর্যন্ত ছিল না।

সেখান থেকে ধীরে ধীরে একটির পর একটি ইট সাজিয়ে তাঁরা সংসার গড়েছেন। তাঁদের ভালবাসাই ছিল সে ইমারতের গাঁথুনি। তাঁদের ইমারত যথেস্ট মজবুত ছিল। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর অর্জিত টাকায় সংসারের খরচ শেষে জমানো প্রতিটা পাই পয়সার সাথে সাথে তাদের ভালবাসাও জমা হয়েছে। একসময়ে সঞ্চয়ের টাকাও খরচের ফলে কমেছে।

কিন্তু ভালবাসা? সেটা যতই খরচ হয়েছে, ততগুনে বেড়েছে। বিয়ের তৃতীয় বছরের কথা। ততদিনে তাঁর স্বামী একটি ছোটখাট চাকরির ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। ছোট একটি ঘর ভাড়া করে তাঁরা পেতেছেন টোনাটুনির সংসার। একদিন স্বামীস্ত্রীতে মিলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

হঠাৎ স্বপ্নার চোখ পড়লো একটি শাড়ির দোকানের বাইরে রাখা একটি পুতুলের গায়ে জড়ানো শাড়ির উপর। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে স্বামীও বুঝে ফেললেন স্ত্রীর পছন্দের ব্যাপারটা। তিনি প্রস্তাব করলেন, "ভিতরে গিয়ে দেখবে?" স্বপ্না দুপাশে মাথা নাড়েন। "গায়ে চড়াতেতো পয়সা লাগবে না। এসো, গায়ে জড়িয়ে দেখবে।

" তারা দুজনে দোকানের ভিতরে ঢুকে গেলেন। দোকানদাররা খুব অবহেলার সাথে তাঁদের সস্তা সস্তা শাড়ি দেখাতে লাগলো। ওদেরই বা দোষ দিয়ে লাভ কি? তাঁদের গায়ের পোশাকই বলে দেয় তাঁরা কোন পণ্যের ক্রেতা। তাছাড়া দীর্ঘ দিনের অভাব চেহারা থেকে সব আভিজাত্য ধুয়ে ফেলে দিয়েছে সেই কবেই! স্বপ্না অপমান গায়ে মাখলেন না। খুব আগ্রহ নিয়ে শাড়ি দেখলেন।

গায়েও আঁচল চড়ালেন। দরদাম করার সাহস করলেন না। এক সময়ে মন উদাস করে দোকান থেকে বেরিয়েও এলেন। এর ঠিক সাত মাস পর একদিন তাঁর স্বামী তাঁর হাতে একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, "এটা তোমার জন্য। " তিনি প্যাকেট খুলে বিস্মিত।

"এ শাড়ি তুমি কোথায় পেলে?" "ছিনতাই করে এনেছি। এক মহিলাকে দেখলাম এই শাড়ি পড়ে শিশুপার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে। আমি সাথে সাথে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছুরি ঠেকিয়ে বললাম, 'এখনই শাড়ি খুলে আমার হাতে দাও! নো হাঙ্কিপাঙ্কি!' মহিলাও প্রাণের ভয়ে শাড়ি খুলে আমার হাতে দিয়ে দিল। বেচারী শুধু ব্লাউজ পেটিকোট পড়া অবস্থায় বাসায় ফিরে গিয়েছে। " স্বামীর রসবোধের সাথে স্বপ্না পরিচিত।

"এত টাকা তুমি কোথায় পেলে?" "উফ! মেয়েদের এই এক যন্ত্রণা! একটা উপহার হাতে পেলে কোথায় খুশি হবে, তা না। হাজারটা প্রশ্ন! কোথায় পেলে? কিভাবে পেলে? কেন পেলে? আরে বাবা! এত জেনে কি করবে? সুন্দর শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে এসে একবার মিষ্টি করে হাসোই না। তোমাকে দেখতে বিউটিফুল লাগুক আর আমারও উপহার স্বার্থক হোক!" স্বপ্না শাড়ি পাল্টাতে অন্য ঘরে যাচ্ছিলেন। স্বামী বেশ রোমান্টিক গলায় বললেন, "এখানেই পাল্টাতে পারো। লজ্জার কিছু নেই।

আমি তোমার বিবাহিত স্বামী। রেজিস্ট্রি করা কাবিন আছে। প্রমান চাইলে দেখাতে পারি!" স্বপ্না লজ্জায় লাল হয়ে বলেছিলেন, "অসভ্য!" তাঁর স্বামী মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম খুবই ছোটখাট একটা স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। স্কুলের বেতনে তাঁদের চলতো না। তাঁকে টিউশ্যনিও করতে হতো।

স্ত্রীর শাড়ি পছন্দের কথা জানতে পেরে তিনি ঠিক করলেন যে করেই হোক টাকা জমিয়ে স্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে এই শাড়িই কিনবেন। তিনি বাস ও রিকশায় চড়া বন্ধ করে দিলেন। হেঁটে কাজে যেতেন, হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। এতে দুচার টাকা করে প্রতিদিন জমা হতে লাগলো। শাড়িটা কিনতে তাই তাঁর সাত মাস সময় লেগেছে।

তাঁর ছেলের কাছে হয়তো এটি নিছকই একটি পুরনো মলিন শাড়ি। কিন্তু তিনি জানেন, এ শাড়ির প্রতিটা সূতোয়, প্রতিটা ভাজে ভাজে তাঁর স্বামীর ভালবাসা মিশে আছে। আলমারী ভর্তি হাজার হাজার টাকা দামের শাড়ি। কিন্তু তাঁর গায়ের এই শাড়ির মূল্যের সমকক্ষ হতে পারে এমন কোন শাড়ি কি আছে? ভালবাসার মূল্য নির্ধারণ করার সাধ্য কার আছে? ওঘর থেকে বিদেশী গানের উচ্চ সুর ভেসে আসছে। সেই সাথে সুখী নারী পুরুষের কলরব।

পার্টি জমে উঠেছে। তাঁর ছেলের সাফল্য উদযাপন হচ্ছে। তাঁর ছেলে এখন জীবনে অনেক সফল। দোকানের সবচেয়ে দামী শাড়িটিও সে তার স্ত্রীর জন্য অনায়াসে কিনে আনতে পারে। সেজন্য তাকে সাতমাসের বাস ভাড়া জমাতে হয়না।

কিন্তু তাঁর কেনা কোন শাড়ি কি তার বাবার কেনা শাড়িটির চেয়ে মূল্যবান হতে পারবে? স্বপ্না শাড়ির আঁচলে হাত বুলান। তাঁর স্বামীও যেন আজ বহুদিন পর আবার তাঁর হাতে হাত রাখলেন। আবেগে স্বপ্নার চোখে পানি আসে। তিনি এবার আর অশ্রুকে বয়ে যেতে বাঁধা দিলেন না।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.