.................।
১৯৮৯ সালের দিকের কথা,খুব ছোট তখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি। প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ নামক এক ফুটবল অণুষ্ঠান হচ্ছে। বিটিভি এই খেলা আবার সরাসরি সম্প্রচার করছে। বাংলাদেশের প্রধান খেলোয়াড়দের দুইটি ভাগে ফেলে দিয়ে বাংলাদেশ লাল এবং বাংলাদেশ সবুজ নামে দুইটি দল গঠন করা হয়েছে।
সেমিফাইনালে আবার সেই লাল-সবুজ মুখামুখি। ছোটবেলায় সবুজ থেকে লাল রংকে বেশি ভাল লাগতো বলে লাল দলের সার্পোটার ছিলাম। বিশ বছর পরে আজও মনে পড়ে ১০ নম্বর জার্সিধারী লালদলের বাট্রুএকটি খেলোয়াড় ডি বক্সের বাহির থেকে ড্রিবলিং করে ভিতরে ঢুকে হালকা শটে সবুজ দলের গোলকিপারকে পরাস্ত করে এবং লাল দলকে ফাইনালে তুলে। ফাইনালে মুখামুখি হয় লাল দল বনাম দক্ষিণ কোরিয়া,যতদূর মনে পড়ে জাতীয় দল ছিল না কোরিয়ার। তবে তখনকার সবেধন নীলমণি ইত্তেফাক পত্রিকাতে কোরিয়ান দলটিকে ফেভারিট হিসেবে ধরেছিল।
ফাইনালের আগে ঢাকা স্টেডিয়ামের ভিতরের দেয়ালে শোভা পাচ্ছিল ভক্তদের লেখা দেয়ালিকা "বাংলার ম্যারাডোনা সাব্বির" যতদূর মনে পড়ে আরও লেখা ছিল "রুড গুলিত আসলাম,রুমি ইত্যাদি"। অথার্ৎ ম্যারাডোনা কেবল একজন কিন্তু গুলিত অনেক। মনে পড়ল সবুজ দলের বিপক্ষে বাট্রু প্লেয়ারের পারফরম্যন্সের কথা যার গায়ে শোভা পাচ্ছিল ১০ নং জার্সি, সেই ছিল সাব্বির। মামাদের মুখে তখন শুনতাম ম্যারাডোনা নামক এক বাট্রু প্লেয়ারের জয়গান যে কিনা একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে। প্রেসিডেন্ট কাপের ফাইনাল মূল ম্যাচ ১-১ গোলে ড্র।
বাংলাদেশের গোলটি করল আসলাম কিন্তু বলটি বানিয়ে দিল কর্ণার থেকে ঐ ১০নং প্লেয়ার। পরে ছোট মামা বলেছিল, কোরিয়ার কোচ নাকি সাব্বিরের মাপা কর্ণারটিকে কোরিয়ান ডিফেন্সে সাপের ছোবলের সাথে তুলনা করেছিল। ট্রাইবেকারে বাংলাদেশের জয়। যতদূর মনে পড়ে ট্রাইবেকারে বাংলাদেশের জয়সূচক গোলটি এসেছিল ১০নং প্লেয়ারের শর্ট থেকে। সেই থেকে শুরু সাব্বির প্রেম এবং সেই থেকে শুরু মেইন স্ট্রাইকার না পছন্দ করে ভালবাসা দলের সবথেকে ক্রিয়েটিভ প্লেয়ারকে যে বল বানিয়ে দিবে এবং যে মাঝে-মাঝে গোল দিবে।
১৯৯০ এ বাসায় রাখা ইত্তেফাক পেপারে দেখলাম সাব্বির মোহামেডানে খেলে, এতএব বাসার সবাই আবাহনী সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আমি ঘোর মোহামেডান হওয়া শুরু করলাম। বাসায় আবাহনী-মোহামেডানের খেলা হলে সবাই আবাহনী এবং আমি থাকতাম মোহামেডান এবং খুব ছোট থাকায় নানু অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোহামেডান সমর্থন করত-আমার কারণে। উল্লেখ্য মোহামেডানেও ম্যাজিক্যাল ১০ নং জার্সি সাব্বিরের দখলে। ছোটবেলার ফুটবল ফ্যান্টাসি থেকে এখনও মনে পড়ে সাব্বির কখনো ড্রিবলিং করে খেলত ,কখনো বা কর্ণার ফ্রিকিক থেকে নকিব,আসলাম,রহিমভদের জন্য বলের যোগান দিত(শুধু আবাহনীর সাথে খেলাই দেখতে পারতাম )। ১৯৯২-৯৩ দিকে পরিচয় হয় আমার মত আরেক ফুটবল খোরের সাথে, নাম তার রাসেল।
আমাদের স্কুলে অন্য সেকশনে পড়ত। সেও আমার মত উগ্র মোহামেডানের সমর্থক। সাব্বির বলতেই অজ্বান। মনে পড়ে কোন এক ডামফা কাপের ফাইনাল ম্যাচের কথা,যে ম্যাচে মোহামেডান জিতেছিল ৩-২ গোলে, দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময় খেলা ২-১ এ পিছিয়ে ছিল মোহামেডান। মোহামেডানের প্রথম গোলটির যোগানদাতা ছিল সাব্বির, দ্বিতীয়ার্ধের খেলা প্রায় শেষের দিকে।
ডি বক্সের কিছু দূরে ছুটে চলা সাব্বিরকে ফেলে দিল আবাহনী। বহুদূর থেকে কায়সার হামিদের গোলার মত শট আবাহনীর জালে। খেলা ২-২। বেরসিকের মত বিটিভির নিউজ এসে হানা দিল(অথবা আমার বেরসিক বাপজান কান ধরে আমায় পড়ার টেবিলে বসাতে নিয়ে গিয়েছিল)। যাহোক রাতের ১০ টায় বিটিভির এংরাজি নিউজ দেখে বুঝলাম এক্সট্রা টাইমে সাব্বিরের কর্ণার থেকে নকিবের ভলিতে মোহামেডান জিতেছে।
পরের দিন পেপার জুড়ে কায়সার বন্দনা, কিন্তু চির ১০নং প্রেমিক আমার কাছে মনে হয়েছে সারা মাঠ জুড়ে খেলেছে ১০নং জার্সিধারী প্লেয়ার সাব্বির, স্পেশালি পিছিয়ে পড়ার পর মোহামেডানের সব আক্রমণের কারিগর ছিল ঐ বাট্রু ম্যারাডোনা সাইজ প্লেয়ার। ১৯৯৩ এর দিকে মোহামেডান দাপটের সাথে লীগ জিতল সাব্বির এবং উঠতি আরেক প্লেমেকার আরমানের ক্রীড়া নৈপূন্য। ঐসময়কার স্বর্বস্ব পত্রিকা ইত্তেফাক হিসাব করে দেখিয়েছিল সারা সিজনে মোহামেডানের সব আক্রমণের কারিগর সাব্বির-আরমান জুটি। ১৯৯৪ সালে ম্যাক্সিমাম স্টার প্লেয়ার আবাহনী মোহামেডানের জার্সি ছেড়ে মোহামেডানে নাম লেখাল। সিজনের শুরু থেকে সাব্বিরও একটু ইঞ্জুরড।
মোহামেডান কেমন জানি ঠেলাগাড়ির মত ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে চলছিল। পনের বছর পরে আজও মনে পড়ে পিডব্লিউডির সাথে একটা লীগ ম্যাচে গোল লাইনের একটু আগে ভয়াবহ ফাউলে মাঠের বাহিরে পুরাপুরি ইঞ্জুরি নিয়ে চলে যাওয়া। পরের দিনের পত্রিকায় আশংকা করেছিল, সাব্বির হয়ত পুরো সিজনে আর খেলতে পারবে না। সেই সাথে পত্রিকা দিল মোহামেডান সমর্থকদের স্টোডিয়াম পাড়া জ্বালিয়ে দেওয়ার নিউজ। সেই সাথে ছবি ও দিল কিভাবে বিপক্ষ দলের গোলকিপার সাব্বিরকে ভয়াবহ ট্যাকলটি করে।
স্কুল শেষে সারাটি বিকাল নিজেদের খেলা বাদ দিয়ে বন্ধু রাসেলকে নিয়ে বসে ছিলাম মন খারাপ করে। সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে পেপারে ফাউল করার ছবিটি কেটে নিজের স্কুল ব্যাগে ভরে ফেললাম স্মৃতি হিসেবে(ছবিটি নেই কোথায় জানি হারিয়ে গিয়েছে)। চির অভিমানী আমি রাত্রিতে পেট খারাপ বলে রাতের খাবারও খেলাম না, কিন্তু অভিমানটা কার উপর ছিল বুঝতেই পারলাম না। পরের দিকে অবশ্যিই পত্রিকাগুলো আশংকা করেছিল,সাব্বির এই ইঞ্জুরির কারণে ফুটবলে আর সেইভাবে ফিরতে পারবে না। সর্বশেষে পত্রিকাওয়ালাদের আশংকাই সত্যি হল।
আমার শৈশব-কৈশরের বাংলাদেশের পারফেক্ট ১০ আর কখনো ফিরে আসে নাই। তারপর থেকে শুরু হল বাংলাদেশের ফুটবলে সাব্বির,রুমি,আরমান অথবা বিদেশী ঝুকভমাপের উইঙ্গার, রহিমভের সমতুল্য স্ট্রাইকারের বদলে লাডি বাবা লোলা,বোদে বাবা লালা নামের আবোল-তাবোল প্লেয়ারের রাজত্ব। ৪-৫ দিন আগে বাংলাদেশের জাতীয় দল কোরিয়ান একটা ক্লাবের খেলার রিপোর্টে লেখেছিল বাংলাদেশের দূর্বল জায়গা মিডফিল্ড। দূর্বল হবে না কেনইবা, আগে মেইন প্লেমেকার থাকত সাব্বির এবং উইংয়ে খেলত রুমি। এখন জাতীয় দলের অথবা মোহামেডান-আবাহনী খেলা দেখলে কেমন জানি লাগে।
ভুল পাশের ছড়াছড়ি, বলের উপরে নেই কোন কন্ট্রোল। নিজেদের মধ্যতো অন্ততঃ সুন্দর খেলা খেলতে পারে, সেটাও নেই। আজও মনে পরে,সেন্ট্রাল মিডফিল্ড অথবা পাশ্ব রেখা দিয়ে সাব্বিরের স্পীডি ড্রিবলিং। এখনও চোখে ভাসে জাতীয় দলের হয়ে কোন এক খেলায় বল দেওয়া নেওয়া করে ডি বক্সে বিপক্ষে দলের দুই জন ডিফেন্ডারের মধ্য দিয়ে ফাকায় দাঁড়ানো জাকিরকে পাশ এবং সেই থেকে গোল (বিপক্ষ দল মনে নেই)। মনে পড়ে,আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে পাড়ায় জুড়ে সাজ-সাজ উত্তেজনা।
হায়রে আমার সেই সোনালী মাখা শৈশব-কৈশরের দিনগুলো গেল কোথায়, হারিয়ে গেল কোথায় বাংলাদেশের ফুটবল। সালাউদ্দিন যতই চেস্টা করুক ফুটবল জাগাতে, দর্শক টানতে হলে তাকে অবশ্যিই কমপক্ষে হলেও সাব্বির মাপের কিছু পারফেক্ট ১০নং জার্সির প্লেয়ার বাহির করে আনতে হবে।
পরিশেষে,আরেকজন ১০নং খেলোয়াড়ের কথা না বললেই না। যার ক্রন্দন ৯০ এ আমার মত পিচ্চিদের কাঁদিয়েছে। তখন বিটিভি সোম অথবা মঙ্গলবারে সিরি-এ হাইলাইট দেখাত ৬ টার দিকে।
শীতকালে রাত বড় হওয়ার কারণে তখন বাসায় থাকতাম। চোখ সেটে থাকত টিভি পর্দায়। যদি হাইলাইটে আসে সেই বাট্রু ১০নং প্লেয়ার, যে গুটি গুটি পায়ে মাঠে নক্সীকাথা আকঁত,যে দলের কর্ণার থেকে ফ্রিকিক সব নিত। যে বল বানিয়ে দিত,যে দলের সেন্ট্রাল স্ট্রাইকারের লাড্ডু মার্কা ব্যথর্তায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ত এবং মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য গোল দিয়ে সেন্ট্রাল স্ট্রাইকারকে দেখিয়ে দিত গোল কিভাবে করতে হয়। ইয়েস, সেই প্লেয়ারটি ম্যারাডোনা।
ফুটবল বিশ্বে এই পর্যন্ত একটি মাত্র (জিদান ব্যতিত। ফ্রান্স মানে জিদান, জিদান মানে ফ্রান্স কিন্তু ক্লাব পর্যায়ে ওয়ান ম্যান শো ছিল না রিয়াল বা জুভেন্টাস)খেলোয়াড় যে নিজেকে রুপকথার নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে মিডিয়াম মানের আর্জেন্টিনা এবং ন্যাপোলিকে শীর্ষপর্যায়ে নিয়ে গিয়ে। ম্যারাডোনা পরবর্তীতে ব্যজ্জিও,টোট্রি,জিদান,রিভালদো,কাকা,রোনালদিনহো ১০ নং জার্সির পারফেক্ট ধারক-বাহক। তাই হয়তবা যে কোন খেলায় আমার চোখ খুজে ফিরে সেই ১০ নং জার্সিকে যে কিনা একটা মুভে খেলা পাল্টিয়ে দিবে(ব্যজ্জিও ৯৪), একটি ম্যাজিকাল পাশে খেলা ফিনিশ করে দিবে(স্বয়ং ম্যারাডোনা ৯০ ব্রাজিলের বিরুদ্ধে,৮৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে) অথবা বিপক্ষ দলের ডিফেন্স এফোড়-ওফোড় করে দিবে(জিদান ২০০৭ ব্রাজিলের বিরুদ্ধে,লাস্ট ইয়ারে ব্যার্নুবুতে মেসি রিয়ালের বিরুদ্ধে)। আবার সেই সাথে যখন দেখি কোন আবালের হাতে ১০নং জার্সি পড়েছে (যেমনঃ আর্সেনালের গ্যালাস) তখন মেজাজ পুরা বিলাই হয়ে যায়।
সর্বশেষে,আজ রাতে একটু পরে এল-ক্লাসিকো(রিয়াল বনাম বার্সা) শুরু হতে যাচ্ছে। ম্যারাডোনা,জিদান,রোনালদিনহোর উত্তরসুরী মেসি এখনও কনফার্ম না শুরু থেকে থাকবে কিনা ইঞ্জুরির কারণে,থাকুক আর না থাকুক আমি মনে প্রাণে চাইব সুন্দর ফুটবল তথা বার্সার জয় হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।