আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওয়ার্কার্স পার্টিকে কোথায় ‘ব্রেক থ্রু’ করতে হবে

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

ওয়ার্কার্স পার্টিকে কোথায় ‘ব্রেক থ্রু’ করতে হবে বিমল বিশ্বাস বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কংগ্রেসের কিছু আগে লেখাটি প্রকাশিত হবে। নতুন কথা’র পাঠকরা লেখাটি পড়লে হয়তোবা কিছু মাত্রায় কমিউনিস্ট আন্দোলনে লাভ হতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। আমরা যখন ’৬০-এর দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হই তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে মৌলিক মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণা বা উপলব্ধির জন্য পড়তে হতো মার্কসবাদের মৌলিক বইগুলো। মার্কসবাদী ও প্রগতিশীল সাহিত্যও পড়তে হতো।

কিছু মাত্রায় হলেও তার থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছিলাম বলেই কমিউনিস্ট আন্দোলনে এখনও টিকে আছি। কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন সৈনিক হিসেবে টিকে থাকতে চাই সারাজীবন। অতীতের শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে আজও যারা টিকে আছি তার কারণটি মার্কসবাদী দর্শনকে মানবমুক্তির শ্রেষ্ঠ দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছি বলে। শুধু জয়-পরাজয় বা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মার্কসবাদী পার্টি বা রাজনীতি নয়। বরং সামগ্রিক মানবমুক্তি জন্য এ রাজনীতি।

আন্দোলনে জয়-পরাজয়, ব্যর্থতা-সাফল্য সবই থাকতে পারে তার থেকে শিক্ষা নিতে হয় ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবার জন্য। কোন অবস্থাতেই মার্কসবাদবিরোধী অবস্থানে যাওয়া অথবা কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে সটকে পড়ার জন্য নয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেক খ্যাতিমান নেতা দলত্যাগ করে বুর্জোয়াদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ’৭০-এর দশক থেকে কমিউনিস্ট বা বামপন্থী আন্দোলনের প্রখ্যাত ছাত্রনেতাদের কয়েকজন ছাড়া কমিউনিস্ট আন্দোলনে, বাম আন্দোলনে বেশির ভাগই থাকেননি। এসবের অন্যতম প্রধান কারণ মার্কসবাদকে মানবমুক্তির শ্রেষ্ঠ দর্শন রাজনীতি-অর্থনীতি হিসেবে গ্রহণ করে তারা কমিউনিস্ট আন্দোলনে আসেননি।

যার পরিণতি ব্যক্তি স্বার্থে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের কাছে আত্মসমর্পণ। এর বড় অংশ শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রামের অগ্নি পরীক্ষা ও ধারাবাহিক লড়াইয়ে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে পারেনি। নেহায়েতই কমিউনিস্ট আন্দোলনের জয় পরাজয় বা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য এই ধারাবাহিক ও কষ্টকর সংগ্রামে টিকে থাকতে না পারার অন্যতম ভিত্তি মার্কসবাদী দর্শন সম্পর্কে ভুল ধারণা ও বিভ্রান্তি। কর্মকৌশলের ভ্রান্তির উৎসও মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি বা দুর্বলতা অথবা বড় ধরনের ভ্রান্তি। তাই সম্প্রতিককালে মার্কসবাদী কর্মী রিক্রুটের ক্ষেত্রে দর্শনগত অবস্থান বাদ দিয়ে যে কর্মী সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের দ্রুত মৌলিক মার্কসবাদী প্রশিক্ষণে দীক্ষিত শিক্ষিত করা জরুরি।

প্রশিক্ষণের দুটি দিক- একটি হচ্ছে তত্ত্বগত অন্যটি প্রয়োগগত। তাই যে কথাটি বলতে চাই তা হলো মার্কসবাদের মৌলিক শিক্ষা। বর্তমান মুহূর্তে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভিন্ন দেশের সৃজনশীল ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা এসব থেকে শিক্ষা জানা বোঝা আলোচনা করা জরুরি। কোন দেশের অভিজ্ঞতাকে যান্ত্রিক অনুকরণ অনুসরণের জন্য নয়। যা আজ ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ দ্রুত সংগ্রহ করা সম্ভব।

অন্যদিকে বিশ্বের নানামুখী পরিবর্তন হচ্ছে বাংলাদেশ তাই পৃথিবী থেকে কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাস্তব বিশ্লেষণ ও করণীয় নির্ধারণ করতে গেলে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর আন্দোলনেও নতুন পথে অগ্রসর হতে হবে। কিসে নতুন পথ? সে পথ কানসাটের পথ, শনির আখড়ার পথ, ফুলবাড়ী কয়লা আন্দোলনে অভিজ্ঞতার পথ। তাই তত্ত্বগত ও প্রয়োগগত প্রশিক্ষণকে বছরের পর বছর অবহেলা করে অনেক অপরাধ করে ফেলেছি। তাই এখানে প্রথমে নজর দেওয়া সময়ের দাবি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য ওয়ার্কার্স পার্টিকে সত্যিকার অর্থে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগ্যতর পার্টি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য।

দ্বিতীয় কাজটি হচ্ছে- বিদ্যমান শ্রেণী সংগ্রামসহ শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিমূলক কাজে পার্টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। একথার অর্থ হচ্ছে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কর্মীরা জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেয়া, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণের জাতীয় সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ে অংশ নেবার কাজটি কিছু মাত্রায় হলেও রপ্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে বড় ত্রুটি আমাদের পেয়ে বসেছে তাহলো অসামপ্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির লড়াই এগিয়ে নিতে গেলে উপরের লড়াইটি আমরা যথার্থভাবে করার চেষ্টা করছি কিন্তু এক্ষেত্রে ভুলে গেলে চলবে না সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদী শক্তিকে চূড়ান্ত-ভাবে পরাভূত করতে কৃষিপ্রধান এই বাংলাদেশে কৃষক খেতমজুরের শ্রেণী সংগ্রাম ও ঐ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তান যাদেরকে ধর্মের নামে দেশী-বিদেশী শক্তি অর্থের যোগান দিয়ে জঙ্গি সৃষ্টি করছে, সেই কৃষক-খেতমজুরদের মধ্যে শক্তিশালী ভিত গড়তেই হবে। ফলে বিশেষভাবে কৃষক খেতমজুরের আন্দোলন, শ্রমিকশ্রেণীসহ সকল দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও মধ্যবিত্ত জনগণকে জীবন-জীবিকার সংগ্রামে আমরা সামিল করতে না পারলে মূল লক্ষ্য অর্জন করা সহজ হবে না। কিন্তু ওয়ার্কার্স পার্টি যথাসময়ে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়ে তুলে বিএনপি-জামাত জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী শক্তিকে আন্দোলনে ও নির্বাচনে পরাজিত করেছে কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়কে নিশ্চিত করতে গেলে কৃষক খেতমজুরের ন্যায্য দাবির সংগ্রাম গড়ে তোলা আজ জরুরি কাজ।

তৃতীয় যে প্রশ্নটি তাহলো শ্রেণী গণসংগঠন হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর সর্বনিম্ন সংগঠন এবং সর্বোচ্চ সংগঠন হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি ওয়ার্কার্স পার্টি। এখানেই যতক্ষণ পর্যন্ত শ্রেণী গণসংগঠন গড়ে তোলার কাজকে গুরুত্ব না দেয়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন অংশের জনগণের বিদ্যমান শ্রেণীসংগ্রামে অংশ নেয়া ও নেতৃত্ব অর্জন অত সহজ ব্যাপার হবে না যা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। শ্রেণী গণসংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভ্রান্ত পথে জনগণের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য যে চেষ্টা হচ্ছে সেখানে সফলকাম হওয়া সম্ভব হবে না। একটি বক্তৃতা, বিবৃতি, একটি লড়াইয়ে অংশ নিয়ে নেতৃত্ব অর্জন করা যাবে না। তাই ধারাবাহিক শ্রেণী সংগ্রাম ও গণসংগ্রামের পথে পার্টিকে এগিয়ে নিতে হবে।

চতুর্থ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা প্রয়োজন বর্তমান শোষক শ্রেণীর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপরীতে শোষিত জনগণের বিকল্প শক্তি চিন্তা চেতনা ও কর্মে কিভাবে গড়ে তোলা যায় তার জন্য কমরেড অমল সেনের বিকল্প শক্তি পুস্তিকাটি গুরুত্ব সহকারে সকলের পড়া প্রয়োজন। এ কারণে যে পাল্টা রাজনৈতিক ক্ষমতা গড়ে তোলার পথ সোজা সাপটা পথ নয়। ধারাবাহিক সুনির্দিষ্ট শ্রেণীসংগ্রামের পথই হচ্ছে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার পথ। বুঝতে হবে যুগ যুগ ধরে শোষক শাসক শ্রেণীর এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি ঘটনায় শেখাচ্ছে কোন এক ব্যক্তি ত্রাতা হিসেবে জনগণের মুক্তি এনে দেবে। এটা বুর্জোয়া চিন্তার যথার্থ প্রকাশ।

এই চেতনার বিপরীতে আন্দোলন সংগঠন সংগ্রাম গড়ে তুলতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে জনগণকে যে কথা বলা প্রয়োজন তাহলো এই সমাজের কোন দাবি অথবা সমাজ ব্যবস্থাপাল্টাতে গেলে জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াই জনগণের পাল্টা শক্তি গড়ে তুলতে গেলে জনগণকেই তার লড়াই গড়ে তুলতে উদ্যোগী হতে হবে নেতৃত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলনে চিন্তাও প্রয়োগে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। পার্টি সংগঠন, পার্টি সভ্যপদ, দায়িত্ব কর্তব্য এ ব্যাপারেও প্রতি মুহূর্তে প্রশিক্ষণ জরুরি। উল্লিখিত বিষয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির বিকাশ অগ্রগতির স্বার্থে এখানে ব্রেক থ্রু করতে পারলে আরও যে সব সমস্যা কমিউনিস্ট আন্দোলনে রয়েছে- সেক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটানো সম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবজ্ঞা অবহেলা করে আর বেশিদূর এগোনো যাবে না।

নেতা-কর্মীদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী সকল কার্যকলাপের উৎস পেটি বুর্জোয়া আদর্শগত ভিত্তি। তার থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে ঐ সকল ভ্রান্তির ক্ষেত্রে ব্রেক থ্রু করতেই হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.