আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বড্ড অসময়ের উপলব্ধি!!

সভ্যতার সন্ধানে অলি গলি খুঁজে বেড়াই। মাঝে মাঝে কিছু সত্যিকারের সভ্য মানুষের দেখা মিলে, আর সভ্য মানুষের বেশে থাকা বেশিরভাগ মানুষই জানেনা, তারা কিভাবে সভ্য।

আয়নাটা ভালই। কিনতে বেশ দাম নিলেও ভাল কাজ দিচ্ছে। তিন মাস আগে অনেক দাম দিয়ে কেনা পরিচ্ছন্ন বাঁধানো আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে আশফাককে এ কথা মনে মনে স্বীকার করতেই হল।

কেননা সকালের স্নিগ্ধ আলোয় আয়নার ওপাশে তার যে প্রতিবিম্বটা দেখা যাচ্ছে তাতে তার গালের উপর বসে যাওয়া হাতের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে । আগের দিন যখন আশফাক ঘুমুতে গেল তখনো এ দাগটা ওখানটাতে ছিলনা। প্রকৃতি কত বিস্ময়কর খেয়াল খুশিতে ভরা এই ভেবে হাসি পেল আশফাকের। যদিও তার গালের ঐ দাগের নিচে কেমন যেন কটমট একটা ব্যাথা মস্তিষ্কের কোন একটা স্থানে কিছু একটা ক্রিয়া করে তাকে বাজে একটা অনুভূতি দিচ্ছে। মস্তিষ্ক এও জানান দিচ্ছে যে, বসে থাকা দাগটা যে হাত থেকে তৈরী হয়েছে তা সাধারন যে কোন পুরুষের হাতের চেয়ে অনেক নরম ছিল, সে হাতটা নিশ্চয় কোন নারীরই হবে।

ভেবে আবারও হাসি পেল আশফাকের। নরম হাত কি করে শক্ত ব্যাথা দিতে পারে এই সমীকরনটা মিলছেনা তার। এও আসলে প্রকৃতির একটা বিচিত্র খেয়াল হয়তো! বারোটার সময়টা আশফাকের ঘরে বসে থাকার সময় নয়। শুক্রবার আর ছুটির দিন বাদে প্রতিদিনই তাকে এ সময়টাতে একটা জরুরী কাজে বেরুতে হয়। চাকরী নেই, পড়াশুনাটাও তাকে দিয়ে খুব বেশি হয়ে উঠেনি, তারপরও সময়টা তার অনেক ব্যস্ততায় কাটাতে হয়।

মায়ের কাছ থেকে জোর করে কিছু টাকা নিয়ে সে বেশ কয়েকটা স্থান ডিজেল চালিত ডাবল ইন্জিন গাড়ির মত নাকের দুই ফুটা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পরিভ্রমন করে। বাসায় ফিরতে কখনো সন্ধ্যা হয়, আবার কখনো রাত। মাঝে মাঝে ফিরেও না। বাসায় আগে ফিরে এলে সে সবাইকে তটস্থ করে রাখে আর দেরীতে ফিরলেও তাদের জন্য দু:শ্চিন্তার খোরাক করে দেয়। আজও আশফাক বাইরে বেরিয়েছে।

বাসা থেকে বেরুতেই পেছন থেকে তার ইয়ারের দোস্ত ফারুক ডাক দিল, "আশফাক!! খাড়া। " -খাড়াইছিতো, তাড়াতাড়ি আয়, জরুরি কাম আছে। -জরুরী কাম মানে! তুই আইজও ওইহানে যাবি? -যামুনা মানে? কি কস? -কাইলকার কথা ভুইলা গেছস? -কাইলকা কি হইসে? -ক্যান সুইটির কতা মনে নাই তোর? এত তাড়াতাড়ি ভুইলা গেছস? -হ, মনে আছে, তো কি হইসে? -তুই সত্যিই কি আইজ ওইহানে যাবি? -হ, যামুই। ফারুককে নিয়ে আশফাক প্রতিদিনকার মত বালিকা বিদ্যালয় আর মহিলা কলেজগুলোর দিকে রুটিন ভ্রমনে এগুতে লাগল। রাস্তায় যেতে যেতে তাদের আরো অনেক দোস্ত জমে গেল।

ছোটখাট এই মিছিল চলতে লাগলো একটা বালিকা বিদ্যালয়ের দিকে। বিদ্যালয়ের ছুটির ঘন্টা বাজতে আর বেশি দেরী নাই। সুইটিদেরকে ভালবাসার বাক্য ছুড়ে দেয়ার সুযোগটা মিস করতে চায়না বলেই আশফাকের দল একটু জোরে পা চালাল। স্কুলে আশপাশের গলিগুলো তাদের খুব পছন্দের জায়গা। তাদের প্রতিদিনকার এসাইনমেন্ট এ স্থানগুলোতে কোন রকম বাধা ছাড়াই পরিপূর্নতা পায়।

স্কুল ছুটি হয়েছে দুঘন্টা হয়ে গেছে। ভয়মিশ্রিত সুশ্রাব্য সুললিত গালি খেতে খেতে আশফাকের দল টায়ার্ড হয়ে গেছে। ছোট্ট একটা দেয়ালে চড়ে হালকা আড্ডা চলছে এখন। ফারুক হঠাৎ আশফাককে জিজ্ঞেস করলো, "সুইটি কিন্তু আইজ স্কুলে আহেনাই, ওয় মনে অয় ডরাইছে। " -ডরাইলে ডরাকগা।

-কাইলকা কি তুই ব্যাথা পাইছস। ওর হাতডা যেমনে তোর গালের দিকে ফাল পাইড়া উঠছে, আমি তো ডরাইয়া গেছিলাম। চড় দিলে এত জোরে আওয়াজ অয় আগে জানতাম না। -আরে ধুর! ব্যাথা পামু ক্যা? ব্যটা, দুনিয়াতে যা দেহা যায় তা পুরাপুরি সত্য অয়না। সুইটির সামাইন্য থাপ্পড়ে কি আর আমি ব্যাথা পামু? কি কস না কস! আর আওয়াজ তো অ্যামনেই অইছে।

-তুই যাই কস, আমার কিনতু শরম লাগছেরে। আমার আইজকা আইতে ইচ্ছা করে নাই। কেমন শরম লাগতাছিল। এত মাইনষের সামনে তোরে থাপ্পড় দিল! কি শরমের কথা! -শরম কিয়ের! ধুর! এইসব কোন ঘটনাই না। মাইনষে দেখছে, তো কি অইসে? মনে কর কেউ দেহে নাই।

-মাইয়াডা আইজ আইলে কিন্তু আমি একডা দৌড় লাগাইতাম। -ওয় আর আইবোনা। -ওয় যদি কমপ্লেন করে, তহন কি অইব? -ধুর, কার কাছে কমপ্লেন দিব? কেউ কিচ্ছু কইব না আমগোরে। অন্যের উপকার করার লাইগা এখন আর একডা মানুষেরও সময় অয়না। আর যদি দেয়ও, দিব এলাকার বড় ভাইয়েগো কাছে, হ্যায়রা তো আমগো মতই আছিল আগে।

হ্যারা আমগোই বড় ভাই, আমগোরে কিছু কইবো না। কিছুক্ষন ভেবে ফারুক আশফাককে জিজ্ঞেস করলো, "আইচ্ছা ক তো, আমরা কামডা কি ঠিক করতাছি? হুদাহুদি টাইম নষ্ট করতাছি, আবার মাইয়াগুলারে ডর দেহাইতাছি। আল্লায় তো আমগো উপরে গজব ফালাইবোরে। " -কিয়ের আল্লা? মনে কর কুন আল্লা নাই। আল্লা থাকলে তো সব মজা শ্যাষ।

নামাজ কালাম পইড়া সিধা চলা লাগব। -আসলে তো আল্লা আছে। এত্ত বড় দুনিয়া কি অ্যামনে অইছে নি? কেউ না কেউ তো উপরে আছেই। আইজ হউক আর কাইল হউক, প‌্যাঁচে আমগোরে পড়তেই অইব। ============================================ অনেক বছর পর, আশফাক এখন বুড়ো মানুষ।

শরীরের কর্মক্ষমতা এখন প্রায় নেইই। তারপরও কষ্ট করে সে বাইরে বেরোয়। দিনে পাঁচবার, লক্ষ্য থাকে মসজিদ। পুরোনো স্মৃতি গুলো আনন্দ দেয় না তাকে, কষ্টই বাড়ায়। জীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল সময়টা কি বিচ্ছিরিই তার কেটেছে।

জীবনটা হয়তো আরো পরিপূর্ন হতো, যদি সে সময়টাকে কাজে লাগানো যেত। পৃথিবীকে কত কিছুই না তার দেয়ার ছিল, পৃথিবী থেকেও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। সব শেষ, এখন শুধু দু:খটাই বাকি আছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।