বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধ হতে হলে নির্বাচনী বছরে সহিংসতার পুরোনো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাই সংকট উত্তরণের পথটা অন্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষকেই খুঁজে নিতে হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শারমেন গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক বক্তৃতায় এ অভিমত দিয়েছেন। ‘সীমান্তবিহীন অংশীদারি: বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক’ শীর্ষক এই বক্তৃতার আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস—বিস)।
প্রায় ১৫ মিনিটের বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের গুরুত্ব, রানা প্লাজা ধস-পরবর্তী পরিস্থিতি ও মার্কিন অবস্থান, বাংলাদেশের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে মার্কিন পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা এবং বিস বোর্ড অব গভর্নরসের সভাপতি মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বক্তব্য দেন।
দ্বিতীয় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারি সংলাপে অংশ নিতে গত রোববার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন শারমেন। তিনি বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। আর স্বাগতিক দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক।
এ ছাড়া তিনি এ সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
এ ছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও হরতালের কারণে সময়সূচি পরিবর্তনে বাধ্য হওয়ায় ওই বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাতিল করা হয়েছে।
গতকাল সকালে ওয়েন্ডি শারমেন বাংলাদেশের শ্রমমান বিষয়ে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। দুই দিনের ব্যস্ত সফর শেষে গতকাল রাতে ঢাকা ছেড়ে গেছেন তিনি।
হরতালের ফাঁদে খালেদার বৈঠক: ওয়েন্ডি শারমেন ঢাকায় পা রেখেই জানতে পারেন, তাঁর এ সফরের সময় ঢাকায় হরতাল হচ্ছে।
এ খবর তাঁকে বিস্মিত করেছে। আর এ হরতালের কারণে বিরক্ত শারমেন শেষ পর্যন্ত বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল করেছেন।
বিসের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা শেষে ওয়েন্ডি শারমেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তাঁর দুই দিনের ঢাকা সফরের প্রথম দিনে হরতাল হওয়ায় তিনি বিস্মিত ও হতাশ হয়েছেন। এ হরতালকে কেন্দ্র করে সময়সূচি-সংক্রান্ত জটিলতার দরুন বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে তাঁর পরিকল্পিত সৌজন্য সাক্ষাৎটি বাতিল করা হয়েছে।
এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল গতকাল বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ‘ওরাই (মার্কিন প্রতিনিধিদল) বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিল। কিছু অসুবিধার কারণে আবার ওরাই বৈঠক বাতিল করেছে। তবে এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে নজিরবিহীন নয়। ’ ২০০৩ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে সময় বিরোধী দল হরতাল দিয়েছিল।
কলিন পাওয়েলও তখন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে বৈঠক করেননি।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মনে করেন, ওয়েন্ডি শারমেনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক বাতিল হওয়ায় বিএনপির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর তা কোনো প্রভাব ফেলবে না।
দলের দায়িত্বশীল একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এটি অবশ্যই দুঃখজনক ঘটনা। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপির ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষণ্ন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারির এ সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তাঁর সফরের সময় হরতাল এড়ানো যেত। তা করলে দলের জন্য ভালো হতো। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তি। তাদের সঙ্গে বিএনপির ভালো সম্পর্ক অবশ্যই দরকার।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ওয়েন্ডি শারমেনের সফরের সময় হরতাল না দিতে মার্কিন দূতাবাস বিএনপিকে অনুরোধ জানিয়েছিল।
এর আগে গত ৪ মার্চ ঢাকা সফররত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বৈঠকটি জামায়াতে ইসলামী আহূত হরতালের কারণে বাতিল হয়েছিল। ওই হরতালে সমর্থন দিয়েছিল বিএনপি। ওই সময় বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, হরতালের কারণে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল করা হয়েছে।
হরতাল আর সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ: গত দুই দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক সাফল্যের প্রশংসা করেন ওয়েন্ডি শারমেন। বিশেষ করে, শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস, নারীশিক্ষা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি এবং দ্বিতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাকশিল্প রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করেন তিনি।
এ ছাড়া ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হওয়াকে উল্লেখযোগ্য মনে করেন মার্কিন জ্যেষ্ঠ এ কর্মকর্তা। এসব আর্থসামাজিক অর্জনের পাশাপাশি বিশ্বের সপ্তম জনবহুল দেশ বাংলাদেশের গতিশীল গণতন্ত্রকে তিনি সাধুবাদ জানান।
তবে বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের এমন সাফল্যগাথার পাশাপাশি এ দেশের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সরাসরি বলতে ভোলেননি মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি। তাঁর মতে, বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথে চ্যালেঞ্জটা রাজনীতি নিয়ে, খুব স্পষ্ট করে বললে সাংঘর্ষিক রাজনীতি আর হরতালের ফাঁদে আটকে থাকা।
ওয়েন্ডি শারমেন বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আমাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, এ দেশের চূড়ান্ত সাফল্যের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
অসংখ্য বাংলাদেশির মতো আমি আর আমার সহকর্মীরা নিরাশার সঙ্গে একের পর এক হরতাল, রাজপথে সহিংসতার পর সহিংসতা অবলোকন করছি। কোন দাবিগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, কোন ভুলগুলো শোধরানো উচিত, কিংবা আগামী দিনে যেসব কঠিন চ্যালেঞ্জ আসবে, তা কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত—এসব নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ বা এ দেশের রাজনীতিবিদদের পরামর্শ দেওয়ার ধৃষ্টতা আমি দেখাতে পারি না। অন্য অনেক গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশের জনগণকেই এটা ঠিক করতে হবে। ’
হরতালের বিরুদ্ধে তাঁর দেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি। বলেন, ‘বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে বলতে পারি, ঢাকার মতো কোটি মানুষের বসবাসের শহর প্রায় প্রতিদিন অব্যাহত হরতালে থমকে যাওয়াটা আমাকে উদ্বিগ্ন করে।
কারণ, এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে মদদ দেয়, যেখানে আপসের কোনো সুযোগ নেই, যা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাঝে ভীতির সঞ্চার করে। এ পরিস্থিতি নাগরিকদের একটি অংশ ও তাদের বিশ্বাসকে অন্যদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিফলিত করে এবং জনগণের একটি অংশকে উগ্রপন্থী করে তোলে। তাই বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে নির্বাচনী বছরে সহিংসতার পুরোনো বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ’।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।