আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বর্গ

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...
এক: বাস্তব পর্ব শেষ সম্বল আছে মাত্র বারো ইউনিট। এটা দিয়ে হয়তো আর সপ্তাহ খানিক চলবে। তারপর কি হবে এমিল তা নিজেও জানে না। ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দায় পৃথিবীর বড় বড় কমিউনিটি গুলো যেখানে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারছে না, সেখানে এমিলের এই ছোট্ট কমিউনিটি টা যে খুব দ্রুতই ধ্বংস হয়ে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক। একসময় এই কমিউনিটিতে প্রায় আড়াইশ মানুষ ছিলো।

কিন্তু এমিল সহ এখন আছে মাত্র পয়ত্রিশ জন। বাকিরা সবাই ধীরে ধীরে নিজেদেরকে ডিজিটাইজ করে ফেলেছে। সবাই ই বেঁচে আছে, কিন্তু এই জগতে নয়। বিরাট একটা কম্পিউটার সার্ভারের ভেতর। তাদের সমস্ত স্মৃতিকে ডিজিটাল ডাটায় রুপান্তরিত করে একটা কম্পিউটারের তৈরী ভার্চুয়াল জগতে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

এভাবেই এমিলের প্রিয় বন্ধু ডিরাক, মুহিন, ট্রিনা সহ আরো অনেকে তাদের রক্ত মাংশের দেহকে ত্যাগ করে এখন ঠিক এই পৃথিবীর মতোই একটা ভার্চুয়াল জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা এখনও দক্ষিণের সমুদ্রপারে ঘুরতে যায়। আড্ডা দেয় শহরের মাঝখানের কফি শপটাতে। কিন্তু সেসবই ভার্চুয়াল জগতের। আদতে সেগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই।

কোন এক কম্পিউটারের সুনীপুন প্রোগাম দিয়ে তৈরী করা সমুদ্রতট, আকাশ সব। সুবিধা একটাই, সেখানে কখনো খাবারের অভাব হয় না। যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। দুঃখ, কষ্ট, ক্ষুধা মুক্ত এক অবিরাম সুখের জগত। বারো ইউনিট দিয়ে কতদিন বাঁচবে এমিল।

এমিল কখনোই চায় না নিজেকে ডিজিটাল জগতে নিয়ে যেতে। কোন এক কম্পিউটারের প্রোগ্রাম হয়ে চরম সুখে হলেও বেঁচে থাকতে চায় না। তাই সে খুব হিসেব করে দিন চালাতে থাকে। বিকেলে আড্ডা দেয়ার কেউ নেই,কথা বলার লোকেরও অভাব। খুব নিঃসঙ্গ একটা জীবন।

এক সময় মানুষে গিজ গিজ করা কমিউনিটি সেন্ট্রালটা এখন ভুতের আড্ডা মনে হয়। কেউ নেই। পথের পাশের ফুল গাছগুলো মরে গেছে। যত্ন নেয়ার কেউ নেই। একটা মাত্র স্টোর ছিলো, সেটাও গতকাল বন্ধ হয়ে গেছে।

বিক্রি করার কিছু নেই, কেনার লোকও নেই। নয় দিন পর শেষ ইউনিট টাও যখন খরচ হয়ে গেলো, তখন এমিল শহরের এককোনে অবস্থিত ডিজিটাইজ কেন্দ্রে এসে হাজির হলো। নিজেকে ডিজিটাইজ করা ছাড়া এখন আর কোন পথই খোলা নেই। শহরে সে ছাড়া আর মাত্র আটজন মানুষ আছে। হয়তো কাল বা পরশুর পর তারাও থাকবে না।

দুই: ভার্চুয়াল পর্ব আস্তে আস্তে চোখ মেললো এমিল। সে তার রুমে শুয়ে আছে। বাইরে একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এমিল এসে জানালা খুলে বাইরে তাকালো। চমৎকার দিন।

হালকা রোদ। কমিউনের ব্যাস্ত পথটা ধরে যাওয়া বহুদিনের চেনা মানুষগুলোকে দেখে খুব ভালো লাগলো তার। এটাই তাহলে ভার্চুয়াল জগৎ। এমিল তার ক্রেডিট কার্ড মডিউলটা চেক করে নিলো। আশ্চর্য!! পুরো দেড় লাখ ইউনিট জমা আছে সেখানে।

জীবনেও এতো ইউনিট নিজের কার্ডে দেখেনি সে। দেড়লাখ ইউনিট দিয়ে কত কিছু করা যায়। ভেবে বের করতে পারলো না এমিল। ফ্রিজারটা খুলে দেখলো তার প্রিয় সব খাবার দিয়ে ভরে আছে সেটা। নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারলো না সে।

আপাতত অল্পকিছু দিয়ে নাস্তা করে সে বের হলো। অনেকদিনের পুরনো আড্ডার যায়গাটা একবার ঘুরে না এলেই নয়। ডিরাক, মুহিন আর ট্রিনা এমিল কে দেখে প্রায় তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। তারা বার বার এমিলকে ভার্চুয়াল জগতে আসতে দেরী করার জন্য দোষারোপ করলেও সেদিনের আড্ডাটা দিয়ে ঘরে ফিরে অদ্ভুত ভালো লাগলো এমিলের। কেবল আড্ডার জন্য নয়।

আজ সে দেখলো ট্রিনা তার প্রতি অনেক অনেক বেশী আগ্রহী ছিলো। আড্ডা শেষে ট্রিনাকে নিয়ে সে কিছুক্ষন একা সমুদ্রতটে হেঁটেও এসেছে। অথচ আগে, যখন তারা ভার্চুয়াল জগতে আসে নি, তখন কতবার ট্রিনার একটা হাসির জন্য এমিল তার জানা জোকস গুলো নানান কায়দায় বলতো। কতবার চেয়েছে, ট্রিনা তার দিকে একটু অন্য রকম দৃষ্টি নিয়ে তাকাক। কেবল বন্ধুত্ব নয়।

একটু অন্য কিছু। হয়তো এটার নামই ভালোবাসা। যেটা সে বাস্তব জগতে অনেক চেষ্টা করেও পায় নি। অথচ এই ভার্চুয়াল জগতে এসে পেয়ে গেলো। হয়তো এর নামই স্বর্গ।

তিন:স্বর্গ পর্ব তিনমাস পর। ট্রিনাকে নিয়ে উত্তরের পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে এমিল। বিয়ের পর এটা তাদের দ্বিতীয়বারের মতো ঘুরতে যাওয়া। কোন কিছুরই অভাব নেই এখন এমিলের। খাবার, ইচ্ছে মতো খরচ করার মতো ইউনিট, বন্ধুদের আড্ডা, প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য সবই আছে।

কিন্তু কোথায় যেন একটা না পাওয়া তাকে তাড়া করে বেড়ায়। প্রিয় মানুষটিকে পাশে নিয়ে আকাশের অপূর্ব সুন্দর জ্যোৎস্নার দিকে তাকালে মনে হয়, এই চাঁদ, এই জ্যোৎস্না এসব কিছুই আসল না। সবই অতি উচ্চ ক্ষমতার এক কম্পিউটারের তৈরী করা। হাত দিয়ে ছুয়ে যে ট্রিনাকে সে বুকে টেনে নেয়, সেই ট্রিনা আসলে আসল ট্রিনা নয়, খুব উন্নত একটা কম্পিউটার মডেল। ট্রিনার জন্য তার বুকে যে অপরিসীম ভালোবাসা, সেটাও স্বর্গ থেকে আসা সত্যিকারের ভালোবাসার অনুভুতি নয়,কম্পিউটারের অসংখ্য লজিক গেটের ভেতর থেকে ঝড়ের বেগে বের হওয়া শূন্য কিংবা ওয়ানের সমষ্টি।

তাই সবকিছু থেকেও এমিলের ভালো লাগে না। নেজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। এই ভার্চুয়াল জগত থেকে পালাতে ইচ্ছে হয় তার মাঝে মাঝেই। ঘুরতে গিয়ে তৃতীয়দিন তাই সে ঠিক করে এই জগত থেকে পালাবে। বাস্তব জগতে তো আর ফিরে যেতে পরবে না।

তার রক্ত মাংসের দেহটাকে তো এতোদিনে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তাই আত্মহত্যাই তার কাছে এক মাত্র উপায়। সেদিন বিকেলে যখন ট্রিনা ঘুমুচ্ছিলো, তখন সে হোটেলের পাশের পাহড়ের উঁচু চূড়াটা থেকে লাফিয়ে পড়লো। প্রবল বেগে সে নীচে পড়ছে। আর কিছুক্ষন পরই নীচের পাহাড়ে মাথাটা ঠুকে যাবে।

তারপর চিরমুক্তি, এই চরম সুখের জগত থেকে। এমিল চোখ বন্ধ করে ফেলে। শক্ত পাথুরে পাহাড়ে এমিলে মাথা ঠুঁকে খুলিটা চৌচির হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কিছুই হলো না। চোখ মেলে সে নিজেকে সেই পাহাড়ের উপরেই আবিষ্কার করলো, যেখান থেকে সে লাফ দিয়েছিলো।

অথচ সে নিশ্চিৎ এখান থেকে সে লাফ দিয়েছিলো। এমিল আবারো লাফ দিলো। কিন্তু লাভ হলো না। আবারো সে একই জায়গায় ফিরে এলো। তৃতীয়বার লাফ দিয়েও যখন সে একই যায়গায় ফিরে এলো, ততক্ষনে সে নিশ্চিত হয়ে গেছে, এই কৃত্রিম স্বর্গ থেকে কখনোই তার মুক্তি নেই।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.