ছোটবেলা থেকেই ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করি। একটু বড় হয়ে এর সাথে যুক্ত হ’লো পড়া ও লেখালেখি, তারপর ফোটগ্রাফি।
চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা, এরপর জম্মু হয়ে কাশ্মির। ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে ১২ দিন। শ্রীনগরশহর, গুলমার্গ, সোনমার্গ ও যুসমার্গের আনাচ-কানাচ ঘোরা শেষ আমাদের।
যদিও র্স্বগের সীমানা যেমন অসীম, কাশ্মিরের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যও অফুরন্ত। ভিনদেশী আমাদের সময়ের আছে সল্পতা আছে আর্থিক দীনতা। তাই ইচ্ছে না থাকলেও ভূ-র্স্বগ থেকে পাটতারী গোটাতে এবার তাই আমাদের অন্তিম গন্তব্যস্থল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত স্নিগ্ধ এক টুকরো স্বর্গ পহেলগাঁও। সরাসরি হিমালয় থেকে নেমে আসা লিডার নদী বৃত্তিয়ে রেখেছে ছোট্ট এই শহরটিকে । জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের অনন্তনাগ জেলার অর্ন্তগত নয়নাভিরাম এই শহরটি বছরে মাত্র ৬ মাস দর্শনাথীদের জন্যে উম্মুক্ত থাকে বিরূপ আবহাওয়ার কারনে।
সাধারনত: অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে মার্চের শেষ নাগাদ পর্যন্ত এখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রিতে উঠানামা করে। তখন এখানে মানুষ বসবাসের অবস্থা থাকে না। মাত্র কয়েক কিলোমিটারের এই হিল স্টেশনের সমস্ত দোকানপাট, হোটেল ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা ও তুষার পাতের কারনে। জুলাই-আগষ্ট প্রান্তিকে মুলত: হিন্দু তীর্থযাত্রীদের অমরনাথ যাত্রার জন্যেই এ শহর খুলে দেয়া হয়। মুল শহর থেকে ১৬ কি:মি: উত্তরে অবস্থিত চন্দনবাড়ী হলো অমরনাথ ট্রাকিং-এর মূল দ্বার।
এখান থেকে শুরু হয় অমরনাথে তীর্থযাত্রা।
শ্রীনগর থেকে বেরিয়ে কোনপ্রকার বিরতী ছাড়াই আমরা ঢুকে গেলাম পহেলগাঁও এর বিস্তীর্ন আপেল বাগানে। ইতিপূর্বে গুলমার্গ ও যুসমার্গেও আমরা আপেল বাগান দেখেছি। কিন্তু পহেলগাঁও এর মতো এতো সুবিশাল আয়তনের উদ্যান এর আগে আমাদের চোখে পড়েনি। মাইলের পর মাইল বির্স্তীন বাগান এবং সৌভাগ্য বশতঃ এখনই আপেলের ভরা মরশুম।
দুপুর হয়ে এসেছিল। মূল শহর তখনও ঘন্টা খানেকের পথ। তাই আমাদের ড্রাইভার রিয়াজ ভাইকে বললাম অনুরোধ করলাম বড় দেখে একটি আপেল বাগানেই ব্রেক নিতে।
এই বাগানটির মালিক ওসমান শেখ। উনি উনারি এক ছেলে, ছেলের বউ ও এক মেয়েকে নাতি-নাতনিদের নিয়ে এই বাগানের পরিচর্যা করেন তিনি।
কিছু বাড়তি আয়ের জন্যে বাগানের মূল ফটক সলগ্ন একটি মুদি দোকানও চালান তিনি। হোটেল থেকে সাথে করে নিয়ে আসা ফ্রাইড রাইজ ও চিলি চিকেন দিয়ে লাঞ্চ সারলাম সবাই। তারপর ঢুকে পড়লাম একমাথা উচু বাগানের মধ্যে। আপেলের ভারে নুয়ে পরেছে প্রায় প্রতিটি গাছ। এক একটি আপেলের ওজনই প্রায় ছ'শ থেকে সাতশ' গ্রাম।
দেখলেই জ্বিবে জল আছে, পেরে নিতে খুব লোভ হয়, কিন্তু ওই যে আইন, বিনা অনুমতিতে ছিড়ঁলেই দু'হাজার রুপি তৎক্ষনাৎ জরিমানা। ফলে শুষ্ক মুখে শুধু ছবি তোলাই হতে লাগলো । সহৃদয় বাগানমালিক হয়তো আমাদের মনোভাব বুঝতে পারলেন, সবাইকে বিশাল আকৃতির এক-একটি আপেল উপহার দিলেন খাওয়ার জন্যে। উপহারের বিনিময় মূল্য হয় না তবুও অর্থ-বৃত্তের দিকে পিছিয়ে পড়া এই কাশ্মিরীদের জন্যে ইতিমধ্যে আমাদের সবার মনে মমত্ববোধ জেগেছে । আপত্তি সত্ত্বেও তাই উনার নাতি-নাতনিদের সবার হাতে কিছু কিছু রুপি গুজে দিলাম।
খানিকক্ষণ গল্প গুজব করলাম উনার পরিবারের সাথে। রিয়াজ ভাইকে আমাদের পহেলগাঁও পৌঁছে দিয়ে আবার দিনে দিনে শ্রীনগর ফিরতে হবে। তাই অনিচ্ছা সত্বেও পাটতারি গোটালাম লোভনীয় ও মোহনীয় এরকম একটি বাগান থেকে।
পহেলগাঁও শহরে যখন ঢুকলাম তখন বেলা প্রায় দু'টো। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ।
অথচ এরই মধ্যে হাড়কাপাঁনো শীতের উপস্থিতি। চটজলদি হোটেল ঠিক করে ফেললাম প্রতিরাত হাজার রুপির চুক্তিতে। দু'রাত থাকবো আমরা, তাই পুরো চার হাজার টাকাই পরিশোধ করে দিলাম একসাথে ঝামেলা এড়াবার জন্যে। মূল সড়কের পাশেই কাঠের নকশা করা আমাদের এই হোটেল পাইন-স্প্রীং। অতি-সুদর্শন যুবক ম্যানেজারের বিনম্র ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করলো।
বিনামূল্যে যাতে আমরা ওয়াই-ফাই ব্যবহার করতে পারি তড়িঘড়ি তার ব্যবস্থাও করে দিলেন। আমাদের রুম দু’টিই রোড-সাইডে, ফলে সামনে দন্ডায়মান বিশাল পবতমালার তুষার আবৃত সুউচ্চ রিজ ও তার সমতলে অনিন্দ্য-সুন্দর পহেলগাঁও টাউন-গার্ডেন। দু'ধারে প্রবাহমান লিডার নদী, তার মাঝে ছোট ছিমছাম এই উদ্যানে পেতে রাখা রঙিন বেঞ্চ ও লাইট পোষ্ট, এবং যথারীতি নাম না জানা দুর্লভ অর্কিডের সমারোহ। হোটেলে লাগেজপত্তর রেখেই ফ্রেশ হতে হতে বেলা সাড়ে তিনটে। সবাই এক কাপ করে কফি খেয়ে নিয়ে প্রথমে গা-গরম করলাম তারপর ভারী জামা-কাপড় চাপিয়ে সোজা উদ্যানে গিয়ে উপস্থিত।
শুধুমাত্র স্থানীয় কিছু কাশ্মিরী ও একেবারে নগন্য সংখ্যক পশ্চিমা পর্যটকের দেখা মিললো। সন্ধ্যা অবদি পার্কে কাটিয়ে বাচ্চাদেরকে হোটেলে পাঠিয়ে আমরা দু'জোড়া দম্পতি বেরুলাম নতুন দেখা এই শহরের বিপনিবিতান দর্শনে। শহর বন্ধের সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে, তাই ক্রেতাশূন্য দোকানগুলোতে সবকিছুই মোটামুটি জলের দরে বিকোচ্ছে। স্থানীয় পন্যের মধ্যে শীতের উন্নতমানের শাল ও সোয়েটারই হচ্ছে এখানে হস্ত-শিল্পের মূল নিদশন। আমাদের স্ত্রীরা কিছু কেনাকাটা করলো তারপর নোমান গিয়ে বাচ্চাদের হোটেল থেকে নিয়ে আসতেই মোটামুটি গোছের একটি রেস্টুরেন্টে বসে কাশ্মিরী নান সহকারে নিরামিষ খেলাম সবাই।
সারাদিনের ধকলে গিয়েছে, তাই হোটেলে ফিরেই সবাই ঘুমে কাদা।
পরদিন সকালে নাস্তা না সেরেই জিপ স্ট্যান্ডে গেলাম আমি আর নোমান। ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম- এই প্রবচনটিই প্রথমে মনে এলো এখানকার টেস্কি সমিতির তথাকথিত রেইট দেখে। প্রায় পর্যটক শূন্য এই অঞ্চলেও গাড়ী ভাড়ার সাথে সমিতির চাঁদা। বিকল্প ব্যবস্থা সবখানেই থাকে তাই ওখান থেকে গাড়ি নিলাম না।
একটু ঘোরাঘুরি করতেই স্টেন্ড্-এর বাইরে থেকে প্রায় অর্ধেক ভাড়ার চুক্তিতে একটি টাটাসুমো ঠিক করে ফেললাম পহেলগাওঁ সাইট সিয়িং এর জন্যে। ঘন্টাখানেক সময় চেয়ে নিলাম ড্রাইভার থেকে ব্রেকফাস্ট সারার জন্যে, তারপর গাড়িতে চড়লাম সবাই পহেলগাঁও দর্শনে।
প্রথমেই গেলাম সম্প্রতি বিধস্ত্ব হয়ে যাওয়া ট্রেজিক-অমরনথের দ্বার হিসেবে পরিচিত চন্দনবাড়ীতে। যদিও এখানে এখন কোন বাড়ী তো দুরের কথা কোন স্থাপনারও আর অবশিষ্ঠ নেই। নিষ্ঠুর প্রকৃতির করালে পড়ে দুমরে মুচরে গেছে সবই।
স্বর্গে এসে ধ্বংসজগ্ঘ দেখাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তাই এখানে আর বেশিক্ষণ না কাটিয়ে রওনা দিলাম আরুভ্যালীর উদ্দেশ্যে।
আগেই বলেছি যে ভূ-স্বর্গের ছোট্ট একটি টুকরো পহেলগাঁও। চারদিকে হিমালয়ের পাইন-ফারের সবুজের সমারোহ, টুলিয়ান লেকই, শীষনাগ লেকই নামক অমৃতজল পাথুরে নদীদের পেছনে ফেলে আমরা এসে পৌঁছলাম আরু ভ্যালিতে। এখানকার দৃশ্যাবলী অনেকটা সোনমার্গের মতোই। তিনদিকে তুষার আবৃত পর্বতমালা ঘেরা পাহাড়ী উপত্যকা, সেইসব গ্লেসিয়ার থেকে নেমে আসা বরফগলা জলের অগভীর স্বচ্ছ ঝিল, উপরে অফুরন্ত নীল।
সময়ের সল্পতার কারনে আধঘন্টার বেশি থাকা গেলনা এখানেও। গাড়ী ঘুরলো ভারতীয় চলচ্চিত্র বেতাব খ্যাত বেতাব-ভ্যালির দিকে। আলোচিত এই সিনেমাটির এখানেই দৃশ্যায়িত হয়েছিল এবং এর নামকরনটিও তাই এই চলচ্চিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে পরযটকদের বাড়তি আকষন সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই।
বেতাব ভ্যালিতে লিডার নদী অনেকটা চওড়া। নান্দনিক শৈলিতে নির্মিত সেতুতে নদী পেরিয়ে ভ্যালিতে ঢুকলাম।
মোটামুটি সাতটি ফুটবল মাঠের সমান আকৃতির বেতাব ভ্যালির সোন্দর্য্য সত্যিই শ্বাসরুদ্ধকর। আমাদের বাচ্চারা ফেঞ্চ পেরিয়ে গিয়ে নামলো নদীর কাকচক্ষু স্বচ্ছজলে। কিন্তু মুহুর্ত কয়েকই, বরফগলা জলের ভয়াবহ ঠান্ডার কামড়ে পড়িমড়ি উঠে এলো পাড়ে। এই মরসুমে বেতাব ভ্যালিও কার্যত স্থানীয় পিকনিক পার্টির দখলে। আস্ত ভেড়ার রোস্ট সহকারে মসলাদার খাবারের মনমাতনো সৌরভ ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে আশেপাশে, আর আমাদের ক্ষুদার্র্থ বেহায়া নাক তা ততক্ষনাত ধরে ফেলছে! এদের আয়োজনও বলিহারি, খাবার একটু ঠান্ডা হয়ে এলেই তা সাথে সাথে গরম করে নিচ্ছে সাথে করে আনা সিলিন্ডার সুদ্ধু গ্যাসের চুলাতে।
এলাহি কারবার বুঝি একেই বলে!
বেতাব ভ্যালিতে প্রায় ঘন্টা দেড়েক কাটালাম। সাথে আনা আপেল, বিস্কিট ও পানি সহকারে মিনি লাঞ্চ সারলেও বাঙ্গালীর ভাতের স্বভাব কোথায় যাবে। অতএব এই পেটের টানেই ফিরতে হলো পহেলগাঁও মূল শহরে। হোটেলে ঢোকার আগে বেশ ভালো মানের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নিলাম। বিশ্রামের নামে ঘন্টা খানেকের বিছানায় গড়াগড়ি, তারপর আবার পদবজ্রে পহেলগাঁ শহর পরিদর্শন।
কেননা আগামীকালই আমরা এই শহর তথা কাশ্মির রাজ্যকে বিদায় জানাবো।
পরদিন ভোররাত চারটাতেই সবাইকে ডেকে দিলাম। আমাদের টয়োটা ইনোভা আসলো সাড়ে চারটাতে, পাচঁটাতে পহেলগাঁ থেকে বেরিয়ে এলাম। এই শহরতলী তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত, নিকষকালো আকাশে শুকতারার সহ অন্য নক্ষত্রের সুস্পষ্ট হইচই।
যাযাবরদের ভেড়ার পাল ও আপেলের ভরা মৌসুম হওয়াতে ফলবাহী লরীর চাপে প্রায় চৌদ্দঘন্টা জার্নি শেষে যখন আমরা জম্মুতে পৌঁছুলাম দিল্লীগামী ট্রেন ছাড়তে তখন মাত্র আর বিশ মিনিট বাকী।
।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।