ছোটবেলা থেকেই ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করি। একটু বড় হয়ে এর সাথে যুক্ত হ’লো পড়া ও লেখালেখি, তারপর ফোটগ্রাফি।
স্বর্গ দর্শন: ভূ-স্বর্গ কাশ্মির ভ্রমন
স্বর্গ লাভের ইচ্ছে থাকে সবার, তবে ইহকালে এমন কোন পূন্যকাজ করিনি যে স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেঠানোর মতো মর্ত-স্বর্গ তথাপি ভূ-স্বর্গ দর্শনের দূর্বার ইচ্ছে বাস্তবায়ন করলাম গেল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। বিদেশ তো বটেই, তার উপর ঝুঁকি-বহুল এলাকা কাশ্মির।
যেখানে প্রতিদিনই কোন না কোন দুর্ঘটনা বা সস্বস্ত্র হামলা ঘটছেই। তবুও ভূ-স্বর্গ বলে কথা। কলকাতা থেকে দুরপাল্লার যেকোন ভ্রমনকে আরামদায়ক ও ইকোনমি করতে ট্রেনই হলো সবচে' সুবিধাজনক। অন্যান্য রুটে অনেক ট্রেন থাকলেও জম্মু অবদি শুধুমাত্র দুটি ট্রেনই আছে। তার মধ্যে সবচে' ভালো আর অপেক্ষাকৃত কম সময় নেয় হিমগিরি এক্সপ্রেস।
এবং সপ্তাহে মাত্র তিনদিন চলা এই ট্রেনের টিকেটও অনেকটা সোনার হরিণের মতো। যাই হোক একটু আগেভাগে প্ল্যান করাতে প্রায় দেড়মাস আগে এসি টু-টায়ারে ছয়টির মধ্যে চারটি কনর্ফাম টিকেট পেয়ে গেলাম, বাকি দু'টি রেক (রিজার্ভেশন এগেইনস্ট ক্যানসেলেসন) এ থাকলো। আমার ইন্ডিয়ান ট্রাভেল এজেন্ট জানালো এই দু'টি টিকেট নিশ্চিন্তে কনফার্ম হয়ে যাবে ভ্রমনের চব্বিশ-ঘন্টা আগেই। আমাদেরকে শুধুমাত্র অনলাইনে অথবা স্টেশনে গিয়ে চার্ট দেখে সিট ও বগি নম্বরটি জেনে নিতে হবে। টিকেট কাটার মুহুর্ত থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের স্বর্গ দর্শনের প্রতিক্ষা.....প্রতিক্ষার প্রহর সত্যিই খুব যন্ত্রনাদায়ক।
আমি ও নোমান আমাদের পরিবার সহ ইতিমধ্যে হিমাচল প্রদেশ সহ ভারতের দর্শনীয় জায়গাগুলোতে ভ্রমণ শেষ করেছি। তাই কি ধরনের ট্রাভেল গিয়ার নিতে হয় সে-সম্পর্কে আমাদের বেশ ভালোই ধারনা আছে। ভ্রমনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো, আমরা ততই এক্সাইটেড হতে লাগলাম। প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে ঘুচানো শেষে একদিন সত্যি সত্যি সোহাগ-পরিবহনের তথাকথিত স্ক্যানিয়াতে করে রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। সীমান্ত পার হলে ভারতের হরিদাসপুর থেকে কলকাতাগামী বাসে দেখা হলো একসময়ের চিত্রনায়ক সাকিল খান ও তার স্ত্রীর সাথে, সহজাত মিশুক স্বভাবের নোমান শুরুতেই গল্প শুরু করে দিলো ওই দম্পতির সাথে।
কিছু পরে আমরা বাকীরা যোগ দিতেই আসর জমে গেল। প্রবল বৃস্টির মধ্যে নামায়িত সন্ধ্যায় আমাদের বাস থামলো কলকাতার মারকিউস স্ট্রিটে। বৃষ্টি তখনও পুরোপুরি থামেনি। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই জলকাদা ভেঙে আমি আর নোমান হোটেল ঢুরতে বেরুলাম বউ-বাচ্চাদের বাস কাউন্টারে বসিয়ে রেখে । অনেক খুঁজে শেষে হোটেল কন্টিনেন্টালে উঠলাম প্রতিরাত ২০০০ রুপি চুক্তিতে, যেখানে আমাদের বাজেট ছিল ১০০০ রুপি।
শুরুতেই দ্বিগুন খরচের ব্যাপারটা আমার হিসেবি মন ঠিক মেনে নিতে পারছিল না। যাইহোক প্রথমদিন কলকাতায় রাত্রিযাপন শেষে পরদিন সকালে নাস্তা সেরেই ছুটলাম ফেয়ারলি প্লেসে ফরেন কোটায় দি্ল্লি টু কলকাতা টিকেট কাটাতে। কেনানা আমাদের যাওয়ার টিকেট কনর্ফাম থাকলেও আসার টিকেট পাইনি পূজার ছুটির ভিড়ের কারনে। ওই দিনের জন্যে মাত্র ছয়টি টিকেটই ছিল এসি -থ্রিটায়ারে ফরেন কোটতে। রিজার্ভেশন অফিসারকে অবাক করে দিয়ে ছ'টি টিকেটই আমরা কনফার্ম করলাম।
তারপর আধুনিক জিপিএস সুবিধা ব্যবহার করে পুরানো কলকাতা নগরীর পথে পথে হেঁটে-হেঁটে আমি আর নোমান হোটেলে ফিরলাম দুপুরবেলায়। ওইদিনই আমাদের ট্রেন রাত ১১.৫৫ মিনিটে। তাই ঠিক করলাম একদিনের জন্যে শুধু শুধু ৪০০০ রুপি খরচ না করে সেই সময়টা সিনেমা দেখে আর মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে পার করে দিবো। নিউমার্কেট সংলগ্ন এলিট সিনেমা হলের ছটি টিকেট কাটলাম ৬০০ রুপি দিয়ে। তিনটে থেকে ছটা অবদি সিনেমা দেখলাম তারপর কলকাতা নিউমার্কেটের অলিগলি ঘুরে সামান্য শপিং করলাম।
রাত সাড়ে-আটটায় হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাধুনীতে ডিনার সারলাম সাড়ে-ন'টা অবদি। হোটেল লবিতে খানিক অপেক্ষা শেষে রাত দশটায় টেক্সি ধরলাম হাওয়ার উদ্দেশে। বাকী সবাই সহ নোমান রইল এসি ওয়েটিং রুমে আর আমি নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে লাগেজ-পত্তর নিয়ে একা একা বসে রইলাম প্রায় দু'ঘন্টা ধরে। ট্রেন আসার ঘোষনা শুনেই ফোন লাগালাম নোমানকে, সে সবাইকে নিয়ে উপস্থিত হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন লেগে গেল প্ল্যাটফর্মে। দশমিনিটের মাথায় রওনা দিলাম ভূ-স্বর্গের উদ্দেশ্যে..........যাত্রা হলো শুরু
হিমগিরি এক্সপ্রেস।
নামটি যেমন সুন্দর ট্রেনটিও তেমন সুন্দর। অপেক্ষাকৃত অন্যান্য সিটের চেয়ে এসি-টু টায়ারের শোয়ার এবং বসার সিটগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বেশি। শুয়ে শুয়ে বই পড়ার জন্যে এডজাস্টটেবল রিডিং লাইট, ধোলাই করা টাওয়াল-বেডসিট সাথে খাওয়াদাওয়ার মানও বেশ উন্নতমানের। কলকাতা থেকে ২০২০ কিলোমিটার। প্রায় চল্লিশ ঘন্টা জার্নি শেষে আমরা যখন জম্মু রেল স্টেশনে পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় তিনটা।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই আক্কেল গুড়ুম আমাদের। শ'য়ে শ'য়ে মানুষ দাঁড়িয়ে-বসে-শুয়ে আছে কিন্তু কোন গাড়ি যাচ্ছে না। প্রি-পেইড টেক্সি কাউন্টারে খবর নিয়ে জানতে পারলাম আজ বনধ। কোন গাড়ি শ্রীনগরে যাবে না। আশেপাশে তাকালাম, দেখলাম বৃদ্ধ, কোলের শিশু নিয়ে মানুষজন বড্ড অসহায় হয়ে মালপত্তর নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে কেউবা বসে আছে।
আমার দীর্ঘ ভ্রমণ অভিঙ্ঘতা থেকে আমি জানি পৃথিবীতে দু'নম্বর ব্যবস্থা সবখানেই থাকে। তাই বিকল্প সন্ধানে বেরুলাম। স্টেশনের পাশেই সরু গলিতে একটি ট্রাভেল এজেন্সির সাথে কথা বলতেই তারা মোটামুটি সহনীয় ভাড়াতেই আমাদের শ্রীনগর নিতে রাজি হয়ে গেল। আপেলের ভরা মরসুর, তাই গাড়িতে ওঠার আগে খুব সস্তায় প্রতিজনের জন্যে দু'টি করে বিশাল আকৃতির আপেল কিনে বেলা সাড়ে তিনটায় রওনা দিলাম কাশ্মিরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। প্রায় ১৪ ঘন্টা পাহাড়ী রাস্তায় জার্নি শেষে যখন শ্রীনগরে পৌঁছলাম তখন রাত দু'টো।
মেইক মাই ট্রিপ ডট কমে হোটেল রির্জাভেশন আগেই করা ছিল। এই রাত দুপুরে হোটেল ওয়ালাকে ফোন করতেই সে জানালো যে লোক পাঠাচ্ছে আমাদেরকে চোদ্দ নম্বর ঘাটের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। শুরুতেই খটকা লাগলো যা একটু পরেই সত্যি প্রমানিত হলো। ওয়েবসাইটে হোটেলের ছবিতে তা ডাঙার হোটেল দেখালেও সত্যিকারের হোটেলটি বিখ্যাত ডাল-লেইকের ওপাড়ে। প্রায় আধ-ঘন্টা অপেক্ষার পর ঘুটঘুটে অন্ধকার ডাল-লেইক থেকে ভেসে এলো বৃদ্ধ-তরীওয়ালার ডাক।
পরিস্থিতি অনেকটা ব্যাখাতীত, মাঝ-রাত, পুরো শ্রীনগর শহর সুনসান, এর মধ্যে অন্ধকার লেইক থেকে যেন নরকের দুত আমাদের নিতে এসেছে শয়তানের কেয়ারা নিয়ে। যাই হোক বউ-বাচ্চা নিয়ে বিপদ-সংকুল কাশ্মিরের পথে পড়ে থাকার চেয়ে সেই ডাকে সাড়া দেওয়াই উত্তম মনে করলাম। লেইকের ওপাড়ে গিয়ে হোটেল রুম দেখে আরেকবার দমে গেলাম টয়লেটের অবস্থা দেখে। রুমের মধ্যেই টয়লেটের ভ্যান্টিলেশন । এই মাঝ রাতে কিছুকরার নাই দেখে কোনক্রমে রাতটি পার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
চলবে.....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।