জীবনের দীর্ঘ পথ অনেকটা পেরিয়ে এসে আমি একজন ক্লান্ত পথিক, তবে অবসর খুবই কম। তাই ইচ্ছে থাকলেও লেখা হয় না তেমন একটা।
২০০৪ সালে খুব আকস্মিকভাবে আমার বাবা মারা যান। এর কিছুদিন পর আমরা পারিবারিকভাবে তার স্মৃতি নিয়ে একটি বই প্রকাশ করি যেখানে আমার একটা লেখা ছিল। সেই লেখাটাই এখানে তুলে দিলামঃ
এই বইটির কোন ভূমিকা নেই।
সব বইয়ের শুরুতেই একটি ভূমিকা থাকে, লেখকের কথা থাকে। এখানে নেই। কারণ এই বইয়ের শুরুতো এখানে নয়। এই বইয়ের ভূমিকা শুরু হয়েছিল দীর্ঘ ৫৯ বছর আগে। ১৯৪৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর, জামালপুর শহরে।
জামালপুর থেকে ঢাকা, নয়াটোলা থেকে ঢাকেশ্বরী, তারপর গ্রীণ রোড, এভাবেই একটু একটু করে দীর্ঘ সময় ধরে লেখা হয়েছে সেই গল্প, আসলে গল্পের ভূমিকা। গল্পটা লেখা শুরু হয়েছিল মাত্র, কাহিনী জমে ওঠার আগেই লেখক যেন হঠাৎ উদাসীন হলেন, অন্যমনস্ক টানে ছিঁড়ে ফেললেন লেখার কাগজটা, বন্ধ করে দিলেন গল্পের খাতা।
কিন্তু যতটুকু লেখা হয়েছিল, সেখানে ছিলাম আমরা সবাই। কেউ কম, কেউ বেশী। সেই অসম্পূর্ণ লেখায় আমরা চিনেছিলাম একজনকে।
মোঃ ইকবাল হোসেন, আমার বাবা।
তাঁকে কতটুকু চিনেছিলাম বা বুঝেছিলাম সেটা নিয়ে ভাবতে গিয়েই শুরু হল এই বই। অনেক জন- বন্ধু, আত্নীয়, সহকর্মী লিখলেন তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জানেন, যেভাবে জানেন সেই কথা। আমিও লিখেছিলাম। যেটা লিখেছিলাম সেটা এ লেখা নয়।
কারণ লিখতে গিয়ে বুঝেছিলাম, আসলে ভালো করে চেনা হয়নি বাবাকে, ভালো করে দেখাও হয়নি। এই বইয়ের লেখাগুলোর ভেতর দিয়ে অনেকটা চেনা যায় তাকে। অনেকটা- সবটা নয়।
আমিও আমার বাবাকে কিছুটা চিনেছিলাম। তবে যতটুকু চিনেছিলাম, লিখতে গেলে এই বইয়ের অনেক লেখার পুনরাবৃত্তিই হবে।
আর আমি সকলের বোঝার মত করে লিখতে পারবোও না। তাই আমার ঐ লেখাটাও আরেকটা অসম্পূর্ণ লেখা হয়ে পড়ে রইল।
তারপরও বলি, বাবাকে যতটুকু দেখেছি। তিনি বইপত্র নিয়ে আমাকে শেখাতে বসেননি কোনদিন, তবুও আমার জীবনের সব শিক্ষাই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। বাঙময় ও নির্বাক ভাষায় তিনি আমাকে শিখিয়ে গেছেন।
তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন কেমন করে নাটকের মঞ্চে আলোর কাজ করতে হয়, আমি তাঁকে দেখে জেনেছি মনের গহনকে কি করে আলোকিত করতে হয়। পিতৃত্বের গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টাতেও সফল হয়েছিলেন।
নিস্বার্থভাবে মানুষকে ভালোবেসেছেন। সকলের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছেন। সত্য ও সুন্দরের তপস্যায় জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
জীবনের শেষ কয়েকটা বছর যেন আত্নশুদ্ধির এক কঠিন ব্রত পালন করছিলেন। গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলেন লেখা আর গবেষণার কাজে। আমার আত্নোপলব্ধি থেকে বলতে পারি, তিনি যে বিশ্বাসকে ধারণ করে জীবন যাপন করতেন, সে বিশ্বাসকে উপলব্ধি করাই অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়, তা পালন করা দূরে থাক।
আসলে সত্যি বলতে কি, তাঁর সাথে আমার দেখাশোনা আজও শেষ হয়নি। আমি যে তাঁরি অংশ, আমার সত্তায় তিনিই তো বহমান।
অস্তিত্বের কোন এক অজানা গহীন স্তরে আমরা এক- তিনি ও আমি। এই পৃথিবীর যা কিছু দৃশ্যমান ও বাহ্যিক, তার বাইরে, ধরা-ছোঁয়ার জগতের আড়ালে, চেতনার অবারিত যে প্রান্তরে সত্তার গাঢ় ছায়া পড়ে, সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার চলে নিত্য দেখাশোনা। তাইতো এখনো শেষ হলো না চেনার-বোঝার পালা।
আসলে শেষ হবেও না কোনদিন। যতদিন আমার ভেতরে এবং আমাদের পরেও যারা আসবে তাদের ভেতরে তিনি থাকবেন, ততদিন আমরা তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করতেই থাকবো।
মৃত্যুই শেষ নয়। এই বইটিও আসলে সেই নিরন্তর প্রচেষ্টার মাঝখানে কোন এক স্থানের একটি মাইলফলক। এখানে শুরু নয়, এখানে শেষও নয়। শুধু জানা হলো পেরিয়ে গেছে একটি জীবন।
বাবাকে কবর দিয়েছি আজিমপুর কবরস্থানে।
নিজে একজন অসাধারণ মানুষ হলেও, সবসময়ই চাইতেন সাধারণ হয়ে থাকতে, তাই তিনি শুয়ে আছেন সকলের মাঝে। তাঁর কবরের ওপর তথাকথিত বরণীয় ব্যক্তিদের মত করে লেখা নেই কোন মর্মস্পর্শী বাণী। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে তাঁর এপিটাফে আমরা লিখেছি একটি কথাই- আছো অন্তরে চিরদিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।