যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
প্রথমেই পাঠককে একটা ফিল্টারের মধ্য দিয়ে যেতে সাহায্য করি,
১। জেএমবি টাইপের জঙ্গীবাদকে আপনি কি ক্ষতিকর মনে করেন?
২। এদেরকে প্রতিহত করা দরকার বলে কি মনে করেন?
প্রশ্ন দুটোরই উত্তরই যদি হ্যাঁ হয়, তবেই পড়ুন।
**************************************************************
এফবিসিসিআই সভাপতি আনিসুল হক গতকাল সরকারকে নতুন একটি টিপস দিলেন, অথবা এটাকে হয়ত "হেকিম সাহেবের অব্যর্থ বড়ি"ও আখ্যা দেয়া যায়, বিশেষ করে যখন দেশের নানান রাজনৈতিক দূর্যোগে আমরা ব্যবসায়ীদেরকে নানান ফর্মূলা হাতে এগিয়ে আসতে দেখি। মাঝে মাঝে আসলেই গোলকধাঁধায় পড়ে যাই, দেশ আদতে চালাচ্ছেটা কে, জনগণের নির্বাচিত সরকার, নাকি সেনাবাহিনী না ব্যবসায়ীরা।
তিনি, মানে জনাব আনিসুল হক সরকারের মন্ত্রীদের জন্য সীমানা ঠিক করে দিতে চাইছেন একপ্রকারে; তেনাদের, মানে ভূত না, আমাদের জবরজং জঙ্গী মহাশয়দের নাম নেয়া যাবেনা, নিলেও নির্দিষ্ট বিরতিতে নিতে হবে -- দেশের মানমর্যাদা, ভাবমূর্তি ঠিক রেখে নাম নিতে হবে। তা নাহলে বিদেশী বিনিয়োগ, রপ্তানী, শ্রমিকপ্রেরণে প্রভাব পড়বে!
আসলেই কি তাই?? কথা হলো, এখনকার পরিস্থিতিতে জঙ্গীদের নাম নেয়া বিষয়ক রাজনীতিটা কিন্তু কয়েকবছর আগের, মানে বিএনপি-জামাত আমলের চেয়ে ভিন্ন। এখানে যে একটি বিরাট পয়েন্ট জনাব আনিসুল সাহেব দেখতে পেলেননা, বা পেলেও অন্য কোন উদ্দেশ্যের খাতিরে না দেখার ভান করলেন, সেটা হলো সরকার আর জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক অবস্থান। সত্যি বলতে কি, এ ব্যাপারটা অধিকাংশের জন্যই বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবী রাখেনা; তবে ব্যক্তিপর্যায়ের আলাপে আমি অনেককেই দেখেছি এখানটায় আলো ফেলতে গিয়ে তারা খানিকটা গুলিয়ে ফেলেন, আর সেজন্যই অল্পেস্বল্পে হলেও এই "পারস্পরিক অবস্থানে"র ব্যাখ্যাটা জরূরী মনে করি।
প্রসঙ্গতই একটা প্রশ্ন করা যায়, ইংল্যান্ড বা স্পেন যখন জঙ্গী আক্রান্ত হয়, তখন যেভাবে বিশ্বমোড়লেরা সবাই দেশটির পাশে এসে দাঁড়ায়, সাপোর্টের নিশ্চয়তা দেয়, পাকিস্তানে বা মরক্কোতে জঙ্গী আক্রমণ হলে তারা সেটা করেনা কেন? এখানেই মূল পয়েন্টটা।
বিশ্বমোড়লেরা দেশ, জাতি বা ধর্মে সবকিছু বিচার করে বলে অনেকে এই প্রশ্নের একটা ভুল উত্তরের দিকে ধাবিত হতে পারেন। তবে, আপাততঃ খানিকটা বুর্জোয়া অবস্থান গ্রহন করে বিশ্বমোড়লদের জুতোয় পা রেখে ভাবলে বুঝতে পারবো, আসল ব্যাপারটা হলো "সরকার আর জঙ্গী গোষ্ঠী"র পারস্পরিক অবস্থানগত বিচারটাই এখানে বিশ্বমোড়লদের জন্য মূখ্য। সেজন্যই, স্পেন বা ইংল্যান্ডের সরকারকে জঙ্গী দমনে যতটা একাগ্র মনে করা হয়, পাকিস্তান সরকারকে ততটাই নিরুৎসাহ বলে ধরা হয়, আর জঙ্গীদের প্রতি একটি দেশের সরকারের এই এগ্রেসিভ বা রিলাকট্যান্ট অবস্থানই সেই দেশের প্রতি শক্তিশালী ইকনোমির আচরণ কেমন হবে তা নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখে। এটা যতই রূঢ় শোনাক, পুঁজিবাদীভাবে সত্য। সেজন্যই, পাকিস্তানে জঙ্গী আক্রমণ হলে তাদের সরকারের উপর বাবাদের থেকে ওহী নাজিল হয় যে তোমরা আরো সিরিয়াসলি জঙ্গিদমন করো, কেউ পাশে দাঁড়ায়না।
তো বাংলাদেশ সরকারের এখন করণীয় কি? শাক দিয়ে মাছ ঢাকা, বা চোখ ঢেকে ভাবতে থাকা যে তারা যেমন দেখছেনা দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান হচ্ছেনা, বহির্বিশ্বও দেখবেনা? এতে বাংলাদেশ সরকার আসলে জঙ্গীদের সাপেক্ষে নিজেদের কোন অবস্থান বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে? এগ্রেসিভ নাকি রিলাকট্যান্ট?
আনিসুল হক কি মনে করেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যদি জঙ্গীবাদের ব্যাপারে চুপ থাকে, তাহলে এদেশে জঙ্গীবাদের উত্থানের খবর মোড়লবাবারা পাবেননা? মাত্র দুবছর আগ পর্যন্তই তো বিএনপি-জামাত সরকারের আচরণ সেরকম ছিলো, শাক দিয়ে নানানভাবে মাছ ঢাকার চেষ্টা চলছিলো, তাতে মোড়লেরা চপস্টিক দিয়ে হাতে যাতে ময়লা না লাগে সেরকম করেই হোক বা খাবলা মেরে পাতের ভাত সরিয়েই হোক, ভুল হোক, ঠিক হোক, প্রয়োজনমতো জঙ্গীদের খবর কিন্তু ঠিকই বের করেছে। লাভের লাভ যা হয়েছিলো, সরকারের অবস্থানটা ধোঁয়াশা হবার কারণে, নানান অলিখিত অবরোধ কিন্তু ঠিকই প্রয়োগ হয়েছে।
সে হিসেবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একটা ইমেজ থাকার কথা যে এরা জঙ্গীবিরোধী, এরা ধোঁয়াটে নয়, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে এগ্রেসিভের সাইডেই এরা পড়ে। তাই এই সরকারের অনুমতি পাওয়া ব্যবসায়ীদের সাথে ডিলে যেতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বরং আরো নিরাপদ বোধ করার কথা, প্লাস যতই দেশে জঙ্গী আবিস্কৃত হোক, সেটা নিয়ে এই সরকারের বিরুদ্ধে সহায়তা বন্ধের দাবী জানিয়ে বিদেশী মিশনের সামনে ডেমোনেস্ট্রেশন হবার সম্ভাবনাও নেই। কাজেই, আনিসুল হকের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, জঙ্গীদমনে এখন সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ না করলে কখন করবে সরকার?
"জঙ্গী নেই জঙ্গী নেই" বললেই কি মোড়লেরা সেটা সত্য বলে মেনে নেবে বলে ভাবছেন জনাব আনিসুল হক? অর্থনীতির আপাতঃ খারাপ অবস্থা বলে জঙ্গীদের দিকে সরকার মনোযোগ না দিলেই জঙ্গীদের অস্তিত্বটা মিথ্যা হয়ে যাবে? সত্য যেটা, সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে কিভাবে লাভ হয়? আর তাছাড়া অর্থনীতির অবস্থা এদেশে কখন ভালো ছিলো? হঠাৎ একেবারে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে এভাবে লাগার কারণ কি হতে পারে!
নাকি জনাবেরা ছুতো খুঁজছেন।
সবাই জানেই যে বিদেশী অর্ডার, রপ্তানী এসব কমবে, এখন সরকারের জঙ্গীদমনের প্রয়াসকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট করে উদোর পিন্ডু বুধোর ঘাড়ে চাপানোর খায়েশ?
আমি মনে করি সরকারের পরিস্কার অবস্থানই জানানো উচিত। দেশে জঙ্গী আছে, গজাচ্ছে -- এগুলো মানতে কষ্ট হলেও সত্য কথা। এই তিতা সত্যকে না দেখার ভান না করে, যত দ্রুত সম্ভব নির্মূলের চেষ্টাতেই সরকারের প্রচেষ্টা দেয়া উচিত। সেটাই পশ্চিমা বিজনেস পার্টনারদের বিশ্বস্ততা অর্জনে বেশী সহায়ক হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।