আহসান মোহাম্মদ
কিলিং মিশন
ফরহাদ মজহার
এক
আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন আমার সামনে ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখের পর থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় আজ অবধি নিহত সেনাকর্মকর্তা ও অন্যদের ফটোগ্রাফ, গণকবর থেকে লাশ খুঁড়ে তোলার ছবি, স্বজনদের আহাজারি। একই খবর একই ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন ভাবে পরিবেশন করা হয়। একই খবর বিভিন্ন গণমাধ্যম বিভিন্ন ভাবে পরিবেশন করে থাকে। ক্ষোভ, বেদনা এবং এই দেশটির জন্য অপরিসীম উদ্বেগ নিয়ে গণমাধ্যমের ভাষ্য থেকেই কী ঘটল আমাকে বুঝে নিতে হচ্ছে। এক দিকে কিছু কিছু গণমাধ্যম নিজেরাই দাবি করছে সশস্ত্র শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এটা একটা ‘বিদ্রোহ’� এটা একটা ‘মিউটিনি’ � কিন্তু একই সঙ্গে সেই গণমাধ্যমেই বিদ্রোহীদের বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে।
অনেকের খবর দেখে ও রিপোর্ট পড়ে মনে হচ্ছিল তারা তাদের দাবি আদায়ের জন্য যে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে তা ন্যায়সঙ্গত বলেই যেন দাবি করা হচ্ছে। গণমাধ্যম� যারা বিদ্যমান রাষ্ট্র, সংবিধান ও আইনের অধীন� তারা বিদ্রোহের খবর অবশ্যই ছাপবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ একটি গুরুতর ব্যাপার। বিদ্রোহের ঘটনাকে খবর হিশাবে প্রচার আর বিদ্রোহীদের বক্তব্য প্রচার ও তার পক্ষে জনসমর্থন তৈরির মধ্যে আইনগত পার্থক্য আছে। এমন নয় যে বিদ্রোহীরা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে এবং ক্ষমতার অবস্থান থেকে তারা বক্তব্য দিচ্ছে, যার কারণে গণমাধ্যমে তাদের বক্তব্য প্রচার না করে উপায় নাই।
অথচ কিছু টেলিভিশান বিদ্রোহী নেতাদের মুখে কাপড় বেঁধে বক্তব্য দিতেও সুযোগ করে দিয়েছে, দেখেছি বিদ্রোহীরা গণমাধ্যমের সহায়তা চেয়েছে বলেই কি এই ঔদার্য? এই সুযোগ দেওয়ার পেছনের যুক্তিটা আমি ধরতে পারছিলাম না। গণমাধ্যমগুলো কি কোন গোপন বিপ্লবী সংগঠনের মুখপাত্র? তারা কি সরকারের উৎখাত চেয়েছে? নাকি সেনাকর্মকর্তাদের হত্যাকে উসকানি তৈরির জন্য বিদ্রোহীদের ক্যামেরার সামনে কিম্বা পত্রিকার পাতায় বিশেষ ভাবে স্থান করে দিয়েছে? জাতীয় সংকটের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে খবর পরিবেশন করা যদি গণমাধ্যমের দাযিত্ব হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে মারাত্মক ঘাটতি ঘটেছে।
পঁচিশ তারিখের দুপুর থেকেই বিডিআর মহাপরিচালক শাকিল আহমেদ ও পনেরো-বিশজন সেনাকর্মকর্তা নিহত হয়েছেন� খবর রটে যায়। ২৬ তারিখের পত্রিকায় সেই সব খবর ছাপা হয়। কিছু কিছু গণমাধ্যম ও পত্রপত্রিকা এই ঘটনাগুলো ঘটছে নিশ্চিত হয়ে যাবার পরেও ঘটনার ভয়াবহতা ও গুরুত্ব বুঝতে পারে নি বলে আমার মনে হয় নি।
বরং অনেকের ভাষ্যকে বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বন বলেই আমার মনে হয়েছে। আমি চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। তাঁরা সেটা করতেই পারেন। কিন্তু ২৫ তারিখ দুপুরের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা� একটি গুরুতর জাতীয় সংকটের মধ্যে আমরা নিপতিত হয়েছি এবং এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। তা ছাড়া জিম্মি ও তাদের পরিবার-পরিজনদের অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি।
কিন্তু ‘ক্ষুব্ধ জওয়ানদের দাবি ও নানান অভিযোগ’ ইত্যাদি শিরোনামে বিদ্রোহী জওয়ানদের বক্তব্য কিছু পত্রিকায় ফলাও করেই প্রচার করা হয়।
এতে আমি বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। গণমাধ্যমগুলো আইন মেনে চলবার কথা। এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধদের দাবি ন্যায্য হতেই পারে। কিন্তু কারা তাদের এই ক্ষোভ আশ্রয় করে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা করেছে? কেন তারা অন্যদের পরিবার-পরিজনসহ জিম্মি করে রেখেছে? এই বিদ্রোহের রাজনীতিটা কী? এই বিদ্রোহের প্রধান উদ্দেশ্য কী? শুধুই কি বিডিআরকে সেনাবাহিনী থেকে আসা প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাদের অধীনস্থতা থেকে মুক্ত করা? এটা কি অভাব-অনটন টাকা-পয়সার দাবি? তাহলে হত্যা কেন? তার আগের দিন শেখ হাসিনা দরবার হলে বক্তৃতা করে এসেছেন, সেই সময় এক অক্ষর চিৎকার বা দাবির পক্ষে ্লোগান আমরা শুনলাম না।
অথচ তার পরদিনই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ না জানা থাকতে পারে। তাহলে তো আরো সাবধানী হওয়া উচিত ছিল। কিছু কিছু গণমাধ্যমে বিদ্রোহীদের রীতিমতো ‘বীর’ রূপে টেলিভিশানের আয়নায় তাদের বক্তব্য প্রচার করবার সিদ্ধান্ত নিতে পারল কী তথ্য ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে?
ছাব্বিশ তারিখের পত্রপত্রিকা পাঠ করে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে বিডিআর জওয়ানদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায় এখানে গৌণ ব্যাপার� যদি তা-ই হোত তাহলে তার ধরন ভিন্নরকম হোত। এ ক্ষেত্রে সেনাকর্মকর্তাদের জিম্মি করে রেখে আলাপ-আলোচনাও একটা কৌশল হতে পারত।
এটা কোন সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাও নয়। পিলখানা থেকে সরকার উৎখাত করা বিডিআর জওয়ানদের পক্ষে সম্ভব নয়, বিশেষত যে সরকার সম্প্রতি বিপুল ভোটে ও বিপুল আসন নিয়ে সংসদে নির্বাচিত হয়ে এসেছে। তা ছাড়া বিদ্রোহীরা শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে নয়। বরং বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা, বিডিআর ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ বাধানো এবং একই সঙ্গে সেনাকর্মকর্তাদের নির্বিচারে হত্যার একটা পরিকল্পনা। নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম� এটা কি কোন ‘কিলিং মিশন’ হতে পারে? প্রথমে মনে হয়েছিল উত্তেজনায় ও ক্ষোভে জওয়ানরা হয়তো গুলি চালিয়ে দিয়েছে।
দুর্ভাগ্য যে ঘটনা শেষাবধি প্রমাণ করেছে� এটা ছিল নিছকই ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার গুপ্ত অভিযান। ‘গুপ্ত’ বলছি এই কারণে যে, আকস্মিক সংঘর্ষে মৃত্যু আর বেছে বেছে ধরে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা সমার্থক নয়। বিডিআর জওয়ানদের ক্ষোভ, দাবিদাওয়া, আশাআকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিবাদ যদি কিছু থাকেও তাহলে এই হত্যা মিশনের রক্তে লাশে নৃশংসতায় চাপা পড়ে গিয়েছে। আফসোস। আজ আমরা শুধু নিহত সেনাকর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবার-পরিজনদেরই হারাই নি, আমরা হারিয়েছি সীমান্তের অকুতোভয় সেই জওয়ানদের যাঁরা দিনের পর দিন বাংলাদেশকে শত্রুর হাত থেকে জীবন বাজি রেখে আমাদের রক্ষা করেছেন।
তাঁরা নিহত হন নি ঠিক। কিন্তু যাঁরা সত্যি সত্যিই জাতির ‘বীর’ হিশাবে পদুয়া-রৌমারীতে ভূমিকা রেখেছেন আজ তাঁদের আমরা ঘৃণায় ও লজ্জায় প্রত্যাখ্যান করছি। আজ বিডিআর বিলুপ্ত করার কথা উঠেছে। এরাই তো সীমান্তে আমাদের জন্য জীবন দিয়েছেন, কিম্বা ভবিষ্যতে দেশ রক্ষার জন্য প্রাণ দিতেন? কখনোই এতো প্রশিক্ষিত সেনাকর্মকর্তা আমরা হারাই নি। কখনোই এতো বিপুলসংখ্যক সৈনিককে জীবিত রেখেও ‘মৃত’ গণ্য করতে আমরা বাধ্য হই নি।
আমরা কী করে আমাদের সীমান্ত রক্ষা করব? ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দয়ার ওপর বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষা হবে?
দুই
পহেলা মার্চ দিবাগত রাত থেকে ‘অপারেশান রিবেল হান্ট’ শুরু হয়ে গেছে। কেউ তাকে পাঁচ কলামে খবর করেছে, অনেকে অন্য খবরের সঙ্গে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছে। অনেকে এটা যে একটা ‘সামরিক অপারেশান’ এবং তার একটা নামও আছে সেই খবরটাই যে কোন কারণেই হোক চেপে গিয়েছে। যেভাবে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে, গণকবরে লাশ লুকাবার জন্য পুঁতে ফেলা হয়েছে ও ভয়াবহ নির্যাতন হয়েছে তার প্রতিক্রিয়া সেনাবাহিনীর মধ্যে কিভাবে পড়ে আমরা জানি না। বিডিআর জওয়ানদের বিক্ষোভ বা বিদ্রোহের কারণ জানা কঠিন কিছু নয়।
আমার ধারণা, এটা কমবেশি সকলের জানা। কিন্তু এই কিলিং মিশনের হোতা কারা? কারা কোথায় কিভাবে এর পরিকল্পনা করেছে সেই দিকগুলো অবশ্যই দেশবাসীকে জানতে হবে। অতএব সেনাসদস্য, র্যাব বা পুলিশ বাহিনীর যারা ‘অপারেশান রিবেল হান্টে’ অংশগ্রহণ করবেন তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে পালিয়ে যাওয়া সৈনিকদের ধরা ও তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেওয়া নয়। সেটাও মূল হোতাদের পরিকল্পনা হতে পারে। বরং এই হত্যাযজ্ঞ যারা চালিয়েছে তাদের শনাক্ত করা এবং পুরো পরিকল্পনা জানা।
আমাদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য এই দিকে নজর রাখা খুবই জরুরি। যেহেতু ক্রসফায়ারে অভিযুক্তদের হত্যা করবার সংস্কৃতিতে আমরা ইতোমধ্যেই সিদ্ধ হয়ে উঠেছি, সেই প্রসিদ্ধ টেকনিক মূল তথ্য জানতে ও পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত উদ্ধার করবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। যদি কাউকে গ্রেফতার করে বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে না এনে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় তাহলে বুঝতে হবে সেটা তথ্য ও সত্য গোপনের মূল পরিকল্পনারই অংশ।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার যে নজির আমরা দেখলাম, সেই দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ওঠা বাংলাদেশের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি না বলা মুশকিল। কিন্তু দুঃস্বপ্ন যদি শুধু দুঃস্বপ্নের সীমার মধ্যে আমরা বেঁধে ফেলতে পারি এবং নিজেদের চিকিৎসার জন্য নিজেরাই উদ্যোগী হই তাহলে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খানিকটা গঠনমূলক ভাবে আলোচনা করতে পারব।
কিন্তু সেই ভরসা আমি খুব একটা পাচ্ছি না। সাধারণ নাগরিক হিশাবে আমার পক্ষে বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল যে এই ঘটনার পরে সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া কিভাবে পড়েছে? কর্মকর্তারা এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডকে কিভাবে দেখছেন? তাঁরা অবশ্যই ক্ষুব্ধ, মর্মাহত এবং অত্যন্ত সঙ্গত কারণে ক্রুদ্ধ। তাহলে কি ‘অপারেশান রিবেল হান্ট’� পাল্টা প্রতিশোধ ব্যবস্থা হয়ে উঠবে মাত্র?
তিন
এ ঘটনা এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে এবং আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনীতি এই ঘটনা� তার নৃশংসতা, ভয়াবহতা এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চরিত্র বা ধরন দিয়েই স্থির হবে। সেই সব বিষয়ে আগামি কিস্তিগুলোতে লিখব। এখন আমাদের দরকার দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থে জাতীয় ঐক্য।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিপজ্জনক মুহূর্তগুলোতে তাঁর জিহ্বার রাশ টেনে ধরতে পারছেন না। এটা খুবই বিপদের কথা। সেনাকুঞ্জে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে যেসব কথা বলেছেন� সংসদে শেখ হাসিনা বলছেন, সকালে সেনা সদরে যেসব কথা শুনে এসেছি, এখানেও বিরোধীদের কথায় সেব বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শুনলাম। তার মানে কী? সেনাসদস্যদের যে ক্ষোভ, দুঃখ, মর্মযাতনা ও সৈনিকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার যে অপমান তাঁর নিজস্ব কোন সত্য নাই� সেগুলো খালেদা জিয়ার কথারই প্রতিধ্বনি? বিরোধী দলের সাহায্য নেওয়া প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার ছেলে বা মেয়ের বিয়ে নয় যে কাউকে দাওয়াত দেবো। ’ জাতীয় সংকট ও বিপন্ন মুহূর্তে বিরোধী দল সম্পর্কে এই উক্তি সৌজন্যের সীমাই শুধু অতিক্রম করে না, একই সঙ্গে এটাও প্রমাণ করে প্রধানমন্ত্রী এতো বড়ো জাতীয় বিপর্যয়কে ছেলের বা মেয়ের বিয়েশাদির সঙ্গে তুলনা করে এই মর্মান্তিক ঘটনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করছেন।
নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিশাবে তাঁকে অবশ্যই বিরোধী দলসহ সকল দলকেই আহ্বান জানানো ও পরামর্শ গ্রহণ কর্তব্য। যদি তিনি সেটা না করেন তাহলে আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনীতির দায়দায়িত্ব তাকে একাই বহন করতে হবে। তিনিই নির্বাহী প্রধান। বাংলাদেশের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা ও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কার্যত তাঁর একনায়কতন্ত্রই কায়েম হয়েছে। অতএব দায়িত্বটা তাঁর।
বিরোধী দল যদি তাঁর ডাকে সাড়া না দেয় বা সহযোগিতা না করে তখন আমরা অবশ্যই বিরোধী দলকেই দোষারোপ করব। আমাদের অনুরোধ দেশের দুঃসময়ে সৌজন্য, ধৈর্য ও বিচক্ষণতাই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা আশা করি। কটু মন্তব্য বা বাঁকা কথা নয়।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলবার কারণ হচ্ছে� একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় অবস্থান আমাদের এখন অত্যন্ত দরকার। এই জন্য দরকার যে তিনি যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন সেই ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
এর কারণে সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে। তাঁর স্তাবকরা তিনি যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন তার প্রশংসা করছে। আমরা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার স্তাবকদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে পারছি না। কিন্তু আমরা সেই জন্য তাঁকে দোষারোপ করতে রাজি নই। যে কোন সরকারই এই ধরনের পরিস্থিতিতে ভুল করতেই পারে।
কিন্তু আমাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ভুল করার অর্থ আমরা সকলেই ভুল করেছি� একেই বলে ‘জাতীয় অবস্থান’। দেশের বিপজ্জজনক পরিস্থিতিতে ভুল-শুদ্ধ সব কিছু নিয়ে একসঙ্গে একত্র থাকা। ভুল কোথায়?
১. দাবি করা হচ্ছে এই বিদ্রোহের মোকাবিলা করা হয়েছে রাজনৈতিক ভাবে। এর অর্থ কী? সৈনিকরা কি ট্রেড ইউনিয়ন করে? তারা কি দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁর কাছে এসেছিলে? তারা দরবার হলে জেনারেল শাকিলসহ অন্য সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা করেছে এবং সশস্ত্র ভাবে বিদ্রোহ করেছে। আশ্চর্য যে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে নয়, তারা বিদ্রোহ করেছে তাদের কমান্ডের বিরুদ্ধে এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
তাহলে এটা একান্তই একটি ‘সামরিক পরিস্থিতি’। এর একমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে ‘সামরিক পরিস্থিতি’কে সামরিক ভাবে মোকাবিলা করা। অর্থাৎ মোকাবিলার ধরন কী হবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্তটি হতে হবে রাজনৈতিক। সেই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সরকার যখন ক্ষমতায় তখন সেনাবাহিনীর পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর দলের কিছু লোককে ভেতরে পাঠানো এবং সামরিক ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ও র্যাবকে বারবার বাধা দেওয়া হয়েছে� আজ এই অভিযোগ উঠেছে।
একটি রাজনৈতিক সরকারের রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার অর্থ সম্পর্কে চরম অজ্ঞতার কারণে এই ভুল হয়েছে, নাকি পরিকল্পিত ভাবেই কোন মহল তাকে বিভ্রান্ত রেখে সময়ক্ষেপণ করেছে� আজ সেই প্রশ্ন উঠেছে। যদি তিনি জাতীয় ভাবে সকলকে নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে এই ভুলের দায় আমরা সকলেই বহন করতাম। এখন দায় তাঁর একার। সময়ক্ষেপণের কারণে হত্যা ও নির্যাতনের যজ্ঞ চালিয়ে যাবার সময় পেয়েছে খুনিরা। পঁচিশ তারিখ সকাল দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে র্যাব ও সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমনের জন্য তৈরি ছিল।
কিন্তু তথাকথিত ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ তাদের বিকল করে রেখেছে।
২. তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যাক যে পরিস্থিতির মোকাবিলা রাজনৈতিক ভাবেই হবে। তাহলে এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষির প্রথম শর্তই হচ্ছে যারা জিম্মি তারা কোথায় কিভাবে আছে সেই তথ্য জানা এবং দেশবাসীকে জানানো। যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং জাহাঙ্গীর কবীর নানক পিলখানায় প্রবেশ করেন তখন কেন তাঁরা সেনাকর্মকর্তা বা তাঁদের পরিজনদের সঙ্গে দেখা করেন নি। নিদেনপক্ষে তাঁরা নিরাপদে আছেন সেটা নিশ্চিত না করে এরপর রাজনৈতিক মীমাংসাটা কিসের মীমাংসা? যাঁদের তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁদের কি এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে নূ�নতম কোন বিশেষজ্ঞতা আছে? যদি না থাকে তাহলে তাঁদের দিয়ে আলাপ-আলোচনার যুক্তি কী?
চার
প্রধানমন্ত্রী যখন ডিএডি তৌহিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তখন প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন ইনি সেই বিদ্রোহের নেতা যাঁরা জেনারেল শাকিলসহ অন্যান্য সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করেছে।
খুনিদের সঙ্গে দেনদরবারে তাদের অন্য যারা সঙ্গী ছিল তারা কারা? তাদের পরিচয় কী? নামধাম কী? কোন রাজনৈতিক বিচারে তিনি সরাসরি খুনিদের সঙ্গে দেনদরবারে বসেছেন এবং তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন? তিনি যখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন তখন কি এরা যে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা করেছে তিনি তো অবশ্যই জানতেন। জেনারেল শাকিলের সঙ্গে হত্যার আগে তাঁর কথা হয়েছে। কিন্তু তাঁর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্যে যে খুনি ও হত্যাকারীরা অন্তর্ভুক্ত নয়, তিনি তো তা বললেন না। সেটা বলেছেন পরে। শুধু তা-ই নয়, ডিএডি তৌহিদকে বিডিআরের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল।
আরো যে সকল প্রশ্ন পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে আমি তার তালিকা দীর্ঘ করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রীর হাত শক্ত করা আমাদের কাজ, দুর্বল নয়। সেই ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয় নেত্রীর আচরণ আমরা আশা করি। জাতীয় বিপর্যয়ের সময় জাতীয় ঐক্যের পক্ষে তিনি থাকেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাঁর স্তাবকরা তিনি কতো ভালো ভাবে পুরো পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন সেই সকল কেচ্ছা গাইতেই পারে।
আমরা শুধু দেখেছি সেনাকর্মকর্তাদের লাশ গণকবর ও নির্যাতনের ভয়াবহ কাহিনী। এখনো সকলের লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নি।
আজ প্রচণ্ড ক্ষোভে ও দুঃখে বলতে হচ্ছে� আমরা শুধু বিপুলসংখ্যক সেনাকর্মকর্তাকেই হারাই নি, হারিয়েছি বিডিআরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকেও। বিডিআর ধ্বংস হয়েছে� বহু নিরপরাধ বিডিআর জওয়ানের জীবনও আজ ধ্বংস হবে। বহু পরিবার বিনষ্ট হবে।
বহু জীবন ধুঁকে ধুঁকে মরবে। কে এই দায় নেবে?
রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে এই ধুরন্ধর সফল কিলিং মিশনের ধ্বংসযজ্ঞ কোথায় শেষ হবে কে জানে!
১৮ ফাল্গুন ১৪১৫। ২ মার্চ ২০০৯। শ্যামলী
(সুত্র, নয়া দিগন্ত, ০৩/০৩/২০০৯)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।