শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর।
সসাগরা সদ্বীপা রাজ্যের মার্তণ্ডপ্রতাপ রাজা পারিষদবর্গ লইয়া মৃগয়ায় বাহির হইয়াছেন। শিকার করিতে করিতে রাজ্যের গহন অরণ্যে যাইয়া উহারা এক কস্তুরি মৃগের সাক্ষাত পাইলেন। রাজবৈদ্যগণ এমৎ মৃগের নানাবিধ অলৌকিক গুণ সম্পর্কে রাজাকে পূর্বাহ্নেই জ্ঞাত করাইয়াছিলেন। রাজা তাই বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে গর্জিয়া উঠিলেন, "এই মৃগ আমার চাই।
যদি উহা পলায়ন করে, তাহা হইলে যাহার সন্নিকটবর্তী হইয়া পালাইবে, তাহার দক্ষিণ শিরে গর্দান লওয়া হইবে। "
রাজ-অনুচরগণ ত্রস্ত সন্ত্রস্ত্র হইয়া ক্ষীপ্রগতিতে মৃগের চতুর্দিকে পরিবেষ্টন করিল, বেষ্টনি ক্রমে ক্রমে ক্ষুদ্রতর হইতে লাগিল। হঠাৎ কস্তুরি মৃগটি শূন্যে লাফাইয়া উঠিল, এবং পরক্ষণে ভূপতিত হইয়া সবেগে রাজার সন্নিকটবর্তী বেষ্টনির ফাঁক দিয়া পালাইয়া গেল। রাজা বায়ুবেগে মৃগের পশ্চাতে অশ্বচালনা করিয়া দিলেন; অনুচরগণ রাজাকে অনুসরণ করিবার প্রয়াস পাইতে লাগিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে অনুচরের দল রাজাকে হারাইয়া ফেলিয়া দিগ্বিদিক ছড়াইয়া পড়িল, শুধু রাজা বিদ্যুদ্বেগে মৃগের পশ্চাতে লাগিয়া রহিলেন।
মৃগটি বড় সহজ প্রাণী ছিল না; রাজা এইক্ষণে উহাকে দেখিতে পান তো পরক্ষণেই উহা বৃক্ষ গুল্মের আড়ালে চলিয়া যায়। রাজা এবং অশ্ব উভয়েই সত্বর শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত হইয়া উঠিল। স্বেদ ধারায় রাজার শরীর সিক্ত হইয়া গেল, কিন্তু গভীর আক্রোশে ও মনের দৃঢ়তায় তিনি হাল ছাড়িলেন না।
অনেকক্ষণ অতিক্রান্ত হইবার পর রাজা মৃগটিকে হঠাৎ অতীব নিকটে দেখিতে পাইয়া কোষ হইতে অসি নিষ্কাশন করিলেন এবং উহার দিকে অসি সংহার করিলেন। কিন্ত অশ্বটি একখানি বৃক্ষের উপর সবেগে আছড়াইয়া পড়িল আর রাজা অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ছিটকাইয়া পড়িলেন গুল্ম ঝোঁপের উপর।
অশ্বের প্রাণবায়ু নির্বাপিত হইল; রাজা গুল্ম ঝোঁপ হইতে ভূলুণ্ঠিত হইলেন। রাজার অবস্থাও শোচনীয়, তৃষ্ণায় তাহার বুকের ছাঁতি ফাটিয়া যাইতে লাগিল, ক্ষুৎ-পিপাসা-বেদনায় উঠিবার শক্তি রহিত হইয়া গেল। সসাগরা সদ্বীপা রাজ্যের মার্তণ্ডপ্রতাপ রাজা চলৎশক্তিহীন হইয়া চক্ষু মুদিয়া নিজ রাজ্যের বিজন বনে বন্ধুহীন করুণ মৃত্যুর অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে রাজার ঠোঁটে হঠাৎ অমৃত বর্ষণ হইতে লাগিল। অমৃতরস ধীরে ধীরে রাজার শিরায় শিরায় বহিয়া গেল, শরীরে জাগিয়া উঠিল প্রাণের স্পন্দন, মুদিত আঁখি উন্মীলিত হইল।
রাজা দেখিলেন একখানি মায়া ভরা মুখ তাকাইয়া আছে।
প্রজা রাজাকে চিনিতে পারিল না, কিন্তু গভীর মমতায় রাজাকে নিজ ডেরায় বহিয়া লইয়া গেল ও শুশ্রুষা করিয়া সুস্থ্ করিয়া তুলিল। অতঃপর রাজা বিদায় লইয়া রাজধানী অভিমুখে গমন করিলেন।
কিয়ৎদিবস পরে একদল অশ্বারোহী ও একটি ঐরাবত বাহন ব্যাপক সমারোহে প্রজাকে রাজদরবারে লইয়া আসিল। প্রজা অবাক হইয়া গেল, কিন্তু রাজদরবারে পৌঁছিয়া রাজাকে দেখিতে পাইয়া সামগ্রিক তত্ত্ব বুঝিতে পারিল।
রাজাকে আনন্দিত দেখিয়া প্রজাও খুশি হইল।
রাজা সভাসদদিগের সাথে প্রজাকে পরিচয় করাইয়া দিবার পর বলিলেন, "হে বন্ধু, একদা তুমি আমাকে মৃত্যুর হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছ। আজিকে আমি উহার উপযুক্ত মূল্য দিব। বল তোমার কী কামনা? আমার রাজ্য ঐশ্বর্য্য হইতে তুমি তোমার যাহা খুশি বাছিয়া লও। "
পারিষদরা বলিয়া উঠিল, "বাহবা, বা! সসাগরা সদ্বীপা রাজ্যের অধিপতি মার্তণ্ডপ্রতাপ রাজার উপযুক্ত ব্যবহারই বটে ইহা।
"
প্রজা লজ্জিত হইয়া বলিল, "আমার কিছুই প্রয়োজন নাই, রাজাধিপতি। " পারিষদবর্গ প্রজার মূঢ়তায় হাসিয়া উঠিল।
রাজা কহিলেন, "না, তোমার কিছু লইতেই হইবে, বন্ধু। যাহা তোমার অভিলাষ, আমার কাছে নিঃসঙ্কোচে ব্যক্ত কর। তোমার ঋণের উপযুক্ত প্রতিদান আমি দিতে চাই, ঋণগ্রস্ত থাকিয়া যাওয়া আমার অভিপ্রায় নহে।
"
রাজার পীড়াপীড়িতে প্রজা অবশেষে বলিল, "তাহা হইলে, রাজাধিরাজ, আমি শুধু যে জল আপনাকে পান করাইয়াছিলাম, উহার মূল্য দিলেই চলিবে। "
রাজার অঙ্গুলিনির্দেশে মুহূর্তের মধ্যে রাজ্যের সুপরিষ্কার সুপেয় সর্বোৎকৃষ্ট পুষ্করিণী হইতে ভিস্তি ভরিয়া প্রচুর জল আসিল; পারিষদগণ প্রজার নির্বুদ্ধিতায় আবারো হাস্যধ্বনি করিল।
প্রজা শান্তভাবে বলিল, "রাজাধিরাজ, আমি আপনাকে যে জল পান করাইয়াছিলাম, উহার মূল্য অতি সামান্য। এঁদো পুকুরের জল, পানা সরাইয়া আমি আপনকার জন্য আনিয়াছিলাম। শুধু ঐটুকু জল, যাহা আপনকার মুখে ঢালিয়াছিলাম, ফিরাইয়া দিলেই উহার মূল্য শোধ হইয়া যাবে।
এতসব মূল্যবান সুপরিষ্কার জলের প্রয়োজন নাই। "
রাজা ও পারিষদবর্গ প্রজার দিকে অবাক হইয়া তাকাইয়া রহিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।