আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোয়া তের জনের দ্বীপদর্শন

সাব্বির ভাইয়ের জন্য আরো দশ লাখ টাকা দরকার। মানবতার দিকে তাকিয়ে আছি।

একটানা তিনদিনের 'ওবং হলিডে' জাপানে। ৩৫ ডিগ্রীর খটখটে সামার উপেক্ষা করে পুরা জাপান বাসার বাইরে। একটা মানুষও পাওয়া দুষ্কর যারা কোথাও ঘুরতে যায়নাই।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অধিকাংশ অফিস বন্ধ। পোলাপাইন ক্যাম্পাসেও ঢুকতে পারবনা, আদেশ জারি হইছে। কী আর করা। তের জন মিল্লা ঝটিকা প্ল্যান, ঘুরতে যামু। দলে ফুল ব্যাচেলর, ম্যারিড ব্যাচেলর তো আছেই, আড়াই বছরের তূর্ণ-সহ মোট সোয়া তেরজন।

দুইটা চয়েস থিকা হ্যাঁ ভোটে জয়যুক্ত হল যে স্পট সেটা টোকিওর ৫০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমের একটা ঐতিহাসিক শহর 'কামাকুরা' আর তার লাগোয়া একটা ট্যাব্লেট সাইজের দ্বীপ 'এনোশিমা'। এনোশিমা-র গুগল ভিউ সকাল আটটা সতের-র ট্রেনে চেপে ফুজিসাওয়া পৌঁছালাম দু'ঘন্টা পর। এখান থেকে ইলেক্ট্রিক ট্রেন (ট্রাম) এ চড়ে কামাকুরা যাব। ব্যস্ত টোকিওর পেটের ভেতর ট্রামে চড়ার কল্পনাই করা যায়না। সরু রাস্তা ধরে, বাড়িগুলোর প্রায় উঠোনঘেঁষে ট্রেন দুলকি তালে চলছিলো।

সবাই এহেন যানে চড়তে পেরে ফুল ভল্যুমে আহা উহু করতে থাকলো। মনে হচ্ছিলো দু'ঘন্টার এক ধাক্কায় শতবছরের পুরনো জাপানে কেউ ফেলে এনেছে আমাদের। কামাকুরা যাওয়ার পথে ট্রেনের ভিতর থেকে প্রশান্ত দর্শন বীচ ধরে শিকড় গেড়েছে ট্রেন লাইন। ডানে উত্তাল প্রশান্ত-কে রেখে বাঁয়ের জঙ্গলের স্পর্শ থেকে কোনমতে গা বাঁচিয়ে ট্রেন পৌঁছে গেল কামাকুরা স্টেশন। ১১৯২ সালে মিনামতো ইউরিতোমো-র সামরিক সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের পর থেকেই এ শহরের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।

চতুর্দশ শতকে কামাকুরা সরকারের পতন হলেও অসংখ্য Temple, Shrine থাকার কারণে ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে এ শহরটি। মধ্যদুপুর, চর্বিগলানো রোদ। প্রতিকূল আবহাওয়ায় কে যে ঘোরার চিন্তা মাথায় আনছিলো । ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে সবাই দেখি আমার দিকে সরু চোখে তাকায়, আমি আরো ছাতার নীচে মুখ লুকাই । এমন ভাব করতে থাকলাম যে জাপানে যারা কামাকুরা ভ্রমণ করেনি তাদের ফুজিয়ামার উপর থেকে লাফ দেয়া উচিত আর ভুলক্রমে সপ্তাশ্চর্যে কামাকুরার কোন দর্শনীয় স্থানকে যুক্ত করা হয়নি।

হাতে নেই ম্যাপ। সবাই যেদিকে হাঁটে, আমরাও পেছন পেছন ছুটলাম। গন্তব্য Hachimangu Shrine। ১১৮০ সালের স্থাপনা এটি। প্রতিটি Shrine এই যে বৈশিষ্ট্যগুলি থাকে, এখানে তার ব্যতিক্রম হলোনা।

ঢোকার মুখেই বিশালকায় 'তরি' বা ফটক (ফটুক নীচে)। এরপরেই ঝর্ণার পবিত্র পানি পান করার একটা ব্যাপার সেপার থাকে। আমরা মহানন্দে সেই পবিত্র পানি দিয়া মাথা, মুখ, পা ধোয়া শুরু করলাম । ঘোরাঘুরি শুরুই হয়নাই, গরমে সবার অর্ধসিদ্ধ অবস্থা। দলের মধ্যে যাদের ছাতা নাই তারা দেবদাসের মত ঘোরাফিরা করতে থাকল আর ভাগ্যবানরা বিশ্বজয়ের আনন্দে ছাতা মাথায় ফটুক তোলা নিয়া ব্যস্ত।

ধর্মীয় নৃত্য বা গীতিনাট্যের মঞ্চ একজায়গায় দেখি গুটুগুটু মুখোশ বিক্রি করতেছে পাশাপাশি আরো কয়েকটা ছিল, কিন্তু এক Shrine দেখেই আমরা ইস্তফা দিলাম। Mac এ আইসা লাঞ্চ সেরে পরবর্তী স্পট কামাকুরা বীচের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম আবার ট্রামে চেপে। বীচে নাইমাই অভিযাত্রী দল পড়িমড়ি করে ছুটলো পানির দিকে। দাপাদাপি করতে করতে প্রায় সাড়ে তিনটা বাজায়া দিলাম। এনোশিমা দ্বীপে তখনো যাওয়াই হয়নাই।

এনাম ভাই, সাদেক ভাইর জসিলা সাঁতরানি দেইখা উতসাহের চোটে সুমন ভাই ২৫ ডলার দিয়া দোকান থিকা শর্টস কিনা নামলো পানিতে। শখের দাম লাখ টেকা। এইখানে শেষ হইলে ভালোই হইত। বেচারারা সাগর থাইকা পারে আইসা একটা গণশাওয়ারে ঢুকছে পরিষ্কার হইতে। এক মহিলা ক্যাঁক কইরা ধরলো, আটশ ইয়েন লাগব।

আমরা বাইর থিকা বেচারাগো এই দুরবস্থা দেখে গড়াগড়ি । আটশ ইয়েন উসল করার জন্য একেকজন শ্যাম্পু, কন্ডিশনার দিয়া গোসল সাইরা, ড্রায়ার দিয়া চুলটুল শুকায়া হিরো হয়া বাইরে আসলো। আমরা এইদিক খেইপা বেগুনসিদ্ধ, এতো টাইম নষ্ট । তবে যখন ওদেরকে দেখাইলাম বিনা পয়সায় সবাই সরকারি টেপের পানিতে গোসল করতাছে, তখন বেচারাগো চেহারা দেখার মত হইল আবারো ট্রামে চেপে হাসে স্টেশনে নামলাম। জায়গার নাম হাসে হলেও বিকালের পড়ন্ত রোদ্দুরে আমাদের কানতে বাকি।

স্টেশনের বাইরেই জিন-রিকশা বা মানুষটানা রিকশা রাখা। চড়া দামে ট্যুরিস্টরা ঘুইরা বেড়াইতেছে। এইখানে ব্যবসার একটা ভালো সম্ভাবনা পায়া সুমন ভাই ঝলসায়া উঠল। তার নাকি আবার রিকশা চালনার অভিজ্ঞতা আছে। যাই হোক, গন্তব্য Great Buddha।

গৌতম বুদ্ধের বিশালকায় ব্রোঞ্জের মূর্তি। ১৩.৩৫ মিটার উচ্চতার এই মূর্তিটি জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধমূর্তি। ১২৫২ সালে এটিকে মূলত Temple এর অভ্যন্তরে স্থাপন করা হলেও পনের শতকের সুনামির কারণে জোয়ারের পানিতে এর বেষ্টনি ভেঙ্গে পড়ে। তখন থেকেই এটি ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত স্থানে বসানো আছে। এদের খালি ব্যবসা।

মূর্তির পেটে ঢোকা যাবে, সেখানেও টিকেটের লম্বা লাইন। দেখলেও পস্তামু, না দেখলেও পস্তামু এই ভেবে আমরা সোৎসাহে ঢুকলাম। ১০ সেকেণ্ড থেকে গরমে ছিটকে বের হয়ে আসলাম। আর দেরি করা যায়না, ছুটলাম এনোশিমার উদ্দেশে। ব্রিজ পার হয়ে দ্বীপের মুখে জড়ো হয়ে হেঁটে পুরা এলাকাটা ঘোরার সিদ্ধান্ত হল।

দ্বীপের শুরুতে সাগরের হু হু বাতাস আর ঊষার প্রস্তুতি, চমৎকার আবহাওয়াতে আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি অলক্লিয়ার হয়ে গেছে। সবচে' ভাল্লগছে লাইটহাউজ থেকে পুরা দ্বীপ আর প্রশান্তের শান্ত সৌম্য রূপটা দেখতে। লাইটহাউজ লাইটহাউজের চান্দি থেকে তোলা দ্বীপে ঢোকার পথের ছবি প্রাকসান্ধ্য এ মুহূর্তগুলি বর্ণনায় আনা সম্ভব নয়, শুধুই অনুভবে মেখে নিলাম। সাগরের নোনা ভালোবাসা বাক্সবন্দী করে সবাই আবারো রেলে চাপলাম ফিরতি পথে। সোয়া তেরটা মনের একদিন বেমক্কা পুরে নিল মহাসাগরের বখাটে ঢেউ।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.