আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপর্যয়ের এগারো বছর........./ভাস্কর চৌধুরী

সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...

ট্র্যাজেডি অব মাগুরছড়া কাল পরিক্রমার বর্ষপঞ্জিতে আবার ঘুরে এলো ১৪ জুন। আর সেই সাথে যুগ হলো মাগুরছড়া বিপর্যয়ের আরো একটি বছর। ১৪ই জুন মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিষ্ফোরণের এগারো বছর পূর্তি হলো। ১৯৯৭ সালের এইদিনে মধ্যরাতে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে মাগুরছড়া ১নং অনুসন্ধান কুপে খনন চলাকালে এক ভয়াবহ বিষ্ফোরণ ঘটেছিলো। প্রায় ৫০০ ফুট উপরে উঠেছিল সেই আগুনের লেলিহান শিখা।

বিষ্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল মাগুরছড়া গ্যাস ব্লকসহ রেলপথ, সড়কপথ, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, আদিবাসি খাসিয়াদের পানপুঞ্জি ও বৈদু্ত্যিক লাইন। তখন অনেক চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল এই গ্যাস কুপটি। যার কারণে মাটির নিচে থাকা উত্তোলনযোগ্য প্রায় ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়েছিল (তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ) আর তখন থেকে ৬ মাসেরও অধিককাল ধরে উদঘীরিত গ্যাসের উৎসমুখ সীল করা হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি। সেই থেকে আজ অবদি এই দিনটি মাগুরছড়া দিবস হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরই এই দিনটিতে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও তুলে ধরা হচ্ছে মাগুরছড়ার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৬ সাল সময় পর্যন্ত ২টি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাসীন হলেও এর ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে কেউ কোন সুরাহা করতে পারেনি। ২০০৭ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন হয়েও মাগুরছড়ার ক্ষয়ক্ষতি আদায়ে এখন পর্যন্ত তাদেরও কোন উদ্যোগ নেই। উপরন্তু মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের শেয়ার হাত বদল করে ইউনিকল ও সর্বশেষ শেভরন কোম্পানিকে আবারো মাগুরছড়া গ্যাসকূপের ১৪নং ব্লকে নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি দেওয়া হয়। একই সাথে দেশের ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে একটি মিশ্র চিরহরিৎ বর্ষরণ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও তেল গ্যাস অনুসন্ধানের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে শেভরনকে। মাগুরছড়া গ্যাসকুপ বিষ্ফোরণের পরপরই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এর অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

তদন্ত একমাস অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯৯৭ সালের ৩০শে জুলাই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ডঃ তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীর নিকট প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করে। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টালের খাম খেয়ালীর কারণেই ঘটে যাওয়া এ বিষ্ফোরণে চা-বাগান, বনাঞ্চল, বিদ্যুৎ লাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপ লাইন, গ্যাসকুপ, মৌলভীবাজার স্ট্রাকচার, গ্যাস রিজার্ভ, পরিবেশ প্রতিবেশ, ভূমিস্থ পানিসম্পদ, রাস্তাঘাট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বনাঞ্চলের ৬৫·৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পুর্ণবয়স্ক নানা বিরল প্রজাতির বৃক্ষ আগুনে পুড়ে গেছে বলে হিসাব করা হয়। একটি বনের স্বাভাবিক উচ্চতায় গাছ বাড়তে প্রয়োজন হয় ৫০ থেকে ৬০ বছর। তদন্ত রিপোর্টের ৮·৪·৬ ও ৮·৬ অনুচ্ছেদ যথাক্রমে ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়নি। ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নিরূপনের সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মাগুরছড়ার মোট ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তৎকালীন সময়ে বিশাল এ ক্ষতির বিষয়টি সরজমিনে প্রত্যক্ষ করতে পরিবেশ মন্ত্রী ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও মাগুরছড়া এলাকা পরিদর্শন করেন। অক্সিডেন্টাল কোম্পানী ১৯৯৯ সালের আগষ্ট মাসে তাদের শেয়ার ইউনিকল নামের অপর মার্কিন কোম্পানীর কাছে হস্তান্তর করে দেয়।

কিন্তু এর আগেই ১৯৯৮ সালে অিডেন্টাল তৎকালীন সরকারের সাথে মাগুরছড়ার ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি উহ্য রেখে একটি সাপ্লিমেন্টারি (সম্পূরকচুক্তি) করে নেয়। ইউনিকল দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্ষতি পুরণের বিষয়ে অসংখ্য বার বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়েল সাথে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক কোন সুরাহা হয়নি। পরবর্তীতে ইউনিকল তাদের সবকিছু শেভরনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। সম্প্রতি শেভরন আবারো মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের অর্ন্তগত ১৪নং ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধান (সিসমিক সার্ভে) জরিপ কাজ শেষ করেছে।

আর মাগুরছড়া বিষ্ফোরণে অিডেন্টালের নিকট থেকে বনবিভাগ তখন কোন ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পারার কারণেই আবারো লাউয়াছড়ায় জরিপ কাজ চালানোর অনুমতি দিতে হয়েছে শেভরনকে। মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের মাগুরছড়া গ্যাসব্লকের অন্তর্গত এই গ্যাসত্রেটিও দেশের অর্থনীতি উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটাতে পারতো। তাই দেশ প্রেমিক প্রতিটি নাগরিকের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয় এ বিশাল অঙ্কের ক্ষতি। ১৮৭২ সালের চুক্তিআইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কোন চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখা দরকার কোন চুক্তি যদি গণনীতির বিরুদ্ধে হয় ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি হয় সেই ধরনের সকল চুক্তি বাতিলযোগ্য। তাই আশা করি বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ জাতীয় স্বার্থ এবং বন স্বার্থ রক্ষা করতে মার্কিন কোম্পানির সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি পুর্ণঃবিবেচনা করে মাগুরছড়ার ক্ষয়ক্ষতি আদায় করতে উদ্যোগী হয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.