ভাবে মন অকারণ সারাক্ষণ...যখন বাস্তবতা>আবেগ
আমার ছিল ছোট্ট একটা গাঁ। তাতে সবসময় লেগে থাকত এক ফোঁটা সবুজ। একটু বোধ হয় ভুল বললাম। এখনও সেই সবুজের কিন্তু তেমন একটা হেরফের হয়নি। মফস্বলে বেড়ে ওঠা আমি সবসময় দুরন্তপনাতেই খুঁজে নিয়েছি জীবনের সহজ সরল মানে।
তো যা বলছিলাম,আমার গ্রামের কথা।
বাবার চাকরিতে বদলির সাথে সাথে ঘুরে বেরিয়েছি অনেক জায়গা। তারপরও একটা বাঁধাধরা নিয়ম আপনা-আপনিই গড়ে উঠেছে-পরীক্ষা শেষেই দাদাবাড়ি চলে যাই। এখনও এর ব্যতিক্রম হয় না। এই যে আজ পরীক্ষা শেষ হল।
দাদাবাড়ি থেকে একটার পর একটা ফোন আসছে,কবে যাব কবে যাব। ওদের আশ্বস্ত করি,পরশুই রওনা দিচ্ছি। পিচ্চিরা খুব খুশি। লিস্ট দিয়েছে ওদের কার কি আব্দার তার। কাল বের হব সেসবের কেনাকাটা করতে।
আমার মা সবসময় চেয়েছেন যেখানে আমার নাড়ী পোঁতা সেই নাড়ীর টানটা যেন কখনোই আলগা হয়ে না যায়। তাই দাদাবাড়ির গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধটা আমি এই ইট-কাঠ-রড-সিমেন্টের মাঝেও প্রাণের টানে অনুভব করি।
আব্বুরা ছয় ভাই। ছয় ভাই এক এরিয়ার ভেতরেই একই ডিজাইনে বাড়ি করেছেন। আগে ছিল মাটির বাড়ি।
একটা ছিল টিনের ঘর। যখন বৃষ্টি হত,টিনের চালের ওপর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুনতে শুনতে কেমন একটা নেশা ধরে যেত-সে তো অনেক আগের কথা। আমি তখন ভীষণ ছোট। অনেক ছোটবেলার কথাও আমার বেশ মনে আছে। তাই এখনও চোখ বন্ধ করলে সেই বাড়ি,সেই বেলের গাছ,বাতাবী লেবু দিয়ে ফুটবল খেলা সবই মনে পড়ে।
টিনের চাল,মাটির বাড়ি ভেঙে ফেলা হল,দাদীর লাগানো কামিনী ফুলের গাছ তুলে ফেলা হল-খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আব্বুকে বলেছিলাম,যেন দালানবাড়ি করতে গিয়ে সবকিছু কাঠখোট্টা করে না ফেলে। শুধু আব্বু না,আর সব চাচারাও ব্যাপারটা মনে রেখেই বাড়ি করেছেন।
আমাদের বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন। বাউন্ডারি পেরিয়ে পাকা রাস্তা।
তারপর শুধু সবজু আর সবুজ ধানতে। প্রতিটা বাড়ির ভেতরেও উঠোন। বারান্দা আমার খুব প্রিয়। এই ইট-কাঠের শহরে এসে বারান্দার অভাবটা খুব বেশি গায়ে লাগে। তাই চাচারা সবাই বাড়ির সামনে বারান্দা করেছেন যাতে আমি গেলে সেখানে বসে রাস্তা দেখতে পারি।
দাদাবাড়িতে যখন কারেন্ট থাকে না,তখন সেই অন্ধকারকেও খুব আপন মনে হয়। জোছনা রাতে সবাই মিলে পাটি পেতে উঠোনে বসি,সেই সাথে চলে গানের আসর। সবকিছু কেমন তখন অতিপ্রাকৃত অতিপ্রাকৃত লাগে,জোছনার বৃষ্টি গায়ে মেখে নিতে নিতে একেবারে কাকভেজা হয়ে যাই।
বাড়ির পেছনে আছে দীঘি। আর তারপর বিরাট বিল।
সেখানে বসার জন্য মাচা করা আছে। বিকেল বেলা সেখানে বসলে কী যে ভাল লাগে!আগে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। শাপলা তুলতাম,ভ্যাট তুলে খেতাম।
মনে পড়ে ছোটবেলায় এই দীঘি আর বিলে কত মাছ মেরেছি। ছিপ দিয়ে মাছ মারতে মারতে কখন যে বেলা বয়ে যেত তার খেয়ালই থাকত না।
এখনও গেলে ছিপ নিয়ে বসে যাই। আমার ছোট চাচী মাছ মারতে জানতেন না। তাকে ছিপ দিয়ে মাছ মারা শেখাতে গিয়ে সে কী কান্ড! আর আমার মা'র মাছ মারা দেখে সবাই অবাক হত। মা'র কাছ থেকেই অবশ্য আমি মাছ ধরার নেশাটা পেয়েছি।
সবচেয়ে মজা হত যখন বিলের পানি কমে যেত।
কাদায় পা ডুবিয়ে গ্রামের আর সবার সাথে নেমে যেতাম মাছ ধরতে। দাদী অপেক্ষা করতেন কখন মাছ নিয়ে আসব। যেদিন মাছ বেশি পেতাম সেদিন আমার খেলার সাথীদের প্রত্যেকের বাড়িতে মাছ পাঠিয়ে দিতাম। তারপর সে মাছ কাটা হত। উঠোনে ভাজা হত।
দেখা যেত মাছগুলোর আর ভাগ্য হত না টেবিল পর্যন্ত যাবার। চুলার পাড়েই চাচীরা,আমরা ছোটরা মিলে একটু একটু করে খেতে খেতে শেষ!
নাক-উঁচু স্বভাবটা আমার কোনদিনই ছিল না। তাই গ্রামের আর দশটা ছেলেমেয়েদের সাথেও ছিলাম স্বচ্ছন্দ। ওরাও অপেক্ষা করত কখন আমরা যাব। গিয়ে কোনরকম কাপড়টা পাল্টেই চলে যেতাম খেলতে।
কত খেলা যে খেলতাম!পুকুরের ঝাঁপাঝাঁপি তো ছিলই। আব্বু এসে বলতেন-এরপর কিন্তু তোর মায়ের বিশাল প্যাদানি খাবি!তাড়াতাড়ি ওঠ।
আমি থোড়াই কেয়ার করি!চোখ-টোখ লাল করে বাড়িতে যেতাম। মা প্রথমে চোখ বড়বড় করে তাকাতেন। তারপর হেসে ফেলে গা-হাত-পা মুছিয়ে দিয়ে উঠোনে বসিয়ে খেতে দিতেন।
মা যে কেমন দুরন্ত ছিল সে কি আর আম জানি না!
আমার একজন বন্ধু ছিল-শহীদুল,সে ছিল মানসিক প্রতিবন্ধী। ওকে কেউ খেলায় নিত না। আমি যখন যেতাম তখন আর সবার মত সে-ও হত আমার বন্ধু। কখনও তাকে আলাদা করে দেখিনি। এভাবে এক সময় আর অন্য সবাইও ওর সাথে সহজ হয়ে যায়।
আমার কাছে তার অন্যরকম দাবী ছিল। ওর চোখে সবসময় অন্যরকম এক কৃতজ্ঞতাবোধ দেখতাম আমি। আর তা থেকেই হয়ত আমাদেও খেলার সবচাইতে কঠিন কাজগুলো সে করে দিত। আমার ছোটবেলার এই নিঃস্বার্থ বন্ধুটার জলাতঙ্কে মারা যাবার ঘটনা আজও আমার মনে না শুকানো ক্ষতের মত জেগে আছে।
যখন ইউনিয়ন পরিষদের ইলেকশন হত সে তো ছিল আরেক হুলস্থূল কাণ্ড।
রাত জেগে কত গল্প-আড্ডা,মাইকিং,মিছিল। আর চলত একের পর এক লাইন ধরে নারকেলের খোলে করে গুড়ের চা খাওয়া। শীতের রাতে তো ঘুমানোর প্রশ্নই আসে না। রাজ্যের যত গল্প সব হৈ-হল্লা করে করা হত। ভোর হতে না হতেই সব ভাইবোনেরা শিশির ছোঁবার জন্য দৌড়. . . .!কে কত লজ্ঝাবতীকে ঘুম পাড়াতে পাড়ে তার প্রতিযোগিতাও চলত।
মাঝে মাঝেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-আলু-ডিম তুলে পিকনিক করা হত।
আমাদের ওখানে পোড়াদহের মেলা নামে একটা ঐতিহ্যবাহী মেলা হয়। এখন আর যাওয়া হয় না। ছোটতে তো রাতের ঘুম হারাম করে লিস্ট করতাম কে কি কিনব। মেলা থেকে ফিরে রাতজাগা অপক্ষা শুরু হত আমাদের-কখন আব্বু আর চাচারা ফিরবেন মেলা থেকে সবচেয়ে বড় মাছটা নিয়ে।
গভীর রাতে আব্বুরা ফিরতেন মাছ নিয়ে। মা আর চাচীরা বসে যেতেন মাছ কুটতে। তারাপর ভাত রান্না হত,মাছ রান্না হত। আমরা হয়ত জেগে থাকতে পারতাম না অত রাত পর্যন্ত,না খেয়েই ঢুলতে ঢুলতে ঘুমিয়ে যেতাম। আমাদেরকে টেনে তোলা হত।
চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে মাঝরাতের দিকে সবাই খেতে বসতাম। গরম গরম ভাত আর মাছের ঝোল- সে স্বাদ এখনও ভুলতে পারি না।
আজও দাদাবড়ি গেলে আমি তেমন আনন্দই করি। পিকনিক হয়,মাছ মারি,ভ্যানে চড়ে গোলাবাড়ি বাজারে চলে যাই। যাদেরকে নিয়ে আমি অনুষ্ঠান করি,ওরাও আসে,যে যেমন পারে কিছু না কিছু নিয়ে আসে।
তারপর একটু ভয় ভয় করে বলে- আপু তোমার জন্য। কেউ ছবি এঁকে আনে,অনেকে অনেক কিছু বানিয়ে আনে। আমি তখন ওদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলি-আরে!দারুণ তো!তখন ওদের চোখে খেলে যায় খুশির ঝিলিক-তাকে আমি কোন কিছুর সাথেই তুলনা করতে চাই না।
সবাই বলে আমি নাকি সেই ছোটটাই থেকে গেছি। দুই পাড়ার মধ্যে ক্রিকেট খেলা হলে সে যে কী টেনশন!জিততে পারলে জোশ পিকনিক হয়!গিয়ে যদি বলি-এই শাহীন শোন্ তো,রহমত এই কাজটা করে দে না ভাই!ওরা জানপ্রাণ চেষ্ট করে কাজটা করতে।
সবাই মিলে যদি আনন্দটা না করলাম তাহলে আর কি হল!
আগে সবাই মিলে উঠোন লেপতাম,এটা আমার কাছে অনেক মজা লাগত। সবাই অনেক অবাক হত। কিন্তু মা বলত-সব শিখতে হবে। শিখুক,অভিজ্ঞতা থাক,ক্ষতি কি!
একটাই আফসোস,মাছ কুটতে পারি না। দাদী কখনোই মাছ কুটতে দিত না।
সেই আহ্লাদে এই অবস্থা আর কি!
মজা হয় এখন বাড়ি গিয়ে যখন চা বানাই। এত মানুষ যে অত কাপই থাকে না। তখন হয় দুই-তিন সিটিং-এ খাওয়া হয় নয়তো সব যার যার গ্লাস নিয়ে এসে ওয়েট করে। সে এক দেখার মত দৃশ্য!একবার মনে আছে,আমার ছোট চাচার বৌভাত। মা কাবাব বানাচ্ছে।
আমরা পিচ্চিরা একটু পর পর এস কাবাব খেয়ে যাচ্ছি। মা অতটা খেয়াল করে নি। আর সবাইও একটা-দুটা করে খাচ্ছে। তারপর যখন কনেপক্ষ এসে হাজির তখন দেখা গেল ডালিতে মাত্র চার-পাঁচটা কাবাব-আর কিচ্ছু নাই!হা হা হা । মা'র তো মাথায় হাত।
আমাদের ছোটদের দেওয়া হল এক দাবড়ানি-আমরা তো যে যেদিক পারি ভোঁ দৌড়!
পরে কার যেন মনে হল-আরে!অতিথিদের যে বরণ করবে,নিশুতি পাখি (আমাকে আদও করে ডাকে) ছাড়া আর কোন মেয়ে নাই,সব তো ছেলে। আমাকে আবার খুঁজে-পেতে গোয়াল ঘর থেকে টেনেটুনে বের করে আনা হল। আমি তো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছি-সাজুগুজু করি নাই কিছু না। কি করে যাই অতিথি বরণ করতে!শেষমেশ এক গালে ফেস পাউডার মাখিয়েই পাঠানো হল কনেপক্ষকে বরণ করতে।
এখন আমি হাসি আর বলি-আমার বিয়েতে আমার চাচীদের পাঠাবো ওই একগালে ফেস পাউডার মাখিয়ে বরপক্ষকে বরণ করতে!
আবার দাদাবাড়ি যাচ্ছি।
কয়েকদিন পর ফিরে আসব। কিন্তু আমি জানি,আমার গাঁয়ের চন্দ্রবিন্দুটা আজীবন আমারই থাকবে. . . . . . . . . . . . . . . . . . .
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।