চলে যেতে যেতে বলে যাওয়া কিছু কথা
সাগরে ছুটে চলেছে জাহাজ। যাত্রীদের মাঝে রয়েছে জাতের নানা মতের লোক। একটি কেবিনে দুই ভদ্রলোক পাশাপাশি বিছানা পাতলেন। পরষ্পর অপরিচিত এই দুই ভদ্রলোক কিছুদিনের মধ্যে আবিস্কার করলেন যে দুজন চিন্তাধারা আর বিশ্বাসে দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। একজন শ্রষ্টায় বিশ্বাস করেন আরেকজন করেন না।
খুব প্রয়োজন না হলে পরষ্পরকে এড়িয়ে চলতেন তারা। এক সন্ধায় আকাশ অন্ধকার করে ঝড় আসল। আস্তিক ভদ্রলোক কায়োমনবাক্যে শ্রষ্টাকে ডাকতে শুরু করলেন।
এক ফাকে নাস্তিক ভদ্রলোক তাকে জিগ্গেস করলেন, "ডাকলে কি আর ঝড় থামবে?"
আস্তিক ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, প্রানে ত বেচে যেতে পারি।
একসময় ঝড়ে জাহাজ ডুবে গেল।
নিসন্দেহে অনকে প্রান বিনষ্ট হল। ভাগ্যক্রমে ঐ দুই ভদ্রলোকে সাগরের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে পাশের এক দ্বীপে নিয়ে তুলল।
একসময় গ্গান ফিরলে তারা পরষ্পরকে দ্বীপে অসহায় অবস্থায় আবিস্কার করল।
"শ্রষ্টা আমাদের রক্ষা করেছেন"
আস্তিক ভদ্রলোক শ্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্বগোক্তি করলেন।
"এখানে শ্রষ্টাকে পেলেন কোথায়, ঘটনাক্রমে আমরা বেচে গেয়েছি মাত্র।
আশেপাশে দ্বীপ ছিল। গানিতিক সমীকরনে কারো না কারো বেচে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। অতগুলোন মানুষের মধ্যে আমরা না হলেও কেউ না কেউ বেচে যেত। " নাস্তিক ভদ্রলোক যুক্তি দেখালেন।
আর কথা না বাড়িয়ে দুজন রওয়ানা দিলেন দ্বীপের অভন্ত্যরে।
ক্রমেই গাছগাছালির ঘনত্ব বাড়তে থাকল। একসময় দুজনের প্রচন্ড ক্ষিদে পেল। পাশেই একটি গাছে হাতের নাগালে বেশি কিছু ফল পেকেছিল।
আস্তিক ভদ্রলোক কিছু ফল পাড়লেন খাওয়ার জন্য। নাস্তিক ভদ্রলোক চেচিয়ে বললেন, "ফলগুলো বিষাক্তও হতে পারে।
আগে নিশ্চিত হতে হবে এগুলো খাওয়া নিরাপদ।
"শ্রষ্টার উপর ভরসা করে তার নাম নিয়ে খেলে কিছুই হবে না। "
আস্তিক ভদ্রলোকের এই অন্ধ আর অযোক্তিক বিশ্বাসে বিরক্তবোধ করলেন অপর ভদ্রলোক।
কিন্তু আর বিলম্ব না করে ফলগুলো খাওয়া শুরু করলেন আস্তিক ভদ্রলোকে। কিছুক্ষন পর মুখে ফেনা তুলে অগ্গান হলেন তিনি।
ষ্পষ্টত: ফলগুলো বিষাক্ত ছিল। নাস্তিক ভদ্রলোক নাড়ি টিপে বুঝার চেষ্টা করলেন আস্তিক ভদ্রলোক বেচে আছেন কিনা।
ঠিক ঐসময় কিছু জংলী লোকের আবির্ভাব ঘটল দৃশ্যপটে। তারা আস্তিক ভদ্রলোককে মৃতভেবে ফেলে গেলেও নাস্তিক ভদ্রলোককে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে গেল।
নিজেদের ডেরায় নিয়ে গিয়ে তাকে একটি খুটিতে বাধল জংলীরা।
তারপর শুরু হল জংলী নাচ আর বিভিন্ন ধরনের জংলী আচার। একসময় তাকে ঘিরে আগুনের কুন্ডলী জ্বালানো হল। নাস্তিক ভদ্রলোক মনে মনে ভাবলেন এরচাইতে বিষাক্ত ফল খেয়ে মারা যাওয়া শ্রেয়তর ছিল। কেজানে তাকে হয়ত রোষ্ট করে খাওয়ার পরিকল্পনা করছে জংলীরা।
আরো চমকপ্রদ কিছু অপেক্ষা করছিল সবার জন্য।
সবাইকে চমকে দিয়ে আস্তিক ভদ্রলোক টলতে টলতে উপস্থিত হলেন জংলীদের মাঝে।
মুখে দিয়ে তখনো ফেনা বেরুচ্ছে আর চোখদুটো রক্তবর্ণ। তাকে দেখে কিনা কি মনে করে জংলীরা উর্ধস্বাসে দৌড়ে পালাল। এদিকে নাস্তিক ভদ্রলোক চিতকার করে সাহায্য প্রার্থনা করল তাকে আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে উদ্ধার করার জন্য। আস্তিক ভদ্রলোক তড়িঘড়ি করে আগুন নিভিয়ে নাস্তিক ভদ্রলোককে বাধনমুক্ত করল।
দুজন ছুটল নিরাপদ আশ্রয়ের খুজে। যদ্দুর সম্ভব জংলীদের খাবার পানি সংগে করে নিলেন।
ছুটতে ছুটতে জংলীরা দ্বীপের যেদিকটায় পালিয়েছে তার উল্টো পার্শ্বে সাগরের কিনারায় পৌছলেন। কিছুটা বিশ্রাম আর খাবার গ্রহনের পর দুজনেই স্থীরভাবে কিছু ভাবার সময় পেলেন।
প্রথমেই ভাবল কিভাবে রাতটা নিরাপদে কাটানো যায়।
শেষপর্যন্ত দুজন সম্মতিক্রমে রাত্রিযাপনের উদ্দ্যেশে একটা লম্বা গাছে চড়ে উঠলেন।
রাত ঘনিয়ে এলেও চাদের আলোতে দ্বীপটিতে চলছিল আলোআধারির খেলা। জোস্নার আলো আছড়ে পড়ছিল সাগরের বিস্তৃত জলরাশিতেও। মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা তারারা আকাশজুড়ে বসিয়েছিল আলোর মেলা। অভুতপুর্ব এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য বাকরূদ্ধ করে দিয়েছিল এই দুজন
গাছের চুড়ায় বসে দুজন অবাক নয়নে উপভোগ করছিলেন মনোহর এই প্রকৃতিকে।
"অসম্ভব এই সুন্দর দৃশ্যগুলো দেখে কি আপনার মনে হয় না বিশাল এক ক্যানভাসে নিপুন এক শিল্পী তার তুলির আচড়ে অসম্ভব সুন্দর এক ছবি একেছেন। "
মৃদু কন্ঠে বললেন আস্তিক ভদ্রলোক।
"এর পেছনে এক শ্রষ্টার কথা বলছেন ত" নাস্তিক ভদ্রলোক শুধালেন।
"ঠিক তাই"
"আমি এর মধ্যে কোন শ্রষ্টাকে দেখছিনা, আমি ভাবছি একটা সিস্টেমের কথা যার অন্তর্গত আমি আপনি সবকিছু এমনকি এই প্রকৃতিও।
আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ভাল-মন্দ, সুন্দর-অসন্দুর লাগার অনুভুতিগুলোও এই সিস্টেমকে ঘিরে গড়ে উঠেছে।
নৈতিকতা কথা, মানবিক মুল্যবোধ ধীরে ধীরে আমরা আত্মস্থ করেছি আরো সুন্দরভাবে বাচার জন্য, পরলৌকিক কোন পুরস্কারের জন্য নয়। “
"কিন্তু আমি সবকিছুর মাঝে কোন এক মহান শ্রষ্টার অস্তিত্বকেই শুধু খুজে পাই। আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনকে ঘিরে এত সব আয়োজন মিছে মিছে এমনিতে গড়ে উঠেছে কোনভাবেই ভাবতে পারিনা আমি। আমার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের প্রতিটি চলন মহান শ্রষ্টার ইংগিত বহন করে। পরিবার, সমাজ, এমনকি সমগ্র বিশ্বের প্রতি অফুরান যে ভালবাসায় আমার জীবন প্রতিনিয়ত সিক্ত হচ্ছে তা একদিন হঠাত করেই এমনিতে ফুরিয়ে যাবে কেন? তাই অনন্ত এক জীবনের সাথে এসবকিছুর যোগসুত্র স্থাপনের তাগিদ অনুভব করি আমি।
পরলৌকিক সেই অনন্ত জীবনকে আসলে আমরা তিল তিল করে গড়ে তুল ইহলোকের ক্ষুদ্র জীবনে। " একটানে আবেগের সাথে কথাগুলো বললেন আস্তিক ভদ্রলোক।
আস্তিক ভদ্রলোকের জীবন দর্শন নাস্তিক ভদ্রলোককে সন্তুষ্ট করতে না পারলেও তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলল।
পরেরদিন সকালে একটু দেরীতে ঘুম থেকে উঠে আস্তিক ভদ্রলোককে আশেপাশে দেখতে পেলেন না নাস্তিক ভদ্রলোক। ভাবলেন সকালের প্রার্থনা সারছেন বোধহয় অন্যজন।
হঠাত তার দৃষ্টি গেল গাছের ডালে ঝুলতে থাকা তাবিজের মত একটু বস্তূর দিকে। আস্তিক ভদ্রলোককে গলায় ঝুলিয়ে পড়তে দেখেছেন এটিকে।
আস্তিক ভদ্রলোক ফিরে এলে ফেরত দিয়ে ঠাট্টার সুরে বললেন, "এটি গলায় ঝুলানো না থাকায় বিপদ ঘটেনি ত?"
"দুবার ত মরতে মরতে বেচে গেছি। " আস্তিক ভদ্রলোক গম্ভীর সুরে বললেন।
চলবে...।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।