ঢাকার চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও মতপার্থক্য দূর করতে রাজনীতিবিদদের প্রতি আবারও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, 'চীন অত্যন্ত স্পষ্ট করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও এখানকার মানুষের মঙ্গলের জন্যই চীনের এ অবস্থান। আমরা এটাও বলেছি, এখানে কী প্রয়োজন, কোনটি ভালো বা মন্দ তা দেশের রাজনীতিবিদ ও জনগণই ঠিক করবে। কারণ এ সম্পর্কে তারাই ভালো জানেন। এ জন্য তাদেরকে মতপার্থক্য দূর করতে শান্তিপূর্ণ সংলাপে বসতে হবে।' বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিব পর্যায়ে সংলাপের প্রস্তাব ও তাতে বেগম খালেদা জিয়ার সায় দেওয়ার পর রাষ্ট্রদূত দ্বিতীয় দফায় এই আহ্বান জানালেন।
চায়না-বাংলাদেশ স্ট্যাডি গ্রুপের আয়োজনে 'বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আগামী দশকের অংশীদারিত্বের সম্ভাবনা' শীর্ষক গোল টেবিল আলোচনায় সমন্বিত ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত লি বলেন, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক উভয়ের স্বার্থের ভিত্তিতে যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা চাইলেও অন্য দেশগুলো পারবে না। তবে এই সম্পর্ক আরও বাড়াতে সৃজনশীল চিন্তা ও উদ্ভাবনী নীতি অতীব প্রয়োজন। চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য একটি ইপিজেড নির্মাণ হলে তা চীনের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এখানে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে চীনা কোম্পানিগুলো। দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া ব্লকের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার নিয়ে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিস্তর সুযোগ রয়েছে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর হলে এ যোগাযোগের দ্বার আরও প্রসারিত হবে। এই সমুদ্রবন্দর শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য লাভজনক হবে।
রাষ্ট্রদূত লি জুন বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কগুলো উভয়ের স্বার্থের ভিত্তিতেই পরিচালিত। এতে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থও সুরক্ষিত থাকে, পাশাপাশি লাভবানও হয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, চীনা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক থেকে বেশ আলাদা। চীনা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়ের সহযোহিতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত। আরও অনেক কিছুর চাইতে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দেশ দুটি একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার। এ সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, উদীয়মান অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন ও ভারত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একই ধারণা পোষণ করে থাকে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ইংরেজি দৈনিক নিউজ টু-ডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিস স্ট্যাডিসের (বিআইআইএসএস) প্রধান রাষ্ট্রদূত মুনশী ফয়েজ আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এমএ তসলিম প্রমুখ। মূলবক্তব্য উপস্থাপন করেন বিআইআইএসএস রিসার্চ ফেলো এ আশিক রহমান। লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি কানেকটিভি স্থাপন প্রয়োজন। আমরা সমুদ্র বন্দর, সমুদ্র অর্থনীতি, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে চীনের সহযোগিতা কামনা করি। চীনের বিনিয়োগ ও চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য আলাদা ইপিজেডের দাবির কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদেরকে একে অপরের হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে হবে। মুন্সী ফায়েজ বলেন, বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অন্য দেশের মতো কোনো আত্দত্যাগ করতে হবে না। সম্পর্ক রক্ষা করতেও এটা প্রয়োজন হবে না। আমরা একটি বন্ধুর মতো চীনের কাছ থেকে সামুদ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য সহায়তা চাইতে পারি। অধ্যাপক এম এ তাসলিম বলেন, বাংলাদেশ এখন প্রতিবছর চীন থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করছে। বিপরীতে চীনের বাংলাদেশ থেকে আমদানি এক বিলিয়নেরও কম। ভবিষ্যতে এই ব্যবধান আরও বাড়বে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি এখনই তা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বাজার চীনে সম্প্রসারণ করা গেলে কিছুটা হলেও বাণিজ্য ব্যবধান কমবে। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে। কুনমিং হয়ে আকাশ যোগাযোগ বৃদ্ধি হওয়া তার প্রমাণ দেয়। চীন বাংলাদেশের জন্য অনেকদিন আগ্রহের দেশ হিসেবে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। হুমায়ূন কবির বলেন, কানেকটিভি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় চীনের সঙ্গে যুক্ত হতে বাংলাদেশের একটি স্মার্ট পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে। এই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই। চীন বাংলাদেশের দৃঢ় ও পরীক্ষিত বন্ধু। তিনি বলেন, উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর মাঝামাঝি স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় বাংলাদেশকে অবশ্যই চীন, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। চীনের উত্থান হবে শান্তিপূর্ণ এবং বাংলাদেশ এই উত্থান থেকে লাভবান হতে পারে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।