আমি নীরা। নীরা নামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একজন নায়িকা আছে। আমি সেই নীরা নই। কবিতার সেই নীরাকে ভাবলেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল শাড়ি পরা, খোলাচুলের অতি আশ্চর্য্য, এক হাস্যোজ্বল সুন্দরীতমা মানবীকে, যাকে বাঙ্গালী প্রেমিকার ৯৯% গুনাবলী সম্বলিত আদর্শ চরিত্র বলেই মনে হয় আমার। আমার বাবা সুনীলের মহা ভক্ত হওয়ায় আমি খুব ছোট থেকেই নীরাকে চিনে ফেলি।
যথারীতি বাবার নীরা ভক্তির নিদর্শন স্বরুপ আমার নামও রাখা হয়েছিলো নীরা। তবে এই নাম আমার অতি আধুনিকা মায়ের মোটেও পছন্দ ছিলো না। আমার মা আমাকে কখনও নীরা বলে ডাকেননি। তার জন্য সংরক্ষিত ছিলো আমার অন্য একটি নাম। আমার ধারণা ছিলো এই নীরা নামটা নিয়ে বাবার অতি বাড়াবাড়ির কারনেই মায়ের এই নামে বিরক্তি এসে গিয়েছিলো।
কিন্তু মায়ের যুক্তি ছিলো, নীরা মানে শিশির, সে খুব ক্ষনস্থায়ী, পাতার উপরে টলটলে একফোটা শিশিরবিন্দু দেখলেই নাকি মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। কি সব আজগুবি কথাবার্তা। আসলে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়াটাই এক বিশাল ঝামেলা। সব সময় সবকিছুতেই টিক টিক করা।
সে যাই হোক, আমার ভাবনায় গড়া কবিতার নীরার মত পোষাক হিসাবে শাড়িটাও খুব প্রিয় ছিলো আমার।
মায়ের আলমারী থেকে বেছে বেছে নীল শাড়িগুলোই আমি সিলেক্ট করতাম নানা অনুষ্ঠানে পরবার জন্য। অর্কের সাথে যখন আমার প্রথম দেখা, সে ঘটনাটাও বেশ মজার। সেটা ছিলো এক গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান। আমরা ছিলাম কন্যাপক্ষ। পাত্রপক্ষের অনুষ্ঠানে আমাদের বাড়ির মেয়েদের সবার হলুদ শাড়ী, রেশমী চুড়ি আর খোঁপায় গাঁদাফুলের মালা পরবার কথা ছিলো।
কিন্তু সাজসজ্জার শেষমুহুর্তে আমিই একমাত্র ব্যাক্তি যে কিনা হলুদ শাড়ি পরতে বেঁকে বসলাম, ডিসিশন চেন্জ করে বরাবরের মত নীলরঙ শাড়ি পরে ফেললাম। এই নিয়ে আমার কাজিনদের সাথে বলতে গেলে একটু মনোমালিন্যই হয়ে গেলো। কিন্তু আমি কিছুতেই ডিসিশন চেন্জ করলাম না। কারণ হলুদ শাড়িটা পরবার আগে আয়নার সামনে গায়ে ধরে একটু দেখতে গিয়েই নিজেকেই মনে হচ্ছিলো হলুদ রঙের একটা জ্যান্ত পেত্নীর মত। কিছুতেই আমার ইচ্ছে হলো না সেই হলুদ রঙ শাড়ি পরতে।
আসলে নীলশাড়ির প্রতি আমি তখন যেমনই ছিলাম এ্যডিক্টেড তেমনই আমি নিজেকে কবিতার বই থেকে উঠে আসা জ্বলজ্যান্ত নীরাই ভাবতে শুরু করেছিলাম ততদিনে। যদিও এক ঝাঁক হলুদ পরীদের মাঝে গাঢ় নীলরঙ শাড়িতে নিজেকে বেখাপ্পা লাগছিলো নিশ্চয়, এছাড়াও কাজিনদের সাথে মনোমালিন্য হয়ে যাওয়ায় মনটাও বিশেষ ভালো লাগছিলো না তাই সবাই যখন গাড়ি থেকে নেমে থরে থরে সাজানো ডালা, কুলা, মিষ্টি নিয়ে সারি বেঁধে চলছিলো হলুদের স্টেজের দিকে, আমি তখন পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। সবার শেষে আমার জন্য পড়ে থাকলো শুধুই সুসজ্জিত ডালায় দুই জোড়া বরের জুতো, একটা কোলাহপুরী চপ্পল আর একটা নাগরা। কি আর করা? ইতিমধ্যেই দলীয় নীতিমালা ভঙ্গের কারণে অপ্রীতিকর পরিস্তিতিতে পড়ে যাওয়ায় আর কোনো বাক বিতন্ডায় যেতে মন চাইছিলো না। সেই জুতোর ডালাটাই শেষ পর্যন্ত তুলে নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে মেয়েদের সারিতে যোগ দিলাম আমি।
অন্য সময় হলে আমি কিছুতেই জুতোর ডালা বয়ে নিতে রাজী হতাম না নিশ্চয়।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার পাশে পাশে ক্যামেরার সাটার টিপে চলেছে এক অতি সুদর্শন ছেলে। বিয়ে বাড়িতে অতি বেহাইয়া ছেলে দু একটা সবসময় থেকেই থাকে। মেয়েদের ছবি তোলা, গায়ে পড়ে কথা বলা, হাসি ঠাট্টার চেষ্টা করা কোনোটাতেই কম যায়না তারা। কিন্তু এই ছেলেটা ! তাকে দেখে আমি তো পুরোই অবাক!!! এক্বেবারেই আমার জীবনের উলটো ঘটনা ঘটতে লাগলো! মানে আমি নিজেই মুগ্ধের উপর মুগ্ধ হয়ে গেলাম! যাকে বলে লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট! নিজের মনোভাবে আমার নিজেরই লজ্জা লাগতে লাগলো।
এ দেখি ঠিক আমার স্বপ্নে দেখা রাজকুমার! এত সুন্দর একটা মানুষ হয়!!!
ঝকঝকে তকতকে হ্যাংলা পাতলা ছেলেটাই সেই অর্ক! আমার কাজিনের দূরসম্পর্কের দেবর! হলুদ, বিয়ে বৌভাত সবকটি অনুষ্ঠানেই ছেলেটা থাকলো আমার পাশাপাশি, খুব কাছাকাছি। চোখাচোখি হলো বহু বহু বার। কিন্তু কেন যেন সে গায়ে পড়া ছেলেগুলোর মত একটা কথাও বলতে আসলো না আমার সাথে। আমি এই প্রথম মনে মনে একটু বিষন্ন হলাম। মনে প্রানে চাইছিলাম সে কথা বলুক আমার সাথে।
কিন্তু সবগুলো অনুষ্ঠান পার করে আমরা আমাদের মামাত বোনটাকে শ্বসুরঘরে পাঠিয়ে দিলাম তবুও অর্কের সাথে আমার একটা কথাও হলোনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই বলে আমি তো আর হ্যাংলার মত যেচে পড়ে ওর সাথে কথা বলতে পারি না। মরে গেলেও সেই কাজ আমাকে দিয়ে হবেনা।
এরপর বর ও কনে ফেরানীতে ফিরলো যেদিন, সেদিনও আমরা সবাই মামার বাসাতেই ছিলাম।
অর্ক আসলো ওদের সাথে। হাল্কা নীল রঙ শার্টে ওকে যে কি অদ্ভুত লাগছিলো! আবারও চোখাচোখি হল বেশ কয়েকবার ওর সাথে আমার তবে এইবার তার সাথে কথা বলারও সুযোগ হয়ে গেলো খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে। শালী হিসাবে নতুন দুলাভাইকে শরবৎ খাওয়াতে গিয়ে হঠাৎ দুলাভাই এর হাতে লেগে গ্লাস ছলকে শরবৎ পড়ে গেলো পাশে বসা অর্কের গায়ে। একদম বাংলা বা হিন্দী সিনেমায় প্রায়ই যেমন হয়! দুলাভাই দুষ্টুমী করে বললেন, হায় হায় এটা কি করলে? আমার এত সুন্দর ভাইটার কাপড় নষ্ট করে দিলে? আমি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে টিস্যু নিয়ে এলাম। অর্কও ভীষন অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো।
তবুও আমি যেন এতটুকু লজ্জা না পাই তাই আবল তাবল এটা সেটা বলে আমাকে সহজ করতে চাইছিলো। যদিও আমি নিজেই ভীষন অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়ায় সে সব কথার এক বর্ণও কানে ঢোকেনি আমার সে সময়।
সেই শুরু । সেদিন রাতে সব কাজিনরা মিলে হই চই, হাসি, তামাসা, নাচ, গান, কার্ড খেলা, হই হুল্লোড়, সারাটারাত আমরা প্রায় জেগেই কাটিয়ে দিলাম। পরদিন ওরা ফিরে গেলো।
অর্ক যখন আমাকে ফোন দিলো তখন গভীর নিশুথী রাত। ঘুম ভেঙ্গে আননৌন কল দেখবার পরও আমি ঠিক ঠিক জানতাম, সেটা অর্কেরই ফোন হবেই।
অর্কঃ নীরা..
আমিঃ বলো..
অর্কঃ আমি কে চিনতে পারো?
আমিঃ হুম পারি।
অর্কঃ কে বলোতো?
আমিঃ অর্ক। তুমি অর্ক!
অর্কঃ নীরা তুমি কি জানতে আমি তোমাকে ফোন দেবো?
আমিঃ হুম জানতাম।
অর্কঃ কিভাবে? আমি তো তোমার কাছে তোমার ফোন নাম্বার চাইনি ।
আমিঃ জানিনা কিভাবে, কিন্তু জানতাম............
আমি সেই রাতে ওকে শুনিয়েছিলাম গান, আমার নিশীথ রাতের বাদল ধারা আর বিনিময়ে অর্ক আমাকে শুনিয়েছিলো রবিঠাকুরের "অমর প্রেম" আবৃত্তি করে। আমরা দুজনই ছিলাম ভীষন রকম রবীন্দ্র ভক্ত। বলতে গেলে রবিঠাকুরের উন্মাদ প্রেমী ছিলাম আমরা। অর্ক আমার নাম দিয়েছিলো নীলপরী কারণ সেই বিয়ে বাড়ি ভরা হলুদ শাড়ি, হলুদ চুড়ি আর হলুদ ফুলের মালার মাঝে আমাকে নাকি নীলশাড়িতে দেখে তার মনে হয়েছিলো আকাশ থেকে বুঝি একটা সত্যিকারের নীলপরীই নেমে এসেছে।
হা হা হা । এমনিতে দেখতে চুপচাপ, শান্ত শিষ্ঠ বলে মনে হলে কি হবে, দুষ্টুমীতে অর্ক ছিলো সেরা।
সে যাই হোক, রাত পেরিয়ে কখন যে ভোর হলো সেদিন আবলতাবল কথায়, গানে আর আবৃত্তিতে জানতেও পারিনি। এইভাবে কত কত রাত নির্ঘুম কাটিয়ে, ঢুলতে ঢুলতে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া আর দুপুরে ফিরেই লম্বা এক ঘুম দিয়ে রাত জাগার জন্য এনার্জী সঞ্চয় করেছিলাম আমরা।
বছরখানেক বাদে অর্কের পড়ালেখার পাট চুকলো, একটা বিদেশী ফার্মে জবও শুরু করলো ও আর আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী।
ততদিনে আমাদের দু'বাড়িতেই জানাজানি হয়ে গেছে। ওদের ফ্যামিলী আর আমাদের ফ্যামিলীতে কারো জানতে আর বাকী নেই আমরা দুজন যে হাবুডুবু খাচ্ছি। বিয়ের কথা পাঁকা হতে খুব একটা সমস্যা হলো না। শুধু আমার একমাত্র মামীকেই সেই শুরু থেকেই আমাদের এই সম্পর্ক, বিয়ের ব্যাপারে দেখলাম নাখোশ। তিনি কেনো যেন তার মেয়ের শ্বসুর বাড়িতে এই আত্মীয়তাটা একেবারেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
তবে কি যায় আসে? আমরা তখন দুজনে দুজনার। আমাদের দুজনকে এই পৃথিবীর কারোই সাধ্য নেই আর তখন আলাদা করার। যদিও পারিবারিক সন্মতিতেই বিয়ের আয়োজন শুরু হলো তারপরও আমরা দুজন মিলে আমাদের নিজেদের বিয়ের শপিং নিজেরাই বেশিভাগটা করে ফেললাম। আমি যথারিতী বিয়ের শাড়ি পছন্দ করলাম নীল রঙ বেনারসী আর সাথে অর্কের জন্য নীল রঙ সেরোয়ানী অর্ডার দেওয়া হলো।
একমাত্র মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাবা একজন আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু বান্ধব কেউই যেন আমন্ত্রন হতে বাদ না যায় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখলেন।
দেশের বাড়ি হতেও বেশ কিছু লোকজন এলো যাদেরকে আমি জন্মের পর কখনও দেখিনিওনি। সারাবাড়ি উৎসবের আনন্দে গম গম করে উঠলো। হঠাৎ আমার হলুদের দিন কোথা থেকে এক হত দরিদ্র মহিলা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। দারোয়ান তো তাকে কিছুতেই ঢুকতেই দিচ্ছিলো না। গেটের কাছে হই চই চেচামেচিতে শেষ পর্যন্ত জানা গেলো আমাদের কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয়া মহিলা খুব গন্ডগোল করছে।
সে কোথায় যেন খবর পেয়েছে এই বিয়েতে তাকে দাওয়াৎ দেওয়া হয়নি আর তাই জানতে পেয়ে ছুটে এসেছে। বাবা খবর নিতে নীচে নেমে গেলেন।
আমরা তখন সবে মাত্র সকালের নাসতা সেরেছি। আমি আর মা তখনও বসে ডাইনিং রুমে। বাবা মহিলাটিকে সাথে করে উপরে উঠে এলেন।
মহিলাটি এসে মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। মায়ের মুখ আষাঢ়ের আকাশ। মায়ের সূচীবায়ূ অসুখ আছে। এই সাত সকালে একবার গোসল সেরেছেন আবার এই নোংরা কাপড়ের মহিলা মায়ের পায়ে হাত দিয়েছে, তাকে তো এখুনি ফের বাথরুমে ছুটতে হবে আবারও গোসল করতে সে আমি বেশ জানি। সেটা ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছিলো।
হঠাৎ মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে মুখে আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তার হাউ মাউ কান্নার শব্দে আশে পাশে কাজের লোক জন, আত্মীয় স্বজন জড়ো হতে শুরু করলো। বাড়ি ভর্তি মেহমান। কাল গায়ে হলুদ , চারিদিকে উৎসবের আমেজ! এর মাঝে এ কি উৎপাত! মা মহিলাটিকে টেনে নিয়ে গেলেন গেস্টরুমের দিকে কোথাও! মহিলাটি ফোঁপাতে ফোঁপাতে শেফালী, শেফালী করে কার নাম ধরে যেন ডাকছিলো। বাবা সেদিকে ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে রইলেন, আমাকে বললেন, এ তোর দূর সম্পর্কের ফুপু, মানষিক সমস্যা আছে।
এই জন্যই ওকে দাওয়াৎ করিনি। ওর শেফালী নামে একটি মেয়ে ছিলো। আমি জিজ্ঞাসু নে্ত্রে তাকালাম বাবার দিকে। বাবা বললেন, সে তোর বয়সী ছিলো। এর পর বাবা কিছু না বলেই তার রুমের দিকে চলে গেলেন।
আমি অর্ককে ফোন দিলাম। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। কয়েকদিন যাবৎ বিয়ে বাড়ির অনাবিল আনন্দ উচ্ছলতার মাঝে হঠাৎ একঝাঁক বিষাদ নিয়ে হাজির হয়ে এই মহিলা চারিপাশটা যেন আঁধার থমথমে করে তুললো। তবে কিছু পরেই আবার আত্মীয় স্বজন, লোকজনের হাঁকডাকে বিয়ে বাড়ি ফিরে পেলো তার আগের চেহারা। আমিও নতুন জীবনের স্বপ্নে বেমালুম ভুলে গেলাম গ্রাম থেকে আসা, ময়লা শাড়ি পরা কোনো শেফালী নামক মেয়ের মায়ের কথা।
তার দুঃখের কথা আমার মনেও থাকলো না।
বিকেলবেলা আমাকে সব কাজিন আর বন্ধুদের জোর জবরদস্তিতে শেষ পর্যন্ত হলুদ রঙের পেত্নী মার্কা শাড়ী আর এক গাঁদা ফুলের গয়না পরেই হলুদের স্টেজে বসতে হলো। আমার বিয়ে বলে খুব এক হাত শোধ নিলো তারা। যাইহোক,হলুদ, খানাপিনা, অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে আর আমন্ত্রিত অতিথি, হবু শ্বসুরবাড়ির লোকজন সব বিদায় নিতে নিতে প্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে গেলো। রাতে কেনো যেন ভালো ঘুম হলোনা।
অর্ককেও ফোনে জাগিয়ে রাখলাম আমি। বেচারা ভীষন টায়ার্ড ছিলো ঘুমের মধ্যেই হু হা করে রাত পার করলো। আমার জ্বালায় ঘুমাতেও পারলোনা একটু ভালো করে বেচারা। খুব ভোরে বাগানে হাঁটাহাঁটি, সে আমার অনেকদিনের অভ্যেস। আজ বাদে কাল নতুন বাড়িতে নতুন জীবন শুরু করবো, রোজকার মত আমাদের চিরপরিচিত বাগান, বাড়ির ছাঁদ,বারান্দায় ঝোলানো মাধবীলতার ঝাঁড় সেসব কিছুই আর আমার দেখা হবেনা রোজ রোজ, সাতপাঁচ ভেবে মনটা একটু খারাপ লাগছিলো।
ভোরবেলা বাগানে একটু হাঁটবো বলে দরজা খুলে বের হতেই চমকে উঠলাম আমি! দরজার সামনে আধো আলো আঁধারীতে ভুতের মত দাঁড়িয়ে আছে কালকের সেই অনাহুত পাগলি মহিলা! কেনো যেন মনে হলো মহিলাটা আমাকে কিছু বলতে চায়, সারারাত দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ছিলো কিনা কে জানে! তবে সে কিছু বলার আগেই হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ কান্না শুরু করলো!!!আমি ভীষন ভয় পেয়ে দৌড়ে গেলাম মায়ের ঘরে। আমার চিল্লাচিল্লি আর অত ভোরে মহিলাটির কান্নাকাঁটিতে বাবা মা আর বাড়ির অর্ধেক মানুষজন ঘুম ভেঙ্গে এমনিতেই জেগে উঠেছিলো। বাবা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মহারাগী মা সাত সকালে এই সব পাগলামি মোটেও বরদাস্ত করলেন না। ভীষন রাগে মহিলাটিকে কোনার ঘরে টেনে নিয়ে গেলেন কোথায় তা জানার আমার কোনো ইচ্ছেও তখন ছিলোনা।
আমি এই অপ্রত্যাশিত অভাবনীয় ঘটনায় হতচকিত হয়ে ভীষন ভয় পেয়ে আমার চিরদিনের নিরাপদ স্থান বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললাম। পরে শুনেছিলাম তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো ও তারপর ড্রাইভার দিয়ে সোজা স্টেশনে পাঠিয়ে, টিকেট কেটে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
পরদিন আমার বিয়ে। তবুও হই হট্টগোলে, নানা রকম আয়োজনে সেদিনও সকলের ঘুমাতে যেতে প্রায় রাত একটা পার হয়ে গেলো। চারিদিক চুপচাপ হয়ে এলো।
ঘুম আসছিলো না আমার কিছুতেই। এতদিনের পরিচিত ঘরবাড়ি ,পড়ার টেবিল, দেওয়ালে বাঁধানো বাবা মা আর মাঝে আমির বিশাল বড় ছবিটা, কত স্মৃতি, রুমের সামনের এক চিলতে প্রিয় বারান্দাটা সবকিছু ছেড়ে চলে যাবো আমি। কি এক গভীর শূন্যতা আর হাহাকার জাগছিলো বুকের ভেতরে। বাগানের লাইট এসে পড়া জানালার ধারের লতানো মানিপ্লান্ট গাছটা দেখে কান্না পাচ্ছিলো আমার। মনটা হু হু করে উঠলো কেনো যেন অজানা কোনো কষ্টে।
উঠে গিয়ে বারান্দার আমার বহুদিনের রাত জাগার সাথী প্রিয় দোলনাটাতে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ মায়ের গলা ভেসে এলো, বেশ উত্তপ্ত কিন্তু চাপা বাক্য শুনে বেশ অবাকও হলাম। রেগে গেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করা স্বভাব তার কিন্তু এত রাতে হঠাৎ কি এমন হলো? আমার বারান্দার সাথেই লাগোয়া মায়ের বেডরুমটা। কিন্তু কার সাথে রাগারাগি হচ্ছে মায়ের! বাবার গলাও শোনা যাচ্ছে তবে শুধু বাবা মাই নয় আরও একজন তৃতীয় পক্ষও রয়েছেন সেখানে। মামীর ক্ষীপ্ত কন্ঠস্বর বেশ উঁচু পর্দায় ভেসে এলো----
মামীঃ কি জন্য চুপ করবো? তুমি কি আমার মেয়ের সংসারে আগুন লাগাতে চাও সোফিয়া?
মাঃ নেকামী কম করো ভাবী।
তোমার মেয়ে তার সংসার নিয়ে থাকবে। এইখানে আগুন লাগালাগির কথা আসছে কেনো?
মামীঃ আজ সে এখানে এসেছে কাল সে ওখানে যাবে না তার কি বিশ্বাস আছে? তখন সবার আগে তো আমাকেই দোষী হতে হবে। সব জেনে শুনে আমি সত্য গোপন করেছি সে দোষে কি তারা দোষী করবে না আমাকেই? আমার মেয়ের শ্বসুর বাড়িতে আত্মীয়তা অথচ আমি কিছুই জানাইনি ...
মাঃ কি জানাবে? কিসের দোষ? নীরা আমার মেয়ে। তার মা আমি। তাকে জীবনের শেষ বিন্দু ভালোবাসাটুকু দিয়ে বড় করে তুলেছি আমরা।
সে তার বাবার চোখের নিধি, মায়ের ....
মামীঃ এই সব বড় বড় কথা রাখো সোফিয়া। ছেলে মেয়ে প্রেম করেছে ভালো কথা, প্রথম থেকেই তোমার উচিৎ ছিলো ওদেরকে সাবধান করা। আর যাও বা প্রেম হয়েছে । শিক্ষিত ছেলে সে, তুমি তাকে সত্যটা জানাও...
বাবাঃ কি বলছো ভাবী? নীরার কথা একবার ভেবে দেখেছো? এতগুলো দিন পরে সে কিভাবে সহ্য করবে সে কথা! বিশটা বছর যে সত্য গোপন করে আমরা ওকে বড় করেছি। এমনকি নিজেরাই ভুলে গেছি যে কথা, সে কথা কি করে বলবো আমরা নীরাকে!
মামীঃ হ্যাঁ গোপন রাখো, নিজের মেয়ের জীবনেও ধ্বংস ডেকে আনো, সাথে আমার মেয়ের জীবনেও।
যখন ওই পাগলী মহিলা কালকের মত ও বাড়িতেও গিয়ে হাজির হবে, দাবী করবে তার নিজেরে মেয়েকে, সেদিন তোমাদের শিক্ষা হবে, সেদিন বুঝবে!! সত্য কোনোদিন গোপন থাকে না ...... যে সত্য একদিন লুকিয়েছো তার সাজা পাবে তোমরা........
বারান্দার গ্রীলটা ধরে টলে পড়ে যাও্য়া থেকে নিজেকে রক্ষা করলাম আমি। মামীর বলা কি সত্য......আর কি গোপন...... ঐ পাগলি ভেবে যাকে ভয় পেয়েছি সেই মহিলা......তাকে আমন্ত্রন না জানানো, তার অব্যাক্ত কথা, কান্নার মানে কিছুই বুঝতে বাকী রইলো না আমার আর! মামী আরও কি সব বলে গেলো !
-------------------------------------------------------------
নাহ! অর্কের সাথে বিয়েটা হয়নি আমার। শেষ মুহুর্তে ওকে ঠকাতে পারলাম না আমি। যদিও সবকিছু শোনার পর অর্ক যে কোনো কিছুর বিনিময়ে শুধু আমাকেই চেয়েছিলো। মেনে নিতে চেয়েছিলো আমার সকল, অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎকেও, শুধু আমার জন্য , আমাদের সত্যিকারের ভালোবাসাটার জন্য যে কোনো রকম চ্যালেঞ্জ নিতেই রাজী ছিলো সে।
এ বিশাল বিশ্বের মনুষ্য জাঁতির প্রতিটি দেহের প্রতি ধমনীতে একই লোহিত রক্তস্রোত বয়ে চলা মানুষগুলোর মাঝে এত বড় প্রভেদ যে ধনী, গরীব, উঁচু, নীচু বা শহর গ্রাম, দেশ, ধর্ম, বর্ণ এর বিভেদে হতে পারেনা, সেটুকু উপলদ্ধি করবার মত যথেষ্ঠ জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক সে আমার অর্কের ছিলো। কিন্তু তবুও আমি রাজী হতে পারলাম না, কিছুতেই না।
দু' দুজন পিতৃ ও মাতৃস্নেহের কাছে পরাজিত ও তাদের খুব অনিচ্ছাকৃত ভুলের মাশুলটা গুনতে হলো শেষ পর্যন্ত আমাকেই। তারা যে সত্য গোপন করেছিলো এবং তার পরবর্তী যা কিছু সবই ছিলো আমার প্রতি তাদের অতিরিক্ত ভালোবাসার ফল কিন্তু মামীর কথাটারও তো মূল্য আছে, সত্য তো কখনও গোপন থাকেনা। আমি জানি, একদিন না একদিন, কখনও না কখনও যখন অর্কের বাড়িতে জানবে এই শান শৌকত, জৌলুস ও মিথ্যে পরিচয়ে বেড়ে ওঠা এই আমির শেকড় পোতা রয়েছে অজানা কোনো গ্রামের, অজানা কোনো কুড়ে ঘরের ভিটেতে।
এই আধুনিকা, বিত্তবান মায়ের কোলে বেড়ে ওঠা এই আমির জন্ম কোনো এক হত দরিদ্র রমনীর গর্ভে। সে কথা কি মেনে নিতে পারবে তারা? কখনও না। কোনোভাবেই তা হয়না।
এ বাড়িতে একমাত্র সন্তান জ্ঞানে অতি আদরে বড় হয়েছি আমি। কখনও এক ফোটা দুঃখ পেতে দেননি তারা আমাকে।
তবুও ভাগ্যের দোষে যে দুঃখের স্বাদ গ্রহন করতে হলো আমাকে তা যেন কোনোদিন কোনো শত্রুর জন্যও কারও কাম্য না হয়। ভাবতে অবাক লাগে, বুদ্ধি হবার পর থেকে যাকে বাবা জেনেছি, মা ডেকেছি আজ এত গুলো দিন পরে জানলাম, তাদের সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই! এ কি সহ্য করা যায়! ভাবাই যায়! কেনো আমার সাথে এমন হবে! বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, আমার অতি অভিমানিনী মা, তোমাকেও আমি জীবনের চাইতে অনেক বেশি ভালোবাসি কিন্তু আমার সেই দুঃখিনি মা! তার জন্যও আমার বুকের গভীরে চিনচিনে কি এক অজ্ঞাত ব্যাথা! কেঁদে ওঠে আকুলতা! তার নাম কি ভালোবাসা! নাকি নাড়ির টান! জানিনা আমি। বড় জানতে ইচ্ছে করে। বড় ইচ্ছে করে সেদিনের দেখা তার দুচোখের অবিরল জলপ্রপাতের ধারাগুলি দুহাতে মুছিয়ে দেই। বড় ইচ্ছে করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরি তাকে।
জানতে ইচ্ছে করে কোন অপরাধে দূরে ঠেলে দিয়েছিলো তারা আমাকে? কি হয়েছিলো সেদিন! কেনো তাদের বুকের নিধিকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিলো তারা? বড় জানতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা আমার বাবা, আমার সত্যিকারের বাবা। কেমন দেখতে সে? আমি কি দেখতে বাবার মত নাকি মায়ের মত! কত শত প্রশ্নেরা উঁকি দেয় মনে। তবুও বিস্ময় কাটেনা আমার!
হ্যাঁ আমি তাকে খুঁজে বের করেছিলাম। আমার হতভাগিনী, হত দরিদ্র, দুঃখিনী সেই মাকে! খুঁজে বের করেছিলাম কোনো এক অঁজ পাড়াগায়ের জীর্ন কুটিরে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে ভুগে শেষ হয়ে যাওয়া আমার জন্মদাতা পিতাকেও।
খুঁজে পেয়েছিলাম আমার সহদোরা, অতি অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে পুরোদস্তুর গিন্নী বনে যাওয়া কোনো এক গাঁয়ের বঁধু কে। তবে... তবে সে এক অন্য গল্প, অন্য ইতিহাস!
-------------------------------------------------------------
কয়েক বছর হলো খাগড়াছড়ির বেশ দুর্গম এলাকায় দেবেন্দ্রপাড়ার এক প্রাইমারী স্কুলে ছোট ছোট আদিবাসী শিশুদেরকে নিয়ে ভালোই আছি আমি। পরিচিত মানুষ ও পরিচিত গন্ডি থেকে পালাতে চেয়েছিলাম, ভুলতে চেয়েছিলাম সকল অতীত এবং তা এ ক'বছরে পেরেছিও কিছুটা। আমার যে চেনাগন্ডি, চেনাশহর ও পরিচিত পরিবেশে আমি বড় হয়েছি হঠাৎ সেসব কিছু অসহ্য হয়ে উঠেছিলো আমার কাছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার।
অপরূপা প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের লীলাভুমি এ পাহাড়ী অঞ্চলের অদ্ভুত শীতল সৌন্দর্য্য ও শান্তির মায়াজালে আটকে ফেলেছি নিজেকে।
মাঝে মাঝে অর্ককে ভীষন মনে পড়ে। মনে পড়ে ওর সাথে প্রথম দেখার কথা, সেই সব বর্নীল মুহুর্তগুলো আর মনে পড়ে শেষ দিনটাও। আমাকে ক্ষমা করে দিও অর্ক। আমি জানি তুমি আমাকে বোঝো, তুমি আমাকে ক্ষমা করবেই।
মনে পড়ে জন্ম থেকে যাকে বাবা বলে জেনেছি, যার বুকে মাথা গুঁজে পৃথিবীর সর্বাত্নক নিরাপত্তার স্থান জেনে ঘুমিয়ে পড়েছি ছেলেবেলায়, যেকোনো রকম আশঙ্কায়, বিপদে যে ছিলো আমার পরম নির্ভরতার স্থান, সেই পরম স্নেহময় বাবাকে। মনে পড়ে পক্ষীমাতার মত বুকে আগলে রাখা, জীবনের কোনো অপ্রাপ্তি বুঝতে না দেওয়া আমার অসম্ভব রাগী কিন্তু আমার জন্য ভালোবাসার আঁধার সেই মমতাময়ী মাকে। আর মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেদিন শেকড়ের টানে ছুটে গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গের সেতাবগঞ্জের কাছাকাছি ধুপরঝাড়ি নামক এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের হত দরিদ্র দিনমজুর রহমৎ মিয়া আমার জন্মদাতা পিতার বাড়িতে, আমার জন্মস্থানে।
যখন রাত্রি গভীর হয়। আকাশের বুকে ফুটে থাকা অজস্র তারার মাঝে একটি তারার সাথে কথা বলি আমি...খুব চুপি চুপি...
মা, মাগো, আমার সোনামনি, চিরদুঃখিনী মা,
কেমন আছো তুমি? নিশ্চয় ভালো নেই, এক ফোটা আনন্দও নেই তোমার মনে তাই না মা? নিজের সন্তানকে এইভাবে হারিয়ে কোনো মাই যে ভালো থাকতে পারেনা, সে কথা আমি জানি।
আমাকে হারাবার পর থেকে কেউ কখনও আর কোনোদিন একফোটা হাসিও যে দেখেনি তোমার মুখে সে আমি নিশ্চিৎ রুপে জানি মা। আমি বুঝতে পারি, কতখানি যন্ত্রনায়, কতখানি দারিদ্রে মানুষ তুলে দেয় তার নিজের বুকের নিধিকে অন্যের হাতে! আমি জানি কক্ষনও শুধু মাত্র অর্থের লোভে তোমরা আমাকে বিকিয়ে দাওনি মা। তোমরা চেয়েছিলে আমি যেন সুখে থাকি, একজন বিত্তবান নিঃসন্তান মানুষের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলে তোমরা সেদিন শুধু মাত্র সন্তানের মঙ্গল কামনায়। পর পর তিনটি কন্যা সন্তানের মাঝে একটি অর্থাভাবে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলো, আরও দুটি সন্তানের মাঝে একটি সদ্যজাত সন্তানের ভরণপোষন ও সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চিৎ হাতছানিকে উপেক্ষা করতে পারোনি তোমরা। চরম দারিদ্রের সংসারে অভাব অনটনে জর্জরিত অল্পবয়সী দু'জন পিতা মাতা।
ভেবেছিলে স্বর্গ হতে স্বয়ং দেবদূত বুঝি হাজির হয়েছে তোমাদের জীর্ণ কুটিরে। সে নিয়ে যাবে তোমাদের দুঃখিনী কন্যাটিকে কোনো নিশ্চিৎ সুখের স্বপ্ন রাজ্যে। যেখানে নেই কোনো দুঃখ, নেই বেদনা, এক মুঠো ভাতের জন্য রোজ ঘুম ভেঙ্গে নেই হাহাকার, নেই চিকিৎসা, শিক্ষা বা বাসস্থানের জন্য কোনোই দুশ্চিন্তা। যেখানে প্রতি মুহুর্তে করতে হয়না বেঁচে থাকার লড়াই। সেখানে শুধুই অপার সুখ! যেখানে তোমাদের দুঃখী সন্তানটির কখনও কোনোদিন জানা হবেনা দুঃখ কাকে বলে, অভাব কাকে বলে।
সে থাকবে তার নতুন রাজ্যের একমাত্র রাজকন্যা হয়ে। তোমার ধারনাতে কোনো ভুল ছিলো না মা । সত্যিই আমি রাজকন্যাই হয়ে থেকেছিলাম। যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। মনে পড়ে না এমন কোনো আবদার বা বায়না যা মিটেনি আমার ছেলেবেলা থেকে বড় হবার মুহুর্তটুকুতে।
সবচাইতে বড় যা পাওয়া একজন বাবার নিস্বার্থ ভালোবাসা, একজন মায়ের কলিজা নিংড়ানো মমতা সবই পেয়েছিলাম আমি।
শুধু তোমার একটা ধারনায় ভুল ছিলো মা। পৃথিবীর সকল অর্থ ও সুখের বদলে পাওয়া হয়না একজন মায়ের সন্তান হারানোর সমতুল্য সম্পূরক ব্যাথা ভোলানোর মহৌষধ। এই একটি জায়গায় তুমি ভুল ছিলে মা আর তাই তো সইতে সইতে একটা সময় তোমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গেছিলো। ছুটে এসেছিলে তুমি বিশটা বছর পরে এক ঝলক দেখতে তোমার প্রিয়তর সেই আত্মজার মুখ।
কি আশ্চর্য্য শক্তিতে এক পলকে তুমি চিনে ফেলেছিলে আমাকে মা। কেউ বলে দেয়নি তোমাকে। ঐ যে তোমার শেফালী। আঁতুড় ঘরের ছোট্ট এক রত্তি কাঁদার তালের মত শিশুটি আজ ঝকঝকে তকতকে উচ্চবিত্ত সমাজের শোকেসে সাজিয়ে রাখা জ্বলজ্বলে হীরকখন্ড! তুমি ঠিক চিনে ফেললে তোমার বুকের হারানো মানিককে। কিন্তু কি নিদারুন ব্যাথা সইতে হলো তোমাকে মা! কি নিদারুন অপমান! মাগো দশ দশটা মাস নিজের রক্ত মাংস অনুভুতিতে গড়া সেই হতভাগিনী আত্মজ আমি চিনতে পারলাম না তোমাকে।
ফিরে গেলে তুমি এক বুক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর অপমানের বোঝা কাঁধে নিয়ে আর তাই তো তোমার এ মুখ আর কোনোদিন দেখতেও দিলেনা আমাকে তুমি। কি সাংঘাতিক তোমার অভিমান মা!!
আমার জন্মস্থান সেই কুড়ের আতুড়ঘরের পাশে তোমার কবরের সাথে আমি একটি শিউলী ফুলের গাছ লাগিয়ে এসেছি মা। শিউলি বা শেফালী, তোমার বুঝি খুব প্রিয় ছিলো মা? তাই বুঝি তোমার এ আদরের দুঃখী মেয়েটির নাম রেখেছিলে শেফালী?
তোমার হাত ছুঁয়ে কখনও দেখা হয়নি আমার। কখনও এই দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলতে পারিনি তোমাকে, মাগো তোমাকে ভালোবাসি মা। তোমার ডুরে শাড়ির আঁচলে মুখ মোছা হয়নি কখনও আমার, তোমার পাশে বসে তোমার মুখের দিকে কখনও অপলক তাকিয়ে থাকিনি আমি।
তুমি আজ ঘুমিয়ে আছো চিরশান্তির ঘুমে। যে দুঃখের অনলে পুড়ে পুড়ে তুমি অঙ্গার হলে । সে অঙ্গার আজ শান্ত শীতল নীথর মৃত্যুর হিম শীতল স্পর্শে।
তোমার পাশে শেফালী ফুলের গাছটিকে চিরতরে গেঁথে দিয়ে এলাম আমি । শিশির ভেজা ফুলে ফুলে যখন ছেয়ে যাবে তোমার কবর মনে রেখো সে আমার কান্না, আমার ভালোবাসা।
তুমি ঠিক ঠিক জেনে যাবে তখন তোমার এই অভাগী মেয়ে তার বুকের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে তোমাকে। আমার যখন মৃত্যু হবে সেই মৃত্যুর পরেও আমার ভালোবাসারা ফুল হয়ে ঝরে পড়বে তোমার কোলে মমতা জড়ানো সুগন্ধি শিউলি হয়ে। ফুলে ফুলে ঢেকে যাবে তোমার সমাধি । জড়িয়ে রইবো আমি তোমাকে আমার সকল মমতা দিয়ে। এই পৃথিবী যতদিন ধ্বংস না হবে ততদিন ঝরবে ফুলগুলি।
ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখবো তোমাকে আমি মা। সেই ঝরা ফুলগুলো হয়ে ছুঁয়ে থাকবো তোমাকে। তবুও কি তোমার এক ফোটা দুঃখও কমবে না তাতে? ফুটবেনা কি তোমার মুখে এক চিলতে হাসি?
জানো মা কারো কারো জন্মই হয় শুধুই অন্যকে দুঃখ দেবার জন্য। নইলে পৃথিবীতে তো কত দুঃখের ঘটনাই ঘটে, শুধু এ রকম কিছু আজব দুঃখ বয়ে নিয়ে বেড়ায় কটা মাত্র হাতে গোনা মানুষ। আমার জন্য, শুধু এই একমাত্র আমার জন্য দুঃখ পেলে তোমরা কত্তগুলো মানুষ।
অথচ তোমরা সবাই আমার সুখটাকেই চেয়েছিলে। চেয়েছিলে আমাকে সুখী করতে। না পারলাম না, আমিও না পারলাম তোমাকে সুখী করতে, না পারলাম বুদ্ধি হবার পর থেকে যাদেরকে বাবা, মা বলে জেনে এসেছি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে। চরম স্বার্থপরের মত আমি আজ সবকিছু পায়ে দলে চলে এসেছি মা, অনেক দূরে। সব কিছু লন্ড ভন্ড করে চরম স্বার্থপরের মত পালাতে চেয়েছিলাম আমি।
বাঁচতে চেয়েছিলাম। সুখী হতে চেয়েছিলাম সব দুঃখগুলোকে দূরে হটিয়ে। পারিনি মা। আমি হেরে গেছি। শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছি জগতের অপার রহস্যের এক রহস্যময় খেলার কাছে।
স্বেচ্ছা নির্বাসনে দন্ডিত করেছি নিজেকে। আমি আজ নির্বাসিত বাহিরে, অন্তরে.......
কোথাও কেউ নেই ........
গল্পটা লেখার পর মনটা ভীষন খারাপ হলো। লেখাটা পুরো পড়লাম সাথে রেকর্ড করলাম। রিহার্সেল বা কোনো রকম কারেকশান ছাড়া
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।