আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরবাসী



এয়ারপোর্টের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলো হাসান। হাত ঘড়ি দেখলো, ফ্লাইট মনে হয় ডিলে করছে। এখনই তো আসার কথা। হঠাৎ শুনতে পেলো এনাউন্স হচ্ছে। একটা যান্ত্রিক স্বরে এক মহিলা জানালো বি জি ১২৭ এসে পৌছতে আরও পনেরো মিনিট দেরি হবে।

আস্তে আস্তে পায়চারি করতে লাগলো ও। কে আসছে দেশ থেকে ? তিনঘন্টা আগে ওর রুমে এসেছিলো ওদের ভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট কনসালটেন্ট- বব টার্নার। লম্বা চওড়া এক লোক। সে রুমে ঢুকে বললো- তোমাদের দেশ থেকে এক স্টুডেন্ট আসছে আজ। আমি যেতাম কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেছে।

উইলিয়ামস কে তো চেন, সে হাসপাতালে। ফুড পয়জনিং। ওকে দেখতে যাবো। তাছাড়া ভাবলাম তোমাদের দেশের মেয়ে, তুমি যেতে পারলে হয়তো খুশিই হবে। কখন আসছে ? জিজ্ঞেস করলো হাসান।

বব হাত ঘড়ি দেখলো, আর তিন ঘন্টা পরেই। যেতে তো একঘন্টা লাগবে। হাতে দুঘন্টা সময় আছে। তুমি যাবে ? হাসান মাথা নেড়ে বললো -ঠিক আছে। তুমি উইলিয়ামস এর কাছে যাও, আমি এয়ারপোর্টে যাচ্ছি।

উইলিয়ামস কে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো বব, এখানে মেয়েটার নাম ঠিকানা দেয়া আছে। নাও। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলো হাসান। নাম দেয়া আইরিন খান।

সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেলো হাসানের। অসম্ভব পরিচিত নাম। কত বছর ধরে চেনে সে এই মেয়েটাকে! যে মেয়ের উপর অভিমান করেই সে প্রাণের স্বদেশ ছেড়ে চলে এসেছে এই বিদেশ বিভূইয়ে। এটা কি সেই মেয়ে ? রাত তিনটা। ডিলন এয়ারপোর্ট মোটামুটি শান্ত।

বাইরে হালকা ঠান্ডা। মনোযোগ দিয়ে শুনতে পেলো একটা প্লেন নেমেছে। শব্দ শোনা যাচ্ছে। দাড়িয়ে রইলো হাসান। যাত্রীরা আস্তে আস্তে আসছে।

হাসান তাকিয়ে রইলো। অপেক্ষা করছে একজনের জন্য। অবশেষে দেখতে পেলো একটা মেয়েকে। আবার বুকের রক্ত ছলকে উঠলো হাসানের। সেই আইরিন।

আইরিন খান। কমলা রঙের একটা কার্ডিগান গায়ে দিয়েছে। কি যে সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। আস্তে আস্তে মেয়েটা এগিয়ে আসছে। হাতে একটা বড় লাগেজ।

এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হাসান আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো মেয়েটার দিকে। ওর বুক কাঁপছে। অবশেষে কাছে যাওয়ার পর মেয়েটা দেখতে পেলো হাসানকে। একটু বিষ্ময় ফুটে উঠলো চোখে মুখে।

আরি হাসান ভাই, কেমন আছেন ? হাসান আস্তে করে মাথা ঝাঁকালো। ভালো আছি আমি। তুমি কেমন আছো আইরিন ? ভালো। মেয়েটা মুখ থেকে মৃদু হাসি মুছে বললো। তোমার আম্মা কেমন আছেন ? আব্বা ? ভালো আছেন সবাই।

দেশের কি খবর ? ভালো। তুমি কি জানতে না যে আমি এখানে আছি ? হাসান প্রত্যাশায় মাথা কাত করে বললো। নাহ্। আমি কিভাবে জানবো। হাসান মেয়েটার দিকে তাকালো।

কত বছর পরে দেখা। বিদেশে এসে দেখা হয়েছে একজন চেনা ছেলের সাথে। এভাবে কেন কথা বলছে ? আইরিন হঠাৎ করেই ওর উপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেললো। আশেপাশে তাকাতে লাগলো। কপাল কুঁচকে কি যেন চিন্তা করছে।

তুমি কি কিছু খুঁজছো আইরিন ? আইরিন ওর দিকে এক মুহুর্ত তাকালো। হ্যা। ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে নেবার লোক থাকার কথা। কাউকে তো দেখছি না। হাসান আনমনে একটু হাসলো।

মেয়েটার সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ও চিন্তাও করেনি। আরও কল্পনা করেনি মেয়েটা ওর সাথে এভাবে কথা বলবে। এ যে দেখা হবার চেয়ে না দেখা হলেই ভালো ছিলো। অনেকগুলো ভালো স্মৃতি থাকতো মনের আড়ালে। এতদিন যেগুলো ওকে দেশের কথা মনে করিয়েছে।

আনমনে কল্পনা করেছে। মেয়েটা সম্ভবত কেউ থাকলে এতক্ষণে চলে যেতো। হাসানের দিকে ফিরেও চাইতো না। কে সে !!!!!! আইরিন- ডাকলো হাসান। ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে পাঠিয়েছে তোমাকে রিসিভ করে নিয়ে যেতে।

বব আসতে পারেনি, সেজন্য তোমাকে সরি জানিয়েছে। ও তাহলে আপনি এই কাজই করেন ? ফরেন স্টুডেন্ট আনা নেওয়া করেন ? হাসান ওর কথার মধ্যে পরিস্কার বিদ্রুপ টের পেলো। হাসান আস্তে করে হাসলো। বব আমাকে বললো দেশের লোক পেলে তুমি খুশি হবে। তাই আমি এসেছি।

আমি এখানে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে পি. এইচ. ডি করছি। তুমি যাবে আমার সাথে ? মেয়েটা কি যেন ভাবলো একটুখানি। আচ্ছা চলেন। হাসান মেয়েটার লাগেজ নিয়ে এলো। তারপর দুজন বেরিয়ে এলো এয়ারপোর্ট থেকে।

গাড়ির বুট খুলে তাতে লাগেজ রাখলো। সামনের দরজা খুলে দিলো হাসান। কিন্তু মেয়েটা উঠলো না। ‘আমি পেছনে বসবো। হাসান তাকালো মেয়েটার দিকে, কিন্তু কিছু বললো না।

ওর মনটাই ভেঙে গেছে। গাড়ী চলতে শুরু করেছে। হিটার ছেড়ে দিলো হাসান। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা বেড়েছে। এখনও বরফ পড়া শুরু করেনি কিন্তু শিগগিরিই শুরু হবে।

হঠাৎ আইরিন বললো, প্যান অ্যামের পরের ফ্লাইটটা কখন আসবে জানেন ? হাসান সামনের রাস্তা দেখতে দেখতে একটু চিন্তা করলো। মনে হয় আর একঘন্টা পরেই আসবে। তাই ? জামান তো ওই ফ্লাইটেই আসার কথা ! হাসান গাড়ীর গতি কমিয়ে দিলো। আস্তে করে গাড়ী রাস্তার পাশে থামালো। মাথা ঘুরিয়ে তাকালো আইরিনের দিকে।

কে আসবে ? আইরিন সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো, আপনি গাড়ী থামালেন কেন ? হাসানের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে যেন কি নেই, কি যেন হারিয়ে ফেলেছে। এত মন খারাপ ওর আগে কখনও হয়নি। মেয়েটা তাকে এতো অবিশ্বাস করে ! হাসান আস্তে আস্তে বললো, আমাদের যেতে লাগবে প্রায় দেড়ঘন্টা। জামান যদি আমাদের ভার্সিটির নতুন স্টুডেন্ট হয় তবে তো ওকে নেবার জন্য কেউ আসতে পারবে না।

আবার তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আবার আসতে আসতেও অনেক দেরী হয়ে যাবে। আইরিন বললো, হ্যা জামান আমার সাথেই এডমিশন নিয়েছে। একসাথেই আসতাম আমরা কিন্তু ওর টিকিট পেতে একটু দেরী হয়ে গেলো। আচ্ছা, তাহলে জামানকে নিয়েই যাই। গাড়ী ইউ টার্ন করে আবার এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলো।

আইরিন যে প্লেনে এসেছে সেই প্লেন এর যাত্রীদের নেবার জন্যে যারা এসেছিলো তারা সব চলে গেছে। বেশ রাত, তাই লোকজনও একদম কম। শুধু বিভিন্ন শপে আলো জ্বলছে। লোক জনের নেই ভীড় করে তাতে। ওয়েটিং লাউঞ্জের একটা সোফায় বসে আছে আইরিন।

তার সারা চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। হাত দিয়ে একবার চোখ ডললো। হাসান অপলক তাকিয়ে ছিলো বাইরের একটা ফ্লাড লাইটের দিকে। তার মন অসম্ভব খারাপ। হাসান ভাই, আর কতক্ষণ লাগবে ? হাসান আইরিনের দিকে তাকালো।

তুমি বসো আমি ইনফর্মেশনে জেনে আসি। আইরিন মাথা ঝাঁকালো। হাসান মাথা নিচু করে হাটতে লাগলো। তার মনে চিন্তার ঝড় বইছে। আইরিন তাকে ভুলে গেছে।

হাসান এতোদিন মিছে আশা করে বসেছিলো। প্যান অ্যামের ডেস্কে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে ছিলো। সোনালী চুল তার। ও কাছে যেতেই মেয়েটা মুখ তুলে তাকালো। আপনার জন্যে কি করতে পারি স্যার ? হাসান মেয়েটার দিকে তাকালো আরেকবার।

মেয়েটার মুখেও ক্লান্তির ছাপ। বুক পকেটে নেইম ট্যাগে লেখা ক্যাথি। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে ক্যাথি। আমাকে তুমি কি জানাতে পারো প্যান অ্যামের পরের ফ্লাইটটা কতোক্ষণ পরে আসবে ? ক্যাথি নামের মেয়েটা হাসলো। হ্যা একটু ক্লান্ত।

আজ আমাকে ডাবল ডিউটি করতে হচ্ছে। কম্পিউটার স্ক্রিণে একটু দেখে বললো, তোমার পরের ফ্লাইট আসবে আর পচিঁশ মিনিট পর। একটু ডিলে হচ্ছে আজ। প্লেনটায় মনে হয় কোনো গোলমাল আছে। প্রত্যেকবারই এটা দেরী করে আসে।

থ্যাংস বলে হাসান ফিরে আসতে লাগলো। সামনে একটা ভেিন্ডং মেশিন। দুনিয়ার সবচেয়ে বিচ্ছিরি স্বাদের কফি নাকি এয়ারপোর্টে পাওয়া যায়। তবুও দুটো কফি নিলো ও। তারপর কি মনে করে আরেকটা নিলো।

তারপর তাকালো ইনফর্মেশন ডেস্কের দিকে। ক্যাথি গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ক্যাথির সামনে কফির কাপটা রেখে হাসান সরে যাবার আগেই ক্যাথি চমকে তাকালো ওর দিকে। দাঁত বের করে হাসান বললো, তোমার জন্যে ক্যাথি। মনে হয় বিচ্ছিরি স্বাদের হবে।

খেয়ে দেখতে পারো। ক্যাথি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হাসানের দিকে। এই এশিয়ান ছেলেগুলো যেনো কেমন, ঠিক বোঝা যায়না। হাসানের দিকে আরেকবার ভালোমতো তাকালো। ছেলেটা হেটে যাচ্ছে লাউঞ্জের কোনের দিকে।

দুই হাতে ধরা দুটো কফির কাপ। ওর মনে হলো ছেলেটাকে আগে কোথাও দেখেছে। কিন্তু চিন্তা করার আগেই আরেকজন যাত্রী টিকিট কিনতে এলে ভাবনায় ছেদ পড়লো তার। ঠান্ডার মধ্যে কফির কাপ পেয়ে আইরিন বেশ খুশি হলো। আচ্ছা হাসান ভাই, এই এলাকাটা কেমন ? হাসান মাথা নাড়লো।

ভালোই। আচ্ছা তুমি কোন সাবজেক্ট পড়তে এলে এখানে ? আইরিন তার হ্যান্ড ব্যাগটায় কি যেনো খুঁজতে লাগলো। হাসান ভাবলো মেয়েটা হয়তো তার কথা শুনতে পায়নি। একটু পরেই আইরিন বললো, সোস্যাল সাইন্স। তাই নাকি।

তোমাদের ডিপার্টমেন্টের ডিন রিচার্ড জনসন খুব ভালোমানুষ। খুব হেল্পফুল। চেনেন নাকি ? হাসান মাথা নাড়লো। হু। একবার তার সাথে একটা সাবজেক্টের রিসার্চ পর্যন্ত করেছি।

আইরিন ছোট্ট করে হাসলো। বললো, বাহ্। আপনার তো বহু মানুষের সাথেই চেনাজানা। কথাটা হাসানের ভালো লাগলো না। কেমন সুরে যেনো বললো সে।

অনেকটা ব্যঙ্গের মতো। ভাবলো, আমার মনে আজ থেকে আর কেউ নেই। কেউ নেই। সব মুছে দিলাম। হাসান মনে মনে ভাবলো, আজ থেকে বাইরে আর বেরুবো না।

কারও সাথে মিশবো না। আগে মনটাকে ভালো করতে হবে। সেজন্য দরকার চোখ বন্ধ করে পড়াশুনা করা। মনে পড়লো, ওদের ডিপার্টমেন্টের ডিউ’র কথা। অসম্ভব সুন্দর মেয়ে।

সোনালী চুল। অসম্ভব সুন্দর তার মন। অনেকদিন ধরেই সে হাসানের কাছে কাছে আছে। একদিন বলতেও চেয়েছিলো তার মনের কথা। হাসান বুঝতে পেরে এড়িয়ে গেছে।

কারণ ? কারণ আইরিন। আইরিনের জন্যে সে সব ছাড়তে পারে। গত উইক এন্ডে দেখলো ডিউ আরেকটা ছেলের সাথে ঘুরছে হাতে হাত ধরে। ওর চোখে চোখ পড়তেই ফিরিয়ে নিলো। মনে মনে যে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছে তা হাসান ঠিকই বুঝেছে।

কিন্তু... ওর কিছুই করার ছিলোনা। আজ মনে হচ্ছে এতো ভালো একটা মেয়ে যদি আজ থেকে দুটো দিন পরে আসতো ওর কাছে !! বোধহয় তাকে আর ফিরিয়ে দিতো না হাসান। আস্তে আস্তে করে নিঃশ্বাস ফেললো ও। আইরিন খুব কম কথা বলেছে এতো সময়ে। যা কিছু জিজ্ঞেস করার, একা শুধু হাসানই বলেছে।

আর কতোক্ষণ হাসান ভাই ? হাসান হাত ঘড়ি দেখলো। আর পাঁচ মিনিট। কথাটা বলতে বলতেই জোরালো শব্দে একটা প্লেন ল্যান্ড করলো। ওই এসে গেছে। তুমি বসো আমি নিয়ে আসি।

কিন্তু আইরিনও উঠে দাড়ালো। বসে থেকে কি করবো। তাছাড়া ওকে তো আপনি চিনতে পারবেন না। আমাকেই চেনাতে হবে। হাসানের মন আরেকটু খারাপ হলেও মনে মনে ও বললো, এটা আমেরিকা।

একজন বাঙ্গালী যদি আসে তবে তাকে ঠিকই চেনা যায়। হ্যা, আসো। তুমি চিনিয়ে দিলে তো ভালই হয়। নাহলে আবার ঝামেলা করে আমার পরিচয় দিতে হবে। দুজন এগুলো লাউঞ্জের দিকে।

যাত্রীরা লাইন করে এগিয়ে আসছে। বাইরের দু একজন দেখা গেলো। দুজন নিগ্রো... একজন আরব... তারপর আসা ছেলেটাকে দেখেই হাসান চিনতে পারলো বাঙ্গালী। হাসান তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। চোখে সানগ্লাস।

হাতে গ্লাভস। চোখে মুখে ফুটে বেরুচ্ছে পুরুষালী ভাব। হ্যা, এই ছেলেকে আইরিন পছন্দ করতেই পারে। সাংঘাতিক... তবে হাসানের মনে হলো ছেলেটা অহংকারী হবে। ভাব দেখেই বোঝা যায় মানুষের ক্যারেকটার।

হাসানের আগেই আইরিন এগিয়ে গেলো। ছেলেটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওকে দেখে। হাসান দাড়িয়ে রইলো। আইরিন ওকে যেন কি বলছিলো। হাসান তাকালো আশেপাশে।

মানুষের স্রোত। এবার দুজনে এগিয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে দিলো হাসানের দিকে। শেক করে বললো, আমি তারেক জামান। হাসান তার নিজের পরিচয় দিলো।

বললো, যেতে অনেক সময় লাগবে। যেতে যেতে কথা হবে। চলো। ২৫.০৫.০৪ রাতের পথঘাট কেমন যেন লাগে হাসানের। আসলে আমেরিকা দেশটাই যেন কেমন।

গাড়ী যাচ্ছে অনেক স্পিডে। বাংলাদেশে তো সেটা কল্পনাও করা যায়না। এদেশের প্রত্যেকটা ল্যম্পপোষ্টে বাতি জ্বলছে। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত পথ। আনমনে এসব চিন্তা করছিলো হাসান।

হঠাৎ খেয়াল করলো পেছনে দুজন নিচু গলায় কথা বলছে। হঠাৎ জামান হি হি করে হেসে উঠলো। হাসান আস্তে করে বললো, আপনাদের দুজনেরই থাকার জায়গা ঠিক হয়ে গেছে। তুলি থাকবে ডরমিটরী এ'তে। আপনি ডরমিটরী ই'তে।

হাসান ভিউ মিররে তাকিয়ে দেখল জামান ভ্র কুঁচকে তার দিকে তাকালো। সম্ভবত তুলি না বলে মিস তুলি বলা উচিত ছিল। তারপর সময় কেটে গেল আরও কিছুক্ষণ। একসময় গাড়ীটা এসে থামলো বিশাল এক বিল্ডিংয়ের নিচে। গাড়ীর শব্দ শুনে নেমে এলো এক মহিলা।

অরিণ ফরেন স্টুডেন্ট’স এফেয়ার্সে কাজ করে। হাসান জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললো, তোমার নতুন স্টুডেন্টদের নিয়ে যাও। ওরা দুজন দরজা দিয়ে বের হয়ে তাকাতে লাগলো আশেপাশে। সোডিয়াম লাইটের আলোয় উজ্জ্বল আশপাশ। হাসান চুপচাপ দেখলো ওদেরকে।

তারপর বুট থেকে ওদের ব্যাগগুলো দ্রুত পায়ে সেগুলো ডরমিটরীর গেটে নামিয়ে দিলো। দেখলো অরিন ওদের সাথে কথা বলছে। হাত নেড়ে কি যে বুঝাচ্ছে কে জানে। হাসান ড্রাইভিং সিটের দরজায় দাড়িয়ে জোরে একবার বললো, বাই এভরিবডি। ওর কথা শুনে অরিন হাত তুললো।

তুলি ঘাড় বাকা করে তাকালো ওর দিকে এক পলক। তারপর হাসানের গাড়ীটা শা করে বের হয়ে গেল। ৩০.৭.০৫ পাঁচদিন পরের কথা। হাসান গাড়ী থেকে নামতে নামতে ফুস করে শ্বাস ফেললো। কালই পেপার টা দেখাতে হবে অথচ ফাইনাল করা হয়নি।

এ কদিন গাধার খাটুনি গেল। ইউনিভার্সিটির কিছু দরকারি কাজ ছিলো। ওদের ইউনিভার্সিটির আরেকটা ক্যাম্পাস ক্যাম্পবেলটাউনে। পাশের শহরে। চার ঘন্টার ড্রাইভ।

পার্কিংয়ে গাড়ীটা রেখে ক্যাম্পাসে ঢুকলো ও। কি সুন্দর পরিবেশ। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। গাছের তলায় কয়েকটা বেঞ্চ ফেলা। তাতে কয়েকজন বসে বসে হৈ হুল্লোড় করছে।

পাশ দিয়ে যাবার সময় খনখনে গলায় পাশ থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো। হুসান হুসান, এই উইকএন্ডে কোথাও যাচ্ছ নাকি ? চলা না থামিয়েই হাসান বললো, জানি না। তোমরা যাচ্ছ নাকি কোথাও ? এরিক নামের সেই চিকনা গলার ছেলেটা বললো, যাবো। এখনও ঠিক করিনি। ঠিক কর।

দু পা এগিয়েই হাসানের হাটার গতি থেমে গেল। ডিউ বসে আছে একটা বেঞ্চে। হাতে একটা বই। ওকে দেখেনি এখনও। ঘুরতে যাবে ঠিক তখন ডিউ বললো, ব্যস্ত না থাকলে আমার সাথে একটু বসতে পার।

হাসান ঘাড়টা নেড়ে বেঞ্চে গিয়ে বসলো। ওর প্রথম থেকেই ধারণা এই ডিউ নামের মেয়েটার কয়েকটা চোখ। ক্লাশের প্রথম দিন ওর পাশের সিটে বসেছিলো ডিউ। লম্বা কালো চুল দেখে ওর মনে হলো, প্রায় বেশির ভাগ মেয়েদের চুল সাদা অথচ এই মেয়েটার চুল এত কাল ! সেই সময় মেয়েটা ওর দিকে ঘুরে বললো, আমি কিন্তু ফ্লাট্যারিং পছন্দ করিনা। কিন্তু কালো চুল আমার খুব পছন্দের।

হ্যালো, আমি ডিউ। হাসান মাথার পেছনে হাত দিয়ে বেঞ্চে হেলান দিলো। ডিউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ক্যাম্পবেলটাউনে গেলে আমাকে বললে না কেন ? হাসান পকেটে হাত ঢুকিয়ে আবার বের করে ফেললো। সরি।

সরি ডাজনট ওয়ার্ক এভরি টাইম। হাসান আবার পকেটে হাত দিলো। ডিউ ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার জন্যে কি চকলেট আছে তোমার পকেটে ? হাসান জোরে মাথা নাড়িয়ে বললো, না তো। কিন্তু হাসান আবার পকেটে হাত ঢুকিয়েই টের পেলো সত্যিই পকেটে বড়সড় একটা চকলেট আছে। বোকার মতো সেটা বের করে তাকিয়ে রইলো ওটার দিকে।

কিভাবে পকেটে এলো ? ডিউ ওর হাত থেকে একলেয়ারটা নিয়ে ধাম করে বইটা পাশে রেখে বললো। উমমমমা। এই জন্যেই আমি তোমাকে এতো পছন্দ করি হাসান। হাসান মুখটা একটু ঝাকালো। অবচেতন ভাবেই হয়তো ডিউর জন্যে কিনে রেখেছে কখনো।

কি অদ্ভুত। ১৮.১২.০৫ এরিক আবার এগিয়ে আসছে। এই ছেলেটা অসম্ভব জলি মাইন্ডের। হাসানের খুব ভক্ত। হুসান, লিসেন... বলে সে এত দ্রুত কি যে বললো যে হাসান কিছুই বুঝলো না।

হাসান ওর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, মুখে কি ? কি খাও ? ওটা আগে শেষ কর। আর কথা গার্গল কর কেন ? আবারও এরিক কি যেন বললো। হাসান একটু সরে বসলো। তোমার মুখ থেকে থুতু বেরুচ্ছে। এরিক আশেপাশে তাকালো বিরক্ত মুখে।

ডিও দেখতো, ও কি বলে। আমি কি থুতু ছেটাই ? হাসান হালকা স্বরে বললো, সেই সাথে খাবারের গুড়োও থাকে। এরিকের শনের মতো সাদা চুল রাগে আরও সাদা হয়ে গেল। চাঁদির একগাছা চুল ছাগলের লেজের মতো বাতাসে দুলছে। দেখে হাসান আর ডিউ হাসতে হাসতে বেঞ্চেই শুয়ে পড়লো।

শার্টের হাতায় মুখ মুছে এরিক তাকালো ডিউর দিকে। নাও আই অ্যাম ওকে। হাসান হাসতে হাসতে বললো, ওকে। ডিউ হাসতে হাসতে বললো, হোকে। হাঃ হাঃ হাসানের পাশে বসলো এরিক।

আ.... আ...ড্যাম। আমার কথাটা তো শুনো আগে ! হাসান ওর কাঁধে হাত রাখলো। হু বলো, শুনছি। এই উইকএন্ডে আমরা ডেভিল মাউন্টেইনে যাবো। তুমি আমাদের সাথে অবশ্যই যাচ্ছো।

(আগামী পর্বে সমাপ্ত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।