আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বোমাবাজি আগুনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো হরতাল

বিচ্ছিন্ন সহিংসতা, গাড়িতে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ঢাকাসহ সারা দেশের ৬০ ঘণ্টার টানা হরতাল। রাজধানীতে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা না ঘটলেও বোমাবাজি, ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে ৬০ ঘণ্টার হরতালের আগে ও পড়ে সহিংসতায় সারা দেশে অন্তত ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়া বিরোধী দলের দাবি তাদের প্রায় আড়াই হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার ও আহত হয়েছে সাত হাজারেরও বেশি। এদিকে পুলিশের গুলিতে প্রাণহানির ঘটনায় বিএনপি আগামীকাল সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। শুক্রবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বাদ জুমা গায়েবানা জানাজার উদ্যোগ নিয়েছে।

গত দুই দিনের তুলনায় গতকাল রাজধানীর সড়কগুলোতে যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা বাড়ে। সড়কগুলোতে যাত্রীবাহী বাসের পাশাপাশি সিএনজি চালিত অটোরিকশা, লেগুনা, ইজিবাইক ও রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়। গাজীপুর জেলা সদরের শিববাড়ি মোড় এলাকায় সকালে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে সিটি মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান ও পুলিশের পাঁচ সদস্যসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। রাত পৌনে ৯টার দিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উত্তরার বাসার দিকে লক্ষ্য করে পর পর দুটি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এর একটি দোতলার বারান্দায় অন্যটি গেটে বিস্ফোরিত হয়। এতে কেহ হতাহত হয়নি। এ সময় মির্জা ফখরুল বাসায় ছিলেন না।

রাজধানীর ধানমন্ডি ও মিরপুরে হরতাল-সমর্থকদের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে পুলিশের দুজন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। মহাখালীতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যালয়ের পাশ থেকে ককটেল উদ্ধার করা হয়। সকাল পৌনে ৮টার দিকে পশ্চিম ধানমন্ডির ১৯ নম্বর সড়কে হরতাল-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ হরতালকারীদের ধাওয়া করলে তাদের ছোড়া ককটেলের বিস্ফোরণে হাজারীবাগ থানার ওসি মইনুল ইসলাম গুরুতর আহত হন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সকাল ৮টার দিকে মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের সনি সিনেমা হলের সামনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করেন। এ সময় পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিলকারীরা কয়েকটি যাত্রীবাসে ভাঙচুর করে। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়ে। ককটেলের বিস্ফোরণে শাহ আলী থানার এসআই সাইফুল ইসলাম আহত হন। সকাল সাড়ে ৭টায় পল্লবী থেকে ককটেলসহ একজনকে আটক করা হয়। এ ছাড়া ভোর সোয়া ৬টার দিকে তেজগাঁও কলেজের সামনে থেকে ককটেলসহ জুয়েল নামের একজনকে এবং সকাল ৭টার দিকে পান্থপথে ককটেল ও পেট্রলবোমাসহ আলমগীর নামের আরেকজনকে আটক করেছে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। অন্যদিকে হরতাল-সমর্থকদের দেওয়া আগুনে তেজগাঁও কুতুববাগ দরবার শরিফের সামনে একটি বাস পুড়ে গেছে।

জুরাইনে হরতালকারীদের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে রহিমা আক্তার নামের একটি শিশু আহত হয়। বেলা ১১টার দিকে রহিমা জুরাইন বালুর মাঠে খেলছিল। এ সময় ককটেলের বিস্ফোরণে রহিমার শরীর ঝলসে যায়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক।

রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিনটি ককটেলসহ মো. সুজন, মো. ইমন ও মো. পারভেজ নামের তিন যুবককে আটক করেছে র্যাব। সকাল ৮টার দিকে সেগুনবাগিচা এলাকায় একটি মিছিল বের করে হরতাল-সমর্থকেরা। এ সময় পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। পুলিশ সেখান থেকে দুই কর্মীকে আটক করে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে দুটি ককটেল ছুড়ে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। তবে সেখানে উপস্থিত পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। এ ছাড়া বেলা দেড়টার দিকে পল্টন মোড়ে দুর্বৃত্তদের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে খোরশেদ নামের ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী আহত হন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় হুইপ সাগুপ্তা ইয়াসমিন এমিলির পিতার পল্টনের বাসার সামনে ৩টি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ ছাড়া হরতাল চলাকালে ছাত্রশিবির ভোর ৬টা থেকে ঢাকা শহরের ১৬টি জায়গায় মিছিল, অবরোধ ও পিকেটিং করেছে।

পুলিশের গুলিতে টিভি ক্যামেরাম্যান আহত : সকালে পুরান ঢাকার বংশালে পুলিশের গুলিতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরাম্যান মাসুদুর রহমান আহত হন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ জানায়, মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালায়। এ সময় মাসুদুর রহমানের গায়ে গুলি লাগে। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে মো. দুলাল, জাহাঙ্গীর হোসেন ও জামাল হোসেন নামের তিনজন পথচারী আহত হন। আশপাশের লোকজন তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

পুরান ঢাকায় পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা : পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা। বেলা সাড়ে ১২টায় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আল আশরাফ মামুনের নেতৃত্বে ইসলামপুর রোডে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। মিছিল থেকে ইটপাটকেল দিয়ে ফাঁড়িতে হামলা করলে ধাওয়া দিয়ে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। এরা হলেন, ছাত্রদল কর্মী জবি ইতিহাস বিভাগের লিটন ঘোষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের হিমেল, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ওয়াহিদ। পরে তাদের প্রত্যেককে এক বছর করে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিরু রায়। এদিকে দুপুর ১টার দিকে শ্যামবাজারে ঝটিকা মিছিল বের করে চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় শিবির কর্মীরা। পরে ধোলাইখালে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা।

পুলিশের বেষ্টনীতে নয়াপল্টন কার্যালয় : বরাবরের হরতালের মতো র্যাব, পুলিশসহ সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেষ্টনীতে ছিল বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। দিনভর নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকতে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কার্যালয়ের সামনে তিন স্তরে পুলিশি ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। দুই দিন আগে থেকে অবস্থান নেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালামসহ কিছু নেতা-কর্মী গতকাল সন্ধ্যায় হরতালের পর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়েন। কার্যালয়ের সামনে রায়ট কার, জলকামান, প্রিজন ভ্যানসহ দুটি সাদা মাইক্রো সার্বক্ষণিক রাখা হয়। তবে সন্ধ্যার দিকে কার্যালয়ের অদূরে দুটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এতে মানবজমিনের সিনিয়র রিপোর্টার কাফি কামালসহ তিনজন সাংবাদিক সামান্য আহত হন।

বিএনপির তিন নেতার বাসায় হামলা : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের শাজাহানপুরের বাসায়, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার গোপীবাগের বাসা ও সদস্য সচিব আবদুস সালামের শান্তিনগরের বাসাকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল বিকাল পৌনে ৩টার দিকে তার বাড়ি লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। এর আগে সোমবার রাত ১০টার দিকেও মির্জা আব্বাসের বাড়ি লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা এলাপাতাড়ি গুলি ও বোমা ছোড়ে পালায়। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। সোমবার রাত ৯টার দিকে আবদুস সালামের শান্তিনগরের বাসায় এলাপাতাড়ি গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আবদুস সালাম বাসার বাইরে ছিলেন। বাসার সামনে রাখা তার একটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগকে দায়ী করে আবদুস সালামের ব্যক্তিগত সহকারী শওকত আজিজ একটি মামলা দায়ের করেন। এদিকে রাতে আবদুস সালামের বাসায় যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।

ককটেলে ঝলসে গেল শিশু রহিমা : হরতাল সমর্থকদের রেখে যাওয়া ককটেল বিস্ফোরণে ৯ বছরের শিশু রহিমার শরীর ঝলসে গেছে। তার ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, বাম চোখও নষ্ট হওয়ার উপক্রম। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর পশ্চিম জুরাইনের তোলার বাগিচায় এ ঘটনা ঘটে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর বেডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পরিত্যক্ত লাল রংয়ের স্কচটেপ মোড়ানো ককটেল হাতে নিয়ে নাড়াচাড়ার সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বোমার স্প্লিন্টার তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্ধসহ শরীর ঝলসে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছে।

রহিমার বাবা ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী আবদুস সোবাহান মোল্লা জানান, রহিমা পরিবারের সঙ্গে পশ্চিম জুরাইনের ১৪৫ নম্বর বাড়িতে থাকে। সকালে পশ্চিম জুরাইন বালুর মাঠের পাশে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি চলে যাওয়ার পর সেখানে অবিস্ফোরিত অবস্থায় ৩/৪টি ককটেল পড়ে থাকে। ওই সময়ে রহিমাসহ আরও দুজন বালুর মাঠে কাগজ কুড়াতে যায়। এ সময় লাল স্কচটেপ মোড়ানো একটি বস্তুসদৃশ দেখতে পায় তারা। রহিমা বস্তুটির ভেতরে কি আছে তা দেখার জন্য বাকি দুজনের থেকে আলাদা হয়ে টেপ খুলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর ককটেলটি তার হাতেই বিস্ফোরিত হয়ে রহিমার দুই চোখ, মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাত প্রাপ্ত হয়। ঢাকা মেডিকেলের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. আল মাহমুদ লেমন জানান, রহিমার ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া বাম চোখের ভেতরেও ককটেলের স্প্লিন্টার ঢুকেছে। চেষ্টা চলছে তার বাম চোখটা রক্ষা করতে। রহিমার শরীরের বিভিন্নস্থানে যেভাবে স্প্লিন্টার ঢুকেছে তাতে সে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি তাকে ভালো করে তোলার জন্য।

পুলিশের ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইলিয়াছ শরীফ জানান, কারা ওইস্থানে ককটেল ফেলে রাখে তা তদন্তপূর্বক দুর্বৃত্তদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.