লেখাটি যখন শুরু করছি তখন বিএনপি-জামায়াত জোটের দ্বিতীয় পর্যায়ের ৬০ ঘণ্টা হরতাল শুরু হয়েছে। মাঝখানে খানিকটা আশা জেগেছিল সংলাপ হবে বলে। সেই আশার প্রদীপ নিবে গেছে। আমাকে জনাব মাহফুজুল্লাহ একবার এক টকশোতে অনুযোগ করে বলেছিলেন, আপনি তো হতাশার কথা বলেছেন কিন্তু আমাদের আশা নিয়ে বাঁচতে হবে। আশার কথা বলতে হবে।
আমি পাল্টা জবাব দিয়েছিলাম এই বলে, নিশ্চয়ই মানুষ আশা ছাড়া বাঁচতে পারে না। কিন্তু আমি আশার আলো দেখছি না। এটা কয়েক মাস আগের কথা। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনের ওই একই টকশোতে বছর দেড়েক আগে (সঠিক সময় আমার মনে নেই) আমি একই কথা বলেছিলাম। প্রায় একই সময় আগে অথবা পরে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রথম পৃষ্ঠায় একই মর্মে আমার লেখা ছাপা হয়েছিল।
যার মূল কথা ছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে বিতর্কের প্রধান চরিত্র অথবা কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থেকেই নির্বাচন করবেন। বিএনপি তাকে মানবে কি মানবে না সেই চ্যালেঞ্জই তিনি ছুড়ে দিয়েছেন। কোনো রকম হস্তক্ষেপ ছাড়া এই বিতর্কের নিষ্পত্তি হবে বলে আমার মনে হয় না। আমি বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা স্মরণ রেখে এ কথাও বলেছিলাম, এর মাধ্যমে আমি কোনো অরাজনৈতিক শক্তির হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত করছি না।
আমি এখন অরাজনৈতিক শব্দটি ব্যবহার করা পছন্দ করছি। সাধারণত আমাদের দেশে অসাংবিধানিক বলা হচ্ছে। অসাংবিধানিক!! স্বাধীনতার পর থেকেই দেখছি ক্ষমতাসীনদের বড় প্রিয় শব্দ এটি। সেটাও আবার নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য প্রযোজ্য। ঈমান পরিষ্কার না থাকলে এই কথার কি কোনো মানে আছে।
মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে একদল গঠিত হয়েছিল। সেটি কি সাংবিধানিক ছিল? কিন্তু চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়ে যাওয়ার পর সেটি তো সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবার যখন... সংশোধনী পাস হওয়ার পরে সেই চতুর্থটি থেকেও আর রইল না। পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার আগে তিনটি নির্বাচনী টার্মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ছিল সংবিধানসম্মত। আবারও মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে তা হয়ে গেল অসাংবিধানিক বেআইনি।
আজ যদি হঠাৎ করে কোনো কারণে অথবা কারণ ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর মনে হয় তবে এই পঞ্চদশ সংশোধনীর বিধানগুলোও অসাংবিধানিক হয়ে যাবে।
আমি হস্তক্ষেপের কথা বলছিলাম। এটা এ জন্য যে, আমার কখনো মনে হয়নি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাদের দেশের প্রধান দুই নেত্রী সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেবেন। এখন আমার মনে হচ্ছে পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছে যে, সে রকম উদ্যোগও আর কোনো সুফল বয়ে আনতে পারছে না। আমাদের দেশের অভ্যন্তরে গুণী মানুষ আছেন, যাদের আন্তর্জাতিক মহল সম্মান করে।
আমরা ইতোমধ্যে সেসব মানুষকে হেয় করার চেষ্টা করেছি। সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য এবিএম মূসা, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ড. আকবর আলি খান, টিআইবি, সুজনসহ অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন প্রস্তাব করেছিল। তাদেরও তিরস্কার করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতোমধ্যে কয়েক দফা বাংলাদেশের অদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন, প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, দুই নেত্রীর সঙ্গে সরাসরি টেলিফোনে কথা বলেছেন, তাতে বরফ এতটুকু গলেনি।
জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে তেমন কার্যকর কোনো সংস্থা বলে মনে করে না কেউ। কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংস্থার সদস্য দেশসমূহের সম্মতির প্রয়োজন হয়। সবাই জানে এ বড় সহজ কাজ নয়। হ্যাঁ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশী ভারত এবং দূরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রকে হিসেবে নেয় মানুষ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করতেন এই দুটি দেশ মিলে যদি একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে তবে হয়তো একটা কিছু হতে পারে।
এই দুই দেশ মিলে কেন? তার কারণ সম্ভবত বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। সব কিছু মিলে বাংলাদেশ মিয়ানমার এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তান পাকিস্তানের পর বাংলাদেশে এখন জঙ্গিবাদ আস্তানা গাড়তে পারে এ কথা মনে করে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো। ওদিকে চীনও তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চোখ রাখছে সেদিকে।
কিন্তু আধিপত্যে চীন যদি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে তখন বিশেষত এই অঞ্চলে ভারতের বন্ধুত্ব প্রয়োজন। এই উভয় দিক থেকে ভারতও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে চায়। কিন্তু মজার ব্যাপার, যে দেশ নিয়ে হচ্ছে কথা সেই দেশের সরকার সম্পর্কে ভারত ও আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন নয়। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমানে ড. ইউনূস এবং অন্যান্য বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব বেড়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এতই বিরক্ত যে, গত এক বছরে তাকে কোনো সাক্ষাৎ দেননি শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ড্যান মজিনা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করেছেন। খুব খোলামেলা কথাবার্তাও বলেছেন এবং অবশেষে তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের সঙ্গে কথা বলেছেন, এরপর তিনি গেছেন দিলি্ল। ড্যান মজিনার দিলি্ল যাওয়া নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, এসব কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভুত। অন্যরা পর্যন্ত দৃষ্টি রাখার চেষ্টা করেছেন ঘটনা প্রবাহের প্রতি।
পত্রপত্রিকা ড্যান মজিনার দিলি্ল সফর নিয়ে লিখেছে এসব থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অন্য কোনো কারণ যদি কেউ দেখাতে চান তার পরেও এটা সত্য যে, মজিনার দিলি্ল সফরের মূল এজেন্ডা ছিল বাংলাদেশ।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা কি নিজের উদ্যোগে দিলি্ল গিয়েছিলেন? বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিজে থেকেই এরকম পদক্ষেপ নিতে পারেন? সাধারণভাবে না। কোনো কূটনীতিকই (তিনি যত ছোট বা বড়মাপেরই হোন না কেন) তার বৃত্তের বাইরে যেতে পারেন না, যদি না তার দেশ তাকে সেরকম অনুমোদন দেয়। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ভারতের কোনো কোনো পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী ড্যান মজিনাকে ভারত সরকার বা সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ তাকে সে দেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি।
ভারত সফর শেষে ড্যান মজিনা বাংলাদেশে ফেরার পরে এদেশের কোনো কোনো পত্রিকা তার সফরের খবর প্রকাশ করেছে।
সে খবর অনুযায়ী ড্যান মজিনা সেখানে ভারতের বিখ্যাত সাউথ ব্লগের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। তাতে প্রকাশ পেয়েছে যে, ভারত সরকার এখানে অবস্থিত রাজনৈতিক সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন চায় না। ইতিপূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বরাত দিয়ে দেশের কোনো কোনো প্রধান সংবাদপত্র খবর দিয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান দেখতে চায় না।
ভারতীয় কংগ্রেস এখন সেই দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেভাবে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল তার বিপরীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়ার কারণে শাসক দল ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। এখনো সে সম্পর্ক অটুট আছে। সীমান্ত চিহ্নিতকরণ, তিস্তার পানি বণ্টনসহ কতিপয় বিষয়ে টানাপোড়েন থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার, ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেনি এবং ভারত সরকার তাতে প্রীত। এখানকার পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন ভারত এই সম্পর্কই অব্যাহত রাখতে চায়। এখানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কি মিলবে?
আমাদের প্রশ্নের জবাব জানার তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না।
কারণ আমরাই আমাদের দেশের রাজনীতি নির্ধারণ করব। তাই হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, তা হচ্ছে না। দুই দল বা দুই নেত্রীর সংলাপ নিয়ে যারা যতই আশাবাদ ব্যক্ত করুন না কেন সংলাপের দরজা আর খোলেনি। খুলবে কি? বেগম জিয়া ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব অনুযায়ী উভয় দলের মহাসচিব পর্যায়ে শর্তহীন বৈঠকে সম্মত হয়েছেন।
কিন্তু তার প্রতিপক্ষ দলের সাধারণ সম্পাদক দুই নেত্রীর কথা বলেছেন। বলেছেন, ২৮ তারিখের জন্য যে দাওয়াত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন তা এখনো বহাল আছে। বেগম জিয়া যে কোনো দিন এলেই পারেন। আর দলের সভানেত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার উদ্দেশে বলেছেন, হরতাল প্রত্যাহার করে আসুন, আলোচনা করি, দু-একটা মন্ত্রণালয় চান, তাও দিয়ে দিই।
পাঠকবৃন্দ, আপনাদের কি মনে হয় আলোচনার দরজা খোলা আছে? এটা কি শিয়াল আর বকের দাওয়াতের মতো নয়? এটা এখন সবাই বোঝে।
এক হাত দিয়ে ডাকছেন আর এক হাতে দরজার খিল লাগিয়ে দিচ্ছেন। বক্তৃতায় সংলাপের জন্য আহ্বান করছেন আর মনে মনে মুচকি হাসছেন অথবা গোসসায় ফেটে পড়ছেন। কোনো লুকোচুরি নেই। ওরা কানামাছি খেলছে। বিরোধী দল আপাতত অবরোধ দেয়নি, আরও বড় করে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।
আবারও ৬০ ঘণ্টার হরতাল দিয়েছে। এই লেখা ছাপায় যাওয়া পর্যন্ত অন্তত ৬ জন মরেছে, শতাধিক আহত হয়েছে। কেউ আর ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তা করছেন না। মৃত এখন জীবনের কাছে পরাজিত হয়েছে।
পাঠকবৃন্দ, কি হবে? সবাই এ প্রশ্ন করেন এবং কারও কাছে জবাব নেই।
ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা এত উদগ্র হয়েছে যে, তার যুবকাষ্ঠে বলি হতে যাচ্ছে সমগ্র জাতির স্বার্থ। নাগরিকরা রুখে দাঁড়ান। এটাই একমাত্র পথ। এই দুই দল এবং দুই নেত্রী আমরা যতই চাই, আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। আমাদের নিরাপত্তা আমাদের অর্জন করতে হবে।
দলমত নির্বিশেষে নাগরিকদের একটি ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।