শেখ হাসিনা
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
বেগম খালেদা জিয়া
মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা, চেয়ারপারসন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
এইচ এম এরশাদ
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।
প্রিয় সম্মানীত নেতৃবৃন্দ,
আমাদের ইতিহাস গণতন্ত্র, আইনের শাসন, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতার পৃথকীকরণের জন্য আন্দোলনের পর আন্দোলন এবং সংকটের পর সংকটে পরিপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দেশ স্বাধীনের ৪০ বছর পর আজো আমাদের এসবের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। অবশ্যই ৪০ বছর জাতীয় জীবনের জন্য খুব একটা বেশি সময় নয়। কিন্তু অবশ্যই একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করার জন্য যথেষ্ট সময়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে রাজনীতিসহ যে কোনো সংকট এড়ানো যায়। জনগণকে রাস্তায় রক্ত দিতে হতো না, রাজনীতিবিদরা জনগণের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাজনীতি নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অর্থ এবং পেশিশক্তি রাজনীতিকে কলুষিত করে তুলেছে এবং আমাদের সমাজকে সার্বিকভাবে অধঃগতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যাদের হাতে ক্ষমতা তারা প্ররোচনার মাধ্যমে, শক্তিমত্তার সঙ্গে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃত্বকে এবং শিক্ষাস্থলকে রাজনৈতিকীকরণের মধ্য দিয়ে দূষিত করে তুলেছেন। আজ বিচার বিভাগ এবং আমলাতন্ত্র পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। একজন অনির্বাচিত ব্যক্তিকে স্পিকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদের মর্যাদা মলিন করা হয়েছে। আমি অনির্বাচিত বলছি এ কারণে যে, এই সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলো দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব হার অনুসারে আনুপাতিকভাবে বণ্টন করা হয়। সেখানে প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ নেই। সে কারণে একটি সংরক্ষিত আসনের একজন সদস্যকে নির্বাচিত বলে আখ্যায়িত করা যায় না। এ দুঃখজনক বিষয়ের দায়দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে। রাজনীতিতে এবং রাজনীতিবিদদের এতসব দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। কিন্তু এ জন্য আমি রাজনীতিবিদদের কোনো কৃতিত্ব দিতে নারাজ। অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পেছনে রয়েছে বেসরকারি খাত এবং এনজিওগুলোর উদ্যোগ। রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের অনেক দুর্বলতা থাকলেও পরিণত জাতি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে হবে। আর এ জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বুলেট নয়, ব্যালটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। গণতন্ত্রের আরও অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ব্যালটই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে। তখনো আমি বিরুদ্ধে ছিলাম যখন জামায়াতে ইসলামী এ ধারণাটি উপস্থাপন করে এবং আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি তা প্রবর্তনের জন্য জাতিকে প্যারালাইজ করে দেয়। যা ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অর্জন করা হয়। আমরা যখন সাংবিধানিক বিধিবিধান নিয়ে চ্যালেঞ্জ করলাম তখন জামাতিরা এবং আওয়ামী লীগাররা বললেন, আমাদেরকে দিয়ে জাতীয়তাবাদীরা তা করিয়েছে। জামায়াত এবং আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণাকে সমর্থন করে আদালতে শপথ নিল। আমি ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করলাম। কারণ এটি রাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট চরিত্রকে ধ্বংস করে এবং এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে দুর্বল করেছে। আদালতে যুক্তিতর্কে আমি এবং অন্যরা অংশ নিয়েছিলাম। আমরা কী কখনো ভেবে দেখেছি, একটি জাতি হিসেবে আমরা আমাদের জীবনও পাঁচ বছরের জন্য এমন নির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছি যে, সেই লোকগুলোকেই আবার আমরা ব্যালটের প্রশ্নে বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের এতটুকু ম্যাচিউরিটি অর্জন করতে হবে এবং নির্বাচন কমিশনকে একটি অবাধ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মতো শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। আমি অন্য উদাহরণে যাব না। যদি ভারতের নির্বাচন কমিশন পারে, তাহলে আমাদের নির্বাচন কমিশনের না পারার কোনো কারণ নেই। আসুন আমরা আমাদের নির্বাচন কমিশনকে একটি শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলি। একজন রাষ্ট্রপতি অথবা একজন প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি অথবা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, অন্য কারও কাছে নয়_ এটাই গণতন্ত্রের মূল কথা। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে, সাংবিধানিকভাবে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ নেই। একই সঙ্গে আমাকে বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এ কথাও বলতে হবে, নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করলে তা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। কারণ আমলাতন্ত্র নির্বাচন কমিশন এবং বিচার বিভাগকে রাজনৈতিকভাবে দূষিত করা হয়েছে। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র এবং বিচার বিভাগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতার মাঝে হিমালয় সমান বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। এই অবিশ্বাসের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করা আবশ্যক। যদিও প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতা টেলিফোনে আলোচনা করেছেন কয়েক দিন আগে। তাতে যে কোনো আশাব্যঞ্জক ফল আসবে না তা আমার জানা ছিল। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র এবং বিচার বিভাগ সুনিশ্চিত করতে অর্থপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন। আমাদের রাজনীতির যে রুগ্ন অবস্থা তাতে নিকট ভবিষ্যতে তা সম্ভব বলে মনে হয় না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে একটি অবাধ, সুুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার প্রস্তাব অনুসারে সমস্যার একটি জরুরি সমাধান প্রয়োজন। সে কারণে আমি নিচের একটি উদ্যোগের কথা বলতে চাই। এতে যতই ভুল বোঝার অবকাশ থাকুক না কেন। কারণ এর মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে আমি সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার দায় বোধ করছি :
১. মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। ১০ জন মন্ত্রীর একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবে এবং তাদের কেউ শেখ হাসিনার গঠিত মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হতে পারবেন না। এই ১০ জনের মধ্যে ৪ জন হবেন আওয়ামী লীগের, ৩ জন বিএনপির, ২ জন জাতীয় পার্টির এবং ১ জন স্বতন্ত্র সদস্য নিয়ে। শেখ হাসিনা হবেন সরকারপ্রধান। ২. মন্ত্রীর মর্যাদায় ১০ জন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিতে হবে বিরোধীদলীয় নেতার পরামর্শক্রমে। এই উপদেষ্টারা মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে উপস্থিত হবেন নিমন্ত্রিত হিসেবে। তারা মন্ত্রীদের উপদেশ দেবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো সারাংশে তারা স্বাক্ষর করবেন। রুলস অব বিজনেসে পরিবর্তন এনে এটি করা সম্ভব। যে উপদেষ্টারা বিএনপির পক্ষ থেকে মনোনীত হবেন তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের উপদেশ দেবেন এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা বাদবাকি মন্ত্রীদের উপদেশ দেবেন। ৩. মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্য এবং উপদেষ্টা নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। ৪. মন্ত্রিপরিষদ কেবল রুটিন ওয়ার্ক চালিয়ে যাবে এবং কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ৫. প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং উপদেষ্টারা যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান তাহলে কেবল যার যার নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রচারাভিযান চালাতে পারবেন এবং অন্য কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাতে পারবেন না। ৬. নির্বাচন কমিশন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার পছন্দে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। যদি তারা একমত হতে না পারেন তাহলে আলোচনায় উঠে আসা নামগুলো বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরণ করতে হবে, যিনি নিজে তার দুজন সিনিয়র বিচারপতিকে সঙ্গে নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের স্থলে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। (নির্বাচন কমিশন পরিবর্তনের পরামর্শটি এ কারণে দেওয়া যে, জনগণ ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে ধারণা আছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজেদের বিতর্কিত করে ফেলেছে। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ৭ থেকে ১৩ ধারা অনুসরণ করলে নির্বাচন কমিশনে পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। এ সময় নির্বাচন কমিশন পরিবর্তনের মানে হলো নির্বাচন বিলম্বিত হওয়া। কারণ নতুন কমিশনের এসে ঠিকঠাক হয়ে সব কিছু হাতে নিতে সময়ের প্রয়োজন।) ৭. সরকারের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষ সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার ওসি এবং রেঞ্জ ডিআইজিদের বদলি করতে পারেন। ৮. নির্বাচন কমিশনের সচিব এবং অন্য ঊধর্্বতন কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করা যেতে পারে। ৯. মহানগর এলাকায় পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, উপ-কমিশনার এবং থানার ওসিদের বদলি করা যেতে পারে। ১০. পুলিশের আইজি এবং র্যাবের মহাপরিচালক এবং র্যাবের পরিচালকরা যার যার সশস্ত্র বাহিনীতে ফিরে যাবেন এবং তাদের পরিবর্তে নতুন কর্মকর্তারা আসবেন। ১১. সব গোয়েন্দাপ্রধানকে বদলি করতে হবে। ১২. ভারতের মতো প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্র এবং বুথে উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি নির্বাচন কমিশন পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে না পারে তাহলে বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ সেনাবাহিনী নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য নিয়োজিত করতে হবে। ১৩. স্পর্শকাতর নির্বাচন কেন্দ্র এবং বুথে সিসি টিভির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এখন এই প্রস্তাব গ্রহণ করা বা না করা আপনাদের ওপর নির্ভর করছে। আমি আন্তরিক সম্মান জানিয়ে শেষ করছি।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।