আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আতঙ্কের ২৩ মাইল

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে গত দেড় মাসে অন্তত ১৫ দিন মহাসড়কের ওই অংশে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। আর এজন্য জামায়াত-শিবির ও বিএনপি কর্মীদের দায়ী করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
পুলিশ বলছে, এসব ঘটনায় চার শতাধিক যানবাহনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে। বেশ কয়েকজন জামায়াতকর্মীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।     
এর মধ্যেই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন হাজারো যাত্রী; পার হচ্ছে মালামাল পরিবহনকারী ট্রাক, বাস, লরি ও কভার্ড ভ্যান।


সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়া বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এনে সীতাকুণ্ডে জড়ো করছে। তারাই পরিকল্পিতভাবে নাশকতা করছে। ”
অবশ্য উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবু তাহের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
চট্টগ্রাম সিটি গেইট থেকে সীতাকুণ্ডের বড় দারোগার হাট পর্যন্ত ২৩ মাইল (৩৭ কিলোমিটার) এলাকজুড়ে এসব ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ ছোট কুমিরা থেকে সদর বটতলের প্রায় আট মাইল এলাকায়।
স্থানীয় সাংবাদিক, এলাকাবাসী, প্রশাসন, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিরোধীজোটের কর্মসূচি থাকলে, হরতাল বা হরতালের আগের দিন, কখনো আবার কোনো কারণ ছাড়াই মহাসড়কে উঠে আসছে নাশকতাকারীরা।


 
সীতাকুণ্ডে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা ভাঙা কাচ ও পোড়া গাড়ি সেই ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ দিচ্ছে। কেবল সীতাকুণ্ড থানার সামনেই জড়ো করে রাখা হয়েছে অন্তত দশটি পোড়া ট্রাক ও বাস।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সীতাকুণ্ড সার্কেলের এএসপি সৈয়দ ইকবাল আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নানাভাবে চেষ্টা করেও মহাসড়কের ওই অংশে যানবাহনে হামলা ঠেকানো যাচ্ছে না।
“কয়েকশ লোক ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকে এবং বাস, ট্রাক-ভাংচুর করে বা আগুন দিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে। পরে আর তাদের বেশিরভাগকেই চিহ্নিত করার উপায় থাকে না।


কোথাও ভাংচুরের খবর পেলে পুলিশ ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক তখনই আবার অন্য এলাকায় ভাংচুর শুরু করছে নাশকতাকারীদের অন্য একটি দল।
এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের তিন দফা টানা হরতালে রাতের বেলায় পাহারায় রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক পার করে দেয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়েছে পুলিশকে।
কারা এসব ঘটাচ্ছে জানতে চাইলে ইকবাল আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারা করছে তা তো আপনারা সবাই জানেন। বিরোধী জোটের কর্মসূচি ঘিরেই মূলত এসব হচ্ছে।


পুলিশ বাড়িয়েও নাশকতা বন্ধ করতে না পেরে গত ১৬ নভেম্বর সীতাকুণ্ড উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসে প্রশাসন। তারপরও দুই দিন মহাসড়কের ওই অংশে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ চলে। এ কারণে দীর্ঘ সময় যানবাহন চালাচল বন্ধ থাকায় পরদিন দেখা দেয় ব্যাপক যানজট।    
সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীন ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ৩৭ কিলোমিটার রাস্তার ১৫টি পয়েন্ট বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব এলাকায় মাহসড়কের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১৬০টি গলি উপগলি আছে।


“এসব গলি থেকে হঠাৎ মহাসড়কে উঠে চোরগোপ্তা হামলা চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে তাদের আর পাচ্ছে না। ”
 
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা থেকে সদরের বটতল এলাকা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কের ১৫টি পয়েন্টে জামায়াত ও বিএনপি কর্মীরা এসব নাশকতা চালাচ্ছে।

এর মধ্যে বাড়বকুণ্ড, ছোট কুমিরা, পন্থিছিলা ও বটতল এলাকায় গত বুধ ও রোববার আগুনে পোড়ানো হয়েছে কমপক্ষে বিশটি যানবাহন, ভাংচুর হয়েছে দুই শতাধিক গাড়ি।
কেবল হামলা-ভাংচুর নয়, হামলাকারীরা যানবাহনের যাত্রীদেরও নানাভাবে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।


এসব ঘটনায় গত এক সপ্তাহে চার দফা বন্দরনগরীর সঙ্গে যোগাযোগের এই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় পুলিশ।
পুলিশ বলছে, দীর্ঘ সময় যান চলাচল বন্ধ থাকায় মঙ্গল থেকে বৃহস্পতি- তিন দিনই মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে ছিল দীর্ঘ যানজট। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যাত্রীরা চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন পাঁচ থেকে দশ ঘণ্টা দেরিতে। ট্রাক, কভার্ড ভ্যান ও লরিতে করে রপ্তানিপণ্য পৌঁছাতেও বিলম্ব হয়েছে।
চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন আহম্মেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত দেড়মাসে দূরপাল্লার কমপক্ষে ২১টি বাস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ভাংচুর করা হয়েছে দুইশর বেশি বাস। মহাসড়কে যানবাহন ও এর চালক বা যাত্রীরা কোনোভাবেই নিরাপদ নন। ”
ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির মহাসচিব আবু মোজ্জাফ্ফর জানান, গত তিন দিনেই সীতাকুণ্‌ড অংশে তাদের একশর বেশি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ভাংচুর হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ত্রিশটির মতো ট্রাক।
এর মধ্যে তার মালিকানাধীন তিনটি ট্রাক রয়েছে জানিয়ে মোজাফ্ফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সমস্যা রাজনীতিতে, আমাদের যানবাহন কেন এভাবে রোষের শিকার হবে?”
 

সীতাকুণ্ড থানার ওসি বদিউজ্জামান বলেন, যানবাহন চলাচল করলেও সীতাকুণ্ডের পরিস্থিতি ‘পুরোপুরি স্বাভাবিক’ বলা যাবে না।


“পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফোর্স বাড়ানো হয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি। ”
বুধবার যানবাহন ভাংচুর ও বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় মোট ১৪ জন শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান ওসি।  
আওয়ামী লীগ নিষ্ক্রিয়?
কেবল যাত্রী বা চালকরা নন, সীতাকুণ্ডের স্থানীয় জনগণও মহাসড়কে এই নাশকতায় উদ্বিগ্ন।

তাদের মতে, প্রশাসনের ব্যর্থতা আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব ও সাংগঠনিক নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিচ্ছে জামায়াত-বিএনপি।
স্থানীয় সাংসদ আবুল কাশেম মাস্টার, উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল বাকের ভূইয়া ও পৌর চেয়ারম্যান শফিউল আলম ওরফে নায়েক শফি আওয়ামী লীগের নেতা হলেও দলের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে জামায়াতি তাণ্ডবের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
সর্বশেষ গত শনিবার সাংসদের নেতৃত্বে ‘নৈরাজ্যের প্রতিবাদে’ মোটর সাইকেল মিছিল হলেও এর তিন দিনের মাথায় বুধবার দুপুরে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদাকাত উল্লাহসহ আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসাবে পরিচিত পাঁচটি পরিবারের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা।
এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি দেয়া হয়নি।
স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার লোকজন ও দলীয় কর্মীদের সঙ্গে সীতাকুণ্ডের সাংসদ আবুল কাশেম মাস্টারের সম্পৃক্ততা কমে গেছে।


এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সাংসদ আবুল কাশেম মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব নিয়ে মুখ খুলতে চাননি স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো শীর্ষ নেতাও।  
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান বাকের ভূইয়া বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন জোরালো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ উদ্যোগ আরো আগে নিলে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত না।
 


তিনি বলেন, “বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে দেশের অন্যান্য স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই জামায়াত এই পথ বেছে নিয়েছে।


অবরোধ-ভাংচুরের কিছু ঘটনায় যে জামায়াত-শিবির জড়িত ছিল, সীতাকুণ্ড উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবু তাহেরও তা স্বীকার করেছেন। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য তিনি দায়ী করেছেন একটি স্বার্থান্বেষী মহলকে।
এই জামায়াত নেতা বলেন, “আমাদের কর্মীদের ওপর নির্যাতন হামলার পর কোনো কোনো স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনা হয়তো হতে পারে। তবে এটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ধারাবাহিক যে সেহিংসতা- তার সঙ্গে আমরা যুক্ত নই।

এটা আমরা আগে থেকেই বলে আসছি। ”
তাহেরের অভিযোগ, “একটি স্বার্থান্বেষী মহল লুটপাট ও নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য এসব নাশকতা ঘটাচ্ছে। ”

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।