আজ ২৬ নভেম্বর। ফরিদপুরের কৃতী সন্তান তথা মুসলমানদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী। ইউসুফ আলী চৌধুরীর জন্ম ১৯০৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর। তার পিতা ছিলেন ফরিদপুরের অন্যতম জমিদার খান সাহেব ময়েজউদ্দিন বিশ্বাস। জমিদার খান সাহেব ময়েজউদ্দিন বিশ্বাসের বাসগৃহ ময়েজ মঞ্জিলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম ইউসুফ আলী চৌধুরীর।
জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তার কাজ তাকে জনগণের কাছে করে তুলছে আত্দার মানুষ। এ কারণে আজো ফরিদপুরের সাধারণ শ্রমিক, রিকশাচালক, থানার দারোগা, সরকারি অফিসের ক্লার্ক, বড় কর্তা, রাজনীতিবিদ, কলেজের ছাত্র, বয়সের ভারে নতজানু বৃদ্ধ, স্কুলের শিক্ষক, বাজারের দোকানদার, ফেরিঘাটের কুলি সবার কাছে এখনো বেঁচে আছেন মরহুম ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া নামে। তাকে গণমানুষের হৃদয়ের গভীরে এমনভাবে স্থান দিয়েছে, ভালোবাসার ডাক মোহন মিয়ার কাছে ছাপিয়ে গেছে তার পৈতৃক পরিচিতি ইউসুফ আলী চৌধুরী। জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ইউসুফ আলী চৌধুরী ছিলেন সাধারণ মানুষের বুকের অনেক কাছাকাছি।
স্থানীয় সরোজিনী এম ই স্কুলে মোহন মিয়ার হাতেখড়ি।
সে সময় সমগ্র দেশের মতো ফরিদপুরের অবস্থাও ছিল অত্যন্ত করুণ। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন মুসলমানদের প্রবেশাধিকার ছিল না। যেসব স্কুলে মুসলমান ছেলেরা প্রবেশাধিকার পেত সেসব স্কুলেও তাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হতো তা অত্যন্ত দুঃখজনক। একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। মুসলমান ছেলেদের পানি পান করার জন্য স্কুলে সাধারণ ছাত্রদের গ্লাস দেওয়া হতো না।
দফতরি উপর থেকে পানি ঢেলে দিত আর নিচে অঞ্জলি ভরে পানি পান করতে হতো মুসলমান ছাত্রদের। এই ছিল তৎকালীন মুসলমান ছাত্রদের অবস্থা। ১৯২৩ ইংরেজি সাল। বাংলা ১৩২৯ সাল। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মোহন মিয়ার পিতা মৃত্যুবরণ করেন।
ফলে লেখাপড়ার ইতি টেনে তাকে ধরতে হয় জমিদারির হাল। এমনি এক ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে মোহন মিয়ার। কিন্তু যিনি জানতে চান সমগ্র বিশ্বকে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দেশ, মাটি, মানুষকে যিনি জানতে চান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার জানার আগ্রহকে কখনোই বন্ধ করতে পারে না। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দুয়ার বন্ধ হলেও তিনি বিচরণ করেছেন শিক্ষার সাগরে।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর কারণে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে মোহন মিয়াকে জমিদারির হাল ধরতে হয়। এ সময়ে তিনি মরহুম আবুল কাশেম ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য পদে প্রার্থীরূপে সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেন এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। এর মধ্য দিয়েই মোহন মিয়া প্রকাশ্য রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ইচ্ছা করলেই মোহন মিয়া তৎকালীন মন্ত্রী হতে পারতেন।
কিন্তু তা হননি। এ কারণেই তাকে 'কিং মেকার' বলা হয়ে থাকে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সময় তিনি মন্ত্রী হন। কিন্তু বেশি দিন মন্ত্রিত্ব করেননি। জীবনের বেশ ক'বছর তিনি তার জন্মভূমি ফরিদপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দক্ষতার সঙ্গে কার্য পরিচালনা করেন।
পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন মোহন মিয়া। অবিভক্ত বাংলাজুড়ে তিনি তখন কাজ করেছেন। মোহন মিয়ার কাজে মুগ্ধ হয়ে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আকরম খাঁ বলেছিলেন, 'যদি আটাশটি জেলায় আমি আটাশটি মোহন মিয়া পেতাম তবে অনেক আগেই আমি এ বাংলা জয় করে ফেলতে পারতাম। ' মোহন মিয়ার বাড়ি ময়েজ মঞ্জিলে প্রাদেশিক লীগের ওয়ার্কর্িং কমিটির মিটিং হয়েছে। যা সচরাচর কলকাতায় হতো।
তৎকালীন রাজনীতির বহু নামিদামি ব্যক্তিত্ব মোহন মিয়ার ময়েজ মঞ্জিলে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান, মিরাটের বিখ্যাত জমিদার নওয়াব মোহাম্মদ ইছমাইল খান, ঢাকার নওয়াব মরহুম বাহাদুর খান হাবিবুল্লাহ, ভারতের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক ডা. এমএ আনসারী, দিলি্লর বিখ্যাত আলেম মরহুম মওলানা আহমদ সাঈদ, স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারের সময় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের সভাপতি মাওলানা আহমদ সাঈদ প্রমুখ। মোহন মিয়া ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন ধার্মিক ব্যক্তি। পবিত্র আল্লাহতালার ওপর ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। শান্তির ধর্ম ইসলামে প্রকৃত বিশ্বাসী ছিলেন বলেই মোহন মিয়া ছিলেন অসাম্প্রদায়িক।
ফরিদপুরবাসী আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে ফরিদপুরের কৃতী সন্তান মোহন মিয়াকে। এ কে এম আবদুর রাজ্জাক মোহন মিয়া প্রসঙ্গে লিখেছেন, মোহন মিয়ার ঐকান্তিক চেষ্টা ও যত্নের ফলে ফরিদপুরে কোনো দিন কোনো সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোল বা দাঙ্গা হয়নি। কখনো কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা দেখা দিলে মোহন মিয়া নিজস্ব চিন্তা আর ব্যক্তিত্বের প্রভাব দ্বারা সূচনাতেই তা বন্ধ করতেন। এ কারণে মোহন মিয়া ফরিদপুরের সব সম্প্রদায়ের কাছে হয়ে ওঠেন কাছের মানুষ। ফরিদপুরের এক জমিদার কর্তৃক একটি দরিদ্র প্রজার দাড়ি উপড়ে ফেলার ঘটনা নিয়ে মামলা হলে মোহন মিয়া জমিদার হয়েও সেদিন জমিদারের বিরুদ্ধে সে প্রজার পক্ষ নিয়ে লড়েছিলেন।
এখানেই মোহন মিয়ার অসাধারণত্ব। মোহন মিয়া নিজে ছিলেন জমিদার। অথচ মুসলিম লীগ সরকারের সময় যখন কুখ্যাত জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রস্তাব বাংলার আইন সভায় তোলা হয়েছিল, তখন মোহন মিয়া সর্বপ্রথম নিজে জমিদার হয়েও এই প্রস্তাবকে জোরালোভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। এ দেখে অন্যান্য জমিদার সদস্য অবাক হয়েছিলেন। আইন সভায় তিনি বলেছিলেন, 'ংড়ড়হবৎ ঞঐওঝ ইখঙঙউণ ঝণঝঞঊগ ঙেঊঝ ঞঐঊ ইঊঞঞঊজ' জমিদার হয়েও জমিদারি প্রথার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে মোহন মিয়া হাজার হাজার কৃষক প্রজার হৃদয়ে আসন করে নিয়েছিলেন।
মোহন মিয়া আজীবন কাজ করেছেন শিক্ষার আলোকবর্তিকা দেশের ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য। এ সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'হালিমা স্টুডেন্টস হোম'। হালিমা স্টুডেন্ট হোমে তিনি দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের থাকার ও খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। হালিমা স্টুডেন্টস হোমের দীর্ঘদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন অ্যাডভোকেট কাজী খলিলুর রহমান। হামিলা স্টুডেন্টস হোম প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, মোহন মিয়া হালিমা স্টুডেন্টস হোম তৈরি করেছিলেন দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের জন্য।
এই হোমে থাকার সুযোগপ্রাপ্ত বহু ছাত্র এখন দেশে-বিদেশে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছে। এ সুযোগ না পেলে হয়তো এদের অনেকেরই জীবন আজ অন্য খাতে প্রবাহিত হতো। জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ফরিদপুর জেলায় তিনি প্রচুর জনহিতকর কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাস্তাঘাট, দাতব্য চিকিৎসালয়, মক্তব, মাদ্রাসা। এছাড়াও তিনি ময়েজউদ্দিন হাই মাদ্রাসা, হামিলা স্টুডেন্টস হোম, হালিমা গার্লস স্কুল স্থাপন করেছেন।
মোহন মিয়া রেডক্রস সোসাইটি ও সমবায় আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি মুসলিম লীগ রিলিফ কমিটির মাধ্যমে গরিব ও দুস্থ অসহায় লোকদের সেবা করেছেন। তিনি আগুনে পোড়া ও নদী ভাঙনের দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের পুনর্বাসিত করার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।