আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুর সঙ্গে ৩০ ঘণ্টার লড়াই

মোজাম্মেল (১৯) চলে গেলেন। অন্ধ মায়ের কষ্ট দূর করা সম্ভব হলো না। বড় ভাই সোহেলের জন্য আনতে পারল না পরীর মতো একটা ভাবী। একমাত্র উপার্জনক্ষম মোজাম্মেলকে হারিয়ে পরিবারের ভবিষ্যৎই এখন ঘোর অন্ধকারে। অবরোধের আগের দিনও নন্দীপাড়ার বাসায় ভাইয়ের সঙ্গে জেদ ধরেছিল মোজাম্মেল। দুপুরে ভাত খেতে খেতে বড় ভাই সোহেলকে খুনসুটি করে বলেছিল একটা পরীর মতো সুন্দর ভাবী আনবে। ভাবী আর মাকে নিয়ে ছোট বাসা ছেড়ে উঠবে বড় বাসায়। ছোট বেলায় বাবা হারিয়েছেন। দুই ফুফুর স্নেহ মায়ায় বড় হয়েছেন। অন্ধ মায়ের কষ্ট ঘুচিয়ে দুই ভাই মিলে করবেন নতুন ব্যবসা। কিন্তু পূরণ হলো না মোজ্জাম্মেলের সেই স্বপ্ন। আনা হলো না বড় ভাইয়ের জন্য পরীর মতো বউ। ঘুছলো না অন্ধ মায়ের কষ্ট। ৩০ ঘণ্টা মৃত্যু যন্ত্রণার পর অবশেষে লেগুনা চালক মোজাম্মেলের স্থান হলো ঢাকা মেডিকেলের মর্গে অগি্নদগ্ধ লাশের সারিতে। সেই সঙ্গে বাড়ল একটি লাশের সংখ্যা। দীর্ঘ হলো লাশের মিছিল। সারা শরীরে আগুনে পোড়া দগদগে ক্ষত নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে চিরদিনের জন্যে। গত বুধবারও ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে বাঁচার আকুতি নিয়ে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে বলছিল 'ও ভাই... ভাইরে... আমার জ্বালা ঠাণ্ডা কইরা দে। ডাক্তাররে ডাক। আমি আর পারছি না ভাই। ও ভাই আমি আর বাঁচমু না, আমারে মাফ কইরা দিস'। অতঃপর গভীর রাতে মৃত্যু এসে মুক্ত করে দিল অমানবিক যন্ত্রণা থেকে। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে বিলাপ করতে করতে তার বড় ভাই সোহেল বলছিলেন কথা গুলো। আর অন্ধ মা মৃত ছেলের শিয়রে বসে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। দুই ফুফুর বুক ফাটা কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছিল মেডিকেলের পরিবেশ। কে কাকে দেবেন সান্ত্বনা। তাই চিকিৎসকরাও সমব্যথি হয়েছেন তাদের কাছে। গত মঙ্গলবার অবরোধের প্রথম দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীতে গাড়ি ভাঙচুর করে তার গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সে সময় তারা দরজা আটকে রাখায় লেগুনা থেকে বের হতে পারেননি মোজাম্মেল। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে নেওয়া হয় তাকে। বুধবার মধ্যরাতে মারা যায় সে। ভাইয়ের এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না বড় ভাই সোহেল হোসেন। শরীরের ৬০ ভাগের পাশাপাশি শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তাকে বাঁচানো যায়নি বলে জানালেন চিকিৎসক। এর আগের দিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছেন আনোয়ারা বেগম (৫০)। মায়ের মৃত্যুর খবর বিশ্বাসই করতে পারছেন না মেয়ে নাসিমা বেগম। রক্তে ভেসে গেছে মাথা। রাস্তায় পড়ে ছটফট করছিলেন। আর আশপাশে জটলা পাকিয়ে তা দেখছিলেন বহু মানুষ। কিন্তু এগিয়ে আসেননি কেউই। বুধবার ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের হরতাল আর অবরোধের আগুনে মোজ্জাম্মেলকেও যেতে হলো সেই মৃত্যুর মিছিলে। আগুনে পোড়া অন্যরাও দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। বার্ন ইউনিটে মানুষ পচাগন্ধ। অগি্নদগ্ধদের স্বজনদের চোখেমুখে কাজ করছে এক অজানা আতঙ্ক। বার্ন ইউনিটের দুই তলায় একটি কক্ষে দগ্ধ সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক সাবেদ আলী শুয়ে আছেন। পাশে ঘুমহীন ঢুলোঢুলো চোখে ঝিমুচ্ছেন স্ত্রী আলেয়া খাতুন। গত মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ইস্টার্ন প্লাজার সামনে তার অটোরিকশায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সাবেদ বলেন, 'বসলেও ব্যথা, শুইলেও ব্যথা। শরীরের চামড়া যেন কে টাইনা ছিঁড়া ফালাইতাছে। একটু পরপর জ্বালাপোড়া করে। কী অপরাধ করছিলাম, ভাই? গত সোমবার সন্ধ্যায় কুমিল্লায় সিএনজিতে দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় রুবেলের শরীর। কুমিল্লায় বাসায় তিন সন্তানকে রেখে স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন রুবেলের স্ত্রী আলেয়া। তার শরীরের খোঁজখবর নিলেন নির্বাচনকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। এর পরপরই রুবেলকে নিয়ে চিকিৎসকদের তৎপরতা ও সেবা বেড়ে যায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর সাহা বলেন, আগেকার সময়ে হরতাল অবরোধ হলে হাত পা ভাঙত। নয়তো মাথা ফাটত। এখন আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। এটা এক ধরনের রীতি হয়ে গেছে। হরতাল অবরোধ হলেই এই ধরনের রোগী আসে বেশি। তিনি বলেন, বার্ন ইউনিটে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে সবাই শঙ্কামুক্ত নয়। এসব রোগী যে কোনো সময় খারাপের দিকেও টার্ন নিতে পারে। দায়িত্বরত সেবিকারা জানান, হরতাল আর অবরোধের আগুনে বার্ন ইউনিটে ৭০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। মোজাম্মেলসহ ৭ জন মারা গেছেন। তার মধ্যে শুধু আগুনে পোড়া ৫ জন। বাকি দুজন বোমায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.