1
১
মাটি থেকে একটু উপরে আমি বসে থাকি, আন্দাজে প্রায় দেড় হাত উচ্চতা। মাঝখানে আম কাঠের বেঞ্চিটা ক্রমাগত কোঁতাতে থাকে, ভারবহনে অনিচ্ছুক গর্দভের মত পিছলে যেতে চায়।
মোফাজ্জল অসহিষ্ণুভাবে চায়ের কাপে চামচ হাঁকাতে থাকে। চিনির মত নিম্ন গলনাংকের একটি বস্তুর জন্য এতোটা বল প্রয়োগের প্রয়োজন হয়না।
আমি সস্তা সিগারেটে টান দিতে দিতে মোফাজ্জলের দিকে তাকাই।
চওড়া কব্জি, গায়ের কালো রঙ দেখলে মহিষের কথা মনে পড়ে যায়। কদিন আগে পাশের দোকানের কম বয়সী ছেলেটির সাথে মোফাজ্জলের ভীষণ ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল।
ঘাড় ত্যাড়া ছোকরাটা এক পর্যায়ে ফোন করে বেশ কজন স্যাঙাতকে ডেকে এনেছিল।
অকুতোভয় মোফাজ্জল ছ-সাতজনের গোটা দলটিকেই একেবারে পথের ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। ছোকরার দল বোধহয় পকেটে করে মেশিন টেশিন এনেছিল।
তা সেসব যন্ত্রপাতি শেষমেশ পকেটেই থেকে গেছে, বের হবার সুযোগ পায়নি।
সেদিন ও আমি পুরো ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখেছিলাম এখানটায়, এই বেঞ্চিটার উপর বসে। তবে মোফাজ্জলের বীরত্বের চেয়েও যে জিনিষটি আমাকে বেশি মুগ্ধ করেছিল- সেটি হচ্ছে ওর লুঙ্গি সামলানোর দক্ষতা।
পনর মিনিটের সেই ম্যাজিক স্পেলে মোফাজ্জলকে বিস্তর হাত পা ছুঁড়তে হয়েছে, ফ্লাইং কিকও মেরেছে বোধহয় গোটা দশেক। শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিটি মুহূর্ত।
প্রতিবারই আমার মনে হচ্ছিল- এই বুঝি লুঙ্গি জড়িয়ে গেল পায়ে!
কিন্তু শেষমেশ এমন কিছুই হলনা। শেষ ফ্লাইং কিকটা মেরে মোফাজ্জল ডেভিড কপারফিল্ডের মত করে মাটিতে নেমে আসতেই লুঙ্গিটা একেবারে দুর্যোগ পরবর্তী নদীতীরের মতোই নিপাট, শান্ত।
চায়ের কাপে চামচের শব্দটা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। বিকেলের এই সময়টাতেই বলতে গেলে যা বেচাবিক্রি। আমার আশেপাশে বেশ কজন ইতিমধ্যেই চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে গেছেন।
কেউ কেউ নিশ্বাস ফেলছে ঠিক আমার ঘাড়ের উপর।
চা বানানো আপাতত শেষ। মোফাজ্জল উদাস ভঙ্গিতে রাস্তার ওপাশের ছোট মাঠটির দিকে তাকিয়ে থাকে, ঘাড়ের ভঙ্গিটি শক্ত।
ছ-সাতজন উঠতি বয়সী তরুণকে পথের ধুলোয় মিশিয়ে এই বলশালী পুরুষটি এই মুহূর্তে আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা। আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সামর্থ্য এই লোকটির নেই।
মোফাজ্জলের তুলনায় আমার লড়াইটি আরো কঠিন। মোফাজ্জলকে যুঝতে হয় পেটের খোরাকের জন্য। এর সাথে শখের কিংবা গোপন দুই একটা বায়নাক্কা মেটাতে পারলেই সে মহাখুশি।
মোফাজ্জলের তুলনায় আমার রোজগার খুব বেশি নয়। তবে পেটের খিধের পাশাপাশি আমাকে আমার ‘ভদ্রলোক’ স্ট্যাটাসটি নিয়েও বিস্তর মাথা ঘামাতে হয়।
- দেখি মোফাজ্জল, আরেকটা চা দাওতো!
মোফাজ্জল বিরসমুখে চা বানায়। চামচ হাঁকানোর ভঙ্গিটি এমুহূর্তে কিছুটা ভদ্রোচিত।
মোফাজ্জল চায়ের কাপটি আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়, দৃষ্টি অন্যদিকে। অপ্রকাশ্য কূটযুদ্ধে আমার গোপন কৌশল মূলত এটাই।
এভাবেই আমরা যুগে যুগে মোফাজ্জলদের দাস করে রেখেছি।
পৃথিবীতে সবসময় খেটে খাওয়া মানুষদের সংখ্যাই বেশি ছিল। সে তুলনায় হাতে গোনা কজন মানুষ এ বিপুল সংখ্যক মানুষকে দাস হিসেবে খাটিয়ে নিয়েছে, নিচ্ছে ...
খেটে খাওয়া মানুষদের উপর দখল নিতে শাসকরা বরাবরই যে জিনিসটার মোক্ষম ব্যবহার করে গেছে, সেটি কিন্তু চাবুক নয় বরং তাদের মস্তিষ্ক। আর সেদিনই গনঅভ্যুথান ঘটবে- যেদিন মোফাজ্জলদের পায়ের অদৃশ্য শৃঙ্খল কেটে যাবে, যেদিন মোফাজ্জলরা বুঝে যাবে অন্তরালে আমরাও ওদের ভয় পাই।
পরপর দুকাপ হয়ে গেল। বুকটা বেশ জলছে।
সামনের ক্ষুদ্র মাঠটায় একদঙ্গল ছেলেপেলে ফুটবল খেলছে। খেলছে, কাঁদা ছিটাচ্ছে... ছিটের ভয়ে পথচারীরা ভয়ে ভয়ে পথটা পাড়ি দিচ্ছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে অনুভব করি মোফাজ্জল আড় চোখে আমাকে দেখছে। আমি মনে মনে খুশি হই।
- দাও দেখি মোফাজ্জল, একটা নোনতা বিস্কুট।
২
গাঁজা টানলে নাকি সাস্থ্য ভালো হয়, মনঃসংযোগ বাড়ে। বুয়েটের অনেক ভালো ভালো ছাত্র নাকি গাঁজা খেয়ে পরিক্ষা হলে ঢোকে।
কথাটা বলেছিল আমার বন্ধু তবারক। সত্যতা যাচাই হয়নি, বুয়েটে পড়ে এমন কাউকে আমি চিনিনা। বিদঘুটে এই গাঁজা তত্ত্বের প্রবক্তা তবারক নিজেও ইন্টার পাশ করতে পারেনি।
গাঁজা তত্ত্ব সত্য কি মিথ্যা- জানিনা। তবে গাঁজা খেয়ে আমি কাউকে গাড়ি ঘোড়ায় চড়তে দেখিনি। গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে কেউ হয়তো শখ করে দুই একটা টান দেন।
এ পর্যন্ত আমি যতজন গাঁজাসক্ত দেখেছি- তাদের প্রায় সবার চেহারাই আমার মত- অর্ধনিমীলিত চোখ, অমসৃণ ত্বক আর দগদগে কালো ঠোঁট। বাবলুদা তো গেল সপ্তাহে মুখের উপর বলেই দিলেন-
- কি মিয়াঁ! কি হইসে তোমার! এসব কি বালের রিপোর্ট লেখ! গাঁজা-টাজা খাও নাতো আজকাল!
বলাবাহুল্য, ভদ্রলোকের স্ট্যাটাস ধরে রাখার জন্য আমার যে প্রানপন সংগ্রাম- তার সাথে গাঁজা সেবনের বিষয়টি একদমই যায়না।
ছবির হাটে প্রায়ই দুএকজন পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায়। প্রথম প্রথম ওরা ব্যাপক উল্লাসে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। কিন্তু ক্রমশ ব্যাপারটি বিব্রতকর হতে থাকে, উল্লাস ফিকে হয়ে যায়। ছুটিছাটা- অবসরে ওরা যতবারই এখানটায় এসেছে, প্রতিবারই মোফাজ্জলের এই ভাঙ্গাচোরা বেঞ্চিটার উপরে আমাকে ল্যাপ্টা মেরে বসে থাকতে দেখেছে।
আমার নিরলস ধারাবাহিকতা আর বসার ভঙ্গী দেখে ওরা বাকি ব্যাপারটি অনুমান করে নেয়।
এরপর থেকে দেখা হলে, ওদের আড় বিব্রত করিনা, আমি নিজে থেকে চোখ সরিয়ে নিই, অন্যমনস্কতার ভান করি।
কিশোর দলটি ফুটবল খেলার প্রথাগত সব নিয়মকানুন ভেঙ্গেচুরে ফেলেছে। পায়ের চপ্পল দিয়ে গোলবারের চিহ্ন আকা হয়েছিল। উন্মাদনা আর উল্লাসের আতিশয্যে সাময়িক সেই গোলবারের প্রমান সাইজটি কমবেশি হয়ে গেল।
কিশোরদলের সবচেয়ে লম্বা আড় স্বাস্থ্যবান ছেলেটিরই উল্লাস সবচেয়ে বেশি।
গোল করার আর বালাই নেই। নির্বোধ চেহারার বুলিটি দৌড়ে দৌড়ে অপেক্ষাকৃত নিরীহ আড় দুর্বল চেহারার কিশোরগুলোর নরম ঘাড় চেপে ধরে, মহাউল্লাসে পানিতে নাকানি চুবানি খাইয়ে দেয়।
মার খেয়ে ভদ্রচেহারার কিশোরটি কাঁদো কাঁদো মুখ করে উঠে দাড়ায় তারপর গোলবারটিকে অসম্পূর্ণ করে দিয়ে তার স্যান্ডেলজোড়া নিয়ে চলে যায়। কাঁদামাটি মাখা অপর স্যান্ডেলজোড়াটি গুম-খুন হওয়া যুবকের মত আকাশের দিকে চিত হয়ে পড়ে থাকে। জয়ের উল্লাসে নির্বোধ বুলিটি চিৎকার করে ওঠে, সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারে সামনে পড়ে থাকা বলটির গায়ে।
সেই বল গিয়ে লাগলো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক যুবকের গায়ে। কিশোর দলটি মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেছে। প্রমত্ত সেই দলনেতা বুলিটিও এই মুহূর্তে আশ্রয় নিয়েছে তালগাছের আড়ালে।
ধবধবে শাদা শার্টে গোলাকার বলটি অর্ধেক ছাপ রেখে গেছে। হতভম্ব যুবক বিস্ময় নিয়ে এদিক ওদিক তাকায়।
পাশে দাঁড়ানো তার কিশোরী প্রেমিকাটিই সবার আগে নিজেকে সামলে নিল, টেনে টেনে সে অনিচ্ছুক যুবককে সামনে নিয়ে যায়।
অতপর উল্লাসের ভাবটি স্তিমিত হয়, জেগে ওঠে অপরাধবোধের অনুভুতি। কাকভেজা কিশোরেরা ইতিউতি আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। দলনেতা বুলিটিকে আড় দেখা যায়না, বোধহয় পালিয়েছে। কিন্তু বলের মালিক চশমাপরা কিশোরটি পালায়নি, অত সাধের বলটি ফেলে কি করেই বা পালায়!
- আঙ্কেল, বলটা দেননা, প্লিজ!
তাকিয়ে দেখি কিশোরটি আমার দিকেই চেয়ে আছে।
আমার পেছনের জটলাটি কিছুটা নড়ে ওঠে, তাকিয়ে দেখি মোফাজ্জলও আবার আড়চোখে দেখা শুরু করেছে। বলটি ততোক্ষণে সুবোধ বালকের মত স্থির হয়ে গেছে ঠিক পথের মাঝখানটায়।
- আঙ্কেল বলটা দেননা!
আমি এতটুকুও না নড়ে বসে রইলাম বেঞ্চিটার উপর পাথুরে মূর্তির মত। সন্ধ্যা হতে এখনো ঢের বাকি, কাঁদাতে সবকিছু খিতখিত করছে। বেঞ্চির দখল আমি কোনভাবেই ছাড়তে পারিনা।
পিঠে অর্ধেক চাঁদের ছোপ নিয়ে সুদর্শন যুবকটি কাছেই দাড়িয়ে ছিল। চশমা পড়া কিশোরটি তবুও ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে, ঝট করে বলটি উঠিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়।
আর আমি! আম বসে রইলাম সেখানটাতেই। মাটি হতে দেড় হাত উপরে, বুদ্ধের মত নিরাসক্ত ভঙ্গিতে।
মাঝখানের পথটি যেন নির্দেশ করছে আবহমান সময়কে, নদীর মত যা অবিরত বয়ে যায়।
ওপাড়েতে ছোট মাঠটি যেন আমার শৈশব, বহুকাল আগে জাকে পেছনে ফেলে এসেছি।
আর কে না জানে- একবার চলে গেলে, শৈশব আর ফেরেনা... একবার চলে আসলে, সেখানে আর ফেরা যায়না ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।