নির্বাচন হচ্ছে, অথচ ভোটাররা ভোট দিতে যাচ্ছেন না- এমন নজিরবিহীন ঘটনার মধ্য দিয়ে গতকাল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। দেশের যেসব এলাকায় নির্বাচন হয়েছে তার অধিকাংশ কেন্দ্রেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। সকাল থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই ফাঁকা দেখা গেছে। বসে বসে অলস সময় কাটিয়েছেন প্রিসাইডিং অফিসার, দায়িত্বরত কর্মকর্তাসহ নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তত ১০টি কারণে ভোট দিতে যাননি ভোটাররা।
কারণগুলো হচ্ছে : ভোটারদের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক, সহিংসতার আশঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা, বিরোধী দল ছাড়া একতরফা নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহের অভাব, প্রচার-প্রচারণার অভাব, ভোটার আকৃষ্টকরণে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগের অভাব, বাসাবাড়িতে ভোট নম্বর সরবরাহ না করা, বিরোধী দলের বাধা, যোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভাব এবং বেশির ভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ায় নিজের ভোটকে প্রয়োজনীয় মনে না করা।
নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী দলের টানা হরতাল-অবরোধে ভোটারদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল চাপা আতঙ্ক। নির্বাচনের আগের দিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভোটকেন্দ্রে আগুন, ব্যালট পেপার ছিনতাই, প্রিসাইডিং অফিসারকে পিটিয়ে হত্যা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হওয়ায় ওই আতঙ্ক ভোটের দিন ভয়াবহ রূপ নেয়। ভোট দেওয়া তো দূরের কথা সহিংসতার আশঙ্কায় অনেকে ভোটকেন্দ্রের আশপাশেই ভিড়েনি। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার পেছনে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিও কাজ করেছে। নিরাপত্তার অভাবে মহিলা ভোটাররা বাসা থেকেই বের হননি, যারা দেশের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। সংখ্যালঘু বলে পরিচিত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ভোটাররাও নিরাপত্তার অভাবে এবার ভোট দিতে যাননি। দেশের মোট ভোটের তারাও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তাদের ভয় ছিল ভোট দিতে গেলে তাদের পরিবারের ওপর হামলা হতে পারে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার পেছনে অন্য দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের বিষয়টিও প্রভাব ফেলেছে। বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচন ভোটারদের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। দেশের মোট ভোটারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অংশ হয়ে নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে আছে কি নেই সেটি নিয়েও ছিল বিভ্রান্তি। শুধু আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন ভোটারদের মধ্যে আলাদা কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। কোনো কোনো এলাকায় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার কোথাও কোথাও নামসর্বস্ব দলের প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, যাদের সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে কোনো আগ্রহই ছিল না। এদিকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া এবং ভোট না দেওয়ার ব্যাপারে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ভোটারদের মধ্যে যে পরিমাণ প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষ থেকে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। অনেক এলাকায় নিরাপত্তার অভাবে খোদ প্রার্থীদেরই মাঠে দেখা যায়নি। জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি নিরাপত্তার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ব্যাপক উদ্যোগের কথা রেডিও-টিভিতে সম্প্রচার করা হলেও এবার সেরকম কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ফলে ভোটাররা ভোট দেওয়ার ব্যাপারে কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারেননি।
অন্যান্য নির্বাচনের আগেভাগেই প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ভোটার নম্বর পেঁৗছে দেওয়া হয়। ভোটারদের কেন্দ্রে আনা-নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় প্রার্থীদের পক্ষ থেকে। এবার এসব কিছুই ছিল না। বেশির ভাগ প্রার্থী নামরক্ষার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া এবারের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যাও ছিল কম। এবারের নির্বাচনে নতুন নতুন ভোটকেন্দ্র করায় রাজধানীসহ শহর ও পৌর এলাকায় নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অনেকে জানতে পারেননি তাদের ভোটকেন্দ্রটি কোথায়, তিনি কোথায় ভোট দিতে যাবেন। উপরন্তু দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনেকে ভোট দিতে যাননি বিরোধী দলের বাধার মুখে। এ ছাড়া ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের না যাওয়ার পেছনে যোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভাব, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যেই প্রার্থী সীমাবদ্ধ থাকা এবং বেশির ভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার বিষয়গুলোও প্রভাব ফেলেছে। মিরপুর-১৬ আসনের ভোটার রূপনগর এলাকার সাইদুল আলম বলেন, সবচেয়ে বড় কথা, এ নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোটকে প্রয়োজনীয় মনে করতে পারেননি। ভোট দেওয়ার আগেই তারা জেনে গেছেন সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রার্থী বিজয়ী হয়ে গেছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এ অবস্থায় তাদের ভোট সরকার গঠনে কোনো ভূমিকা রাখবে না। এ প্রতিবেদককে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন অপ্রয়োজনের নির্বাচনে কে যাবেন ভোট দিতে?
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।