আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে হবে ২৪ জানুয়ারির আগেই

অবশেষে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে 'কলঙ্কিত নির্বাচন'। সরকার পক্ষ বলছে এটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নির্বাচন। কারণ ২৪ জানুয়ারি পার হয়ে গেলে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। মনে হয় সরকারের পাঁচ বছরে এই প্রথম ২৪ জানুয়ারি আসছে। এরা ক্ষমতায় থাকতে আরও চারটি জানুয়ারি মাস পার হয়ে গেছে তখন এ কথা মাথায় আসেনি।

ধরে নিলাম ক্ষমতা পাওয়ার হানিমুন করতে করতে চার বছর কখন পেরিয়ে গেছে তারা টেরই পায়নি। কিন্তু চতুর্থ জানুয়ারিতে তো মনে পড়তে পারত। তা হলে আর এই কলঙ্কিত নির্বাচন আমাদের দেখতে হতো না।

৫ জানুয়ারি আমি সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ঘর থেকেই বের হয়নি। আমার বাসায় যারা কাজ করে, যারা গাড়ির ড্রাইভার, আমার হাউজিং কমপ্লেঙ্ েযারা থাকেন তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।

আমি থাকি গুলশান এলাকায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এখান থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলেও এখানে নাকি দুজন প্রার্থী ছিলেন। আমি আমার হাউজিংয়ের বসবাস ও কর্মরত লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানকার ভোটের খবর কি? তারা ইতি-উতি তাকিয়ে বলল কই ভোট স্যার, কিছুই তো দেখি নাই। রানা হাবীব এবং আশরাফ কায়সার ফেসবুকে একটি পোস্টিং দিয়েছেন, আমার যে কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার কথা বনানী হাইস্কুল, সেখানে গিয়েছিলেন তারা। চেয়ার-টেবিল নিয়ে অনেকক্ষণ বসেছিলেন, সেই ছবিও তুলেছেন তারা।

তিন চার ঘণ্টা বসেছিলেন। তারা আশপাশের দুয়েকটা কেন্দ্রেও গেছেন। এই তিন-চার ঘণ্টায় ভোটার উপস্থিতি হয়েছিল মাত্র তিন-চারজন।

সবাই যা করেন, আমি প্রায় সারা দিন টেলিভিশনের সামনে বসেছিলাম। চ্যানেল ২৪-এর ভোটের কভারেজ দেখলাম।

'৭১-এর টাও দেখলাম। ঢাকা শহরের ভোটের কেন্দ্রগুলোতে ভোটার কই? আওয়ামী লীগের যারা কর্মী তারা কই? তারাও তো কষ্ট করে ভোট দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। তাহলে কোনো কোনো আসনে যে লাখ লাখ ভোট পেয়েছে তার খবর যে পেলাম সেগুলো কি? গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, চট্টগ্রামের ভোট কেন্দ্রগুলোতে টেলিভিশনে দেখালো না কেন, যেখানে দিনভর হাজারো মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পত্রিকাগুলো লিখেছে, জাল ভোটের চর্চা ছিল ভোটের দিন। মাইটিভি দেখিয়েছে কীভাবে মহিলারা হাতের আঙ্গুলে অনেপনীয় কালির দাগ নিয়েও বারবার ভোট দিচ্ছেন।

তারপরও কেন্দ্র দখল হয়েছে, ব্যালটও ছিনতাই হয়েছে। এ নির্বাচনেও প্রার্থী সরকারের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ এনে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এই প্রথম ভোটের দিন ১১ জেলায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জনই মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। ভোটের দিন দেশে এত প্রাণহানির ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।

জেদ আর আয়েশ পুরানো এই নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা'দত হোসাইন বলেছেন, খালেদা জিয়া তিনবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখন শেখ হাসিনা সেই সংখ্যায় পেঁৗছলেন। ক্রিকেট বা ফুটবল খেলোয়াড়দের মতো। কে কত রান করতে পেরেছেন, কয়টা উইকেট নিয়েছেন বা কয়টা গোল করতে পেরেছেন এটা এদের রেকর্ড বুকে থাকে।

অনেকটা কেউ কারে নাহিপারে সমানে সমানের মতো। হোক না তা কলঙ্কিত। খালেদা জিয়াও তো এরকম একটি পোকায় খাওয়া নির্বাচন করেছিলেন।

আওয়ামী লীগ অবশ্য এ নির্বাচনে কোনো গ্লানিবোধ করছে বলে মনে হয় না। কারণ নির্বাচনের অব্যবহিত পরে আওয়ামী লীগ দাবি করেছে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে।

১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের নায়ক তোফায়েল আহমেদ ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে যে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব তা প্রমাণিত হয়েছে। এদিকে বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটা কোনো নির্বাচনই হয়নি, সিলেকশন হয়েছে। তারা এ নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য ও অবৈধও বলেছে। বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ৫ জানুয়ারি ভোটার বর্জিত একতরফা কারসাজিকে জনগণ ঘৃণাভরে বর্জন করেছে।

অবিলম্বে প্রহসনের নির্বাচন বাতিল, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমঝোতায় পেঁৗছার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।

বাংলাদেশের এই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো হতাশ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, নতুন সরকারের রূপ কি হবে সেটা ভবিষ্যতেই জানা যাবে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার অঙ্গীকার অটুট থাকবে। এই সুবাদে আমরা বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলকে অবিলম্বে সংলাপে বসার জন্য উৎসাহিত করছি, যাতে তারা যত শীঘ্রই সম্ভব একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করবে। আর সেটি অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।

এর মানে কী দাঁড়াচ্ছে? আওয়ামী লীগের নেতারা যতই বলুক এটা গণতন্ত্র রক্ষার নির্বাচন, বিশ্ববাসী তা মনে করছে না। তারা আগের কথাই বলছে। সরকার ও বিরোধী দল বসে আলাপ-আলোচনা করে একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সংবাদ সম্মেলনে যতই সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এবং জনগণকে ধন্যবাদ জানান না কেন, বাংলাদেশের মানুষ স্বচক্ষে দেখছেন কী ঘটেছে। একটি দৈনিক পত্রিকা ঠিকই বলেছে, 'সরকারের মুখে সন্তুষ্টি, ভেতরে হতাশা'।

শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই নিজেও জানেন ২৪ জানুয়ারির পর যে সরকার তিনি গঠন করবেন সেটি তার বর্তমান সময়ের তুলনায় একেবারে জনগণ কর্তৃক অগ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ সরকার। কেবল ভারত আছে তার পক্ষে। ৬ তারিখেই এক মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ভারত বলেছে_ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই বাংলাদেশে নির্বাচন ছিল আবশ্যক। এই নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ারই অংশ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশকে নিশ্চয়ই এই বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না, 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়'_ এটা এখনো আমাদের বিঘোষিত পররাষ্ট্রনীতি। আর সবার উপরে হলো দেশ, দেশের মানুষ। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যদি ভালো না থাকে তাহলে বাইরের কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। ইতোমধ্যেই বিরোধী দল নির্বাচনের পরের দুই দিন লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের অবরোধ কর্মসূচি এখনো অব্যাহত আছে।

নাশকতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থার নিরসন হওয়া দরকার। ক্ষমতার মদমত্ততার দম্ভে, কেবল শক্তি প্রয়োগে, এমনকি জরুরি অবস্থা জারি করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আমি তো মনে করি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সরকার ৫ তারিখের এ কলঙ্কময় প্রহসন রচনা করেছে। আত্দপ্রসাদ লাভ করার কোনো সুযোগই নেই।

আমার খুব অবাক লাগল এটা শুনে যে, প্রেস কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতার উদ্দেশে বলেছেন, কী লাভ হলো নির্বাচন বর্জন করে। এখন তো আর বিরোধী দলের নেতাও থাকতে পারবেন না।

সবার চোখ ছিল ৬ তারিখ নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী কী বলেন, তার দিকে। এর আগেই তিনি বলেছিলেন, একাদশ সংসদের নির্বাচনের কথা। সে নিয়ে কথা বলতে চান তিনি।

সবাই আশা করেছিল জনপ্রত্যাখ্যাত এ নির্বাচনের পরে তিনি একাদশ সংসদের ব্যাপারে নিজেই কথা বলবেন। কিন্তু না, তিনি সেরকম কিছু বললেন না। তিনি বললেন, 'আগামী' যখন আসবে তখন নির্বাচন হবে। কী উচ্চমার্গের কথা। ভাষণে বললেন আলাপ-আলোচনা করবেন কিন্তু শর্ত দিলেন জামায়াত ছাড়তে হবে, সহিংসতা পরিহার করতে হবে।

এ বক্তব্যের সঙ্গে নীতিগতভাবে আমার মতো অনেকেই বিরোধ করবেন না। কিন্তু আপনি কি নীতি নিয়ে আছেন। এ নির্বাচন চলাকালে জামায়াত নেতাদের দলে নেননি? জোটের নামে জামায়াতপন্থি, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেননি? জামায়াত বা জামায়াতের রাজনীতির বিরোধিতা যদি আপনার অন্যতম মূল এজেন্ডা হয় তবে আমরাও তো দেখার জন্য অপেক্ষা করব সংসদ ভর্তি সব সদস্যকে নিয়ে আপনি এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেন। কীভাবে আপনারা হাইকোর্টের রায় পাওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুনঃঅনুমোদন দিলেন তা তো আমরা দেখলাম। এত যে স্বাধীনতার মূল্যবোধের কথা বলেন, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ড. কামাল, সিপিবি, বাসদ, আ স ম রবের জেএসডি, কাদের সিদ্দিকী কাউকেই তো সঙ্গে নেননি।

আমি মনে করি, গণতন্ত্রের জন্য অবিলম্বে সংলাপ শুরু করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনামূলক প্রস্তাব দেওয়া উচিত ২৪ তারিখের আগেই। সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যকে আমি আহ্বান বলতে পারি। সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বলতে পারি না।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

 

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.