সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্লগিং অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। মতপ্রকাশের মুক্ত মাধ্যম বিবেচনায় অন্যসব কিছুকে ছাড়িয়ে বিশ্বে ব্লগিং অধিকার আদায়ের লড়াইয়েও ভূমিকা রেখেছি। সাম্প্রতিক সময়ে বহির্বিশ্বের দেশগুলোতে আন্দোলনই এর প্রমাণ। মতপ্রকাশে মানুষ যেখানে বাধা পেয়েছে, ব্লগিং সেখানে প্রেরণার উত্স হয়েছে। শুধু আত্মকথা, প্রতিবাদ, সমালোচনাই নয়; বরং সমাজ ও দেশের বিকল্প সংবাদমাধ্যম রূপে পরিগণিত হয় ব্লগ।
ভার্চুয়াল পৃথিবীর উপযোগিতা ছাড়িয়ে ব্লগ ও ব্লগিং, জীবন-যাপনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
২০০৭ সাল থেকে আমাদের দেশেও ব্লগের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। দেশে এখন স্বীকৃত পাবলিক ব্লগের সংখ্যাও অনেক। আর ব্যক্তিগত ব্লগারের সংখ্যা বেড়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি। কেননা পাবলিক ব্লগে ব্লগিংয়ের পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে কিছু মুষ্ঠিমেয় নীতিবিবর্জিত পেইড ব্লগারদের এজেন্ডাভিত্তিক ব্লগিংয়ের ফলে।
নতুন নতুন ব্লগের আবির্ভাব, ব্লগার আইডেন্টির প্রতি একধরনের মোহ এই মাধ্যমকে যেমন বিতর্কিত করছে, একইসাথে বিষয়ভিত্তিক ব্লগ, ব্লগিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট করছে।
বিশ্বে জনপ্রিয় ব্লগের নাম বলতে এই মুহুর্তে ১০০টি ছাড়িয়ে যাবে। তবে টেকক্রাঞ্চ ডট কমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর বৃহত্ ব্লগের কথা বলতে গেলে হাফিংটনপোস্টের নাম এক বাক্যে বলতেই হবে। বড় বাংলা ব্লগের নাম আমরা সবাই জানি, সেটাকে সংক্ষিপ্ত করে ব্লগারেরা বলে সামু বা ছাগু ব্লগ।
এখানে একটি গোষ্ঠীর নোংরামি ও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পোস্টের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে এককালের বিখ্যাত সব ব্লগাররা বিভিন্ন ব্লগ, ব্যক্তিব্লগ, বিষয়ভিত্তিক নিরাপদের ব্লগের দিকে ঝুঁকছেন। এই নীতিবিবর্জিত ব্লগারদের মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। অনেকে বিরক্ত হয়ে ব্লগিং ছেড়ে দিয়েছেন। কিছু ব্লগারদের পদচারণা ব্রাহ্মণ ব্লগখ্যাত সচল, স্বাধীনতার সপক্ষের ব্লগখ্যাত আমার ব্লগ, নাগরিক ব্লগ, পেঁচা ব্লগে একত্রিত হয়েছেন। এদের মাঝে পেঁচা ব্লগ একমাত্র ব্লগ যারা চলচ্চিত্র আন্দোলনের স্বার্থে যাত্রা শুরু করেছে।
তবে ধর্ম ব্যবসায়ীরাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই, তাদের ব্লগের নাম সোনার বাঙলা ব্লগ।
অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য, সংবাদ প্রচার মাধ্যমে আসার আগেই ব্লগে প্রকাশ পায়, প্রচারিত হয়ে ছড়িয়ে যায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। অবশ্যই তা প্রাযুক্তিক উত্কর্ষ আর মানুষের প্রকাশ করার অদম্য ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। তবে সামপ্রতিককালে কিছু নির্দিষ্ট ব্লগ রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে ব্যস্ত হওয়ায় তা ব্লগ ও ব্লগিং দুটোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর মাঝে দেশের শীর্ষব্লগ তাদের ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে ব্লগিং নীতামালা লংঘণ করতেও পিছপা হচ্ছেনা।
নিতান্তই রগরগে বিষয় বা কথা প্রকাশের জন্য ব্লগ নয়। বিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন ওয়েবের মধ্যে পর্ণোগাফি সাইটগুলোই বেশি দেখা বা ভিজিটেড হয়। কিন্তু গত এক/দুই বছর ধরে দেখা যাচ্ছে ব্লগে অপপ্রচার আর কুসমালোচনা মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রকাশ অযোগ্য কথা বা পোস্ট ব্লগগুলোকে ঘিরে ধরেছে। তবে দেশের কল্যাণের জন্য আমরা রাজনৈতিক সমালোচনাও করছি। কিন্তু ভাষার ব্যবহার (!) প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বার বার।
এমনকি অনেক পোস্টের বক্তব্য সত্য বিবর্জিত। কুসমালোচনাই বেশি। অনেকে বিভ্রান্ত ও হতাশ হচ্ছেন। ব্লগ অনেকের প্রতিবাদের মাধ্যম আবার অপপ্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত অপপ্রচারের মাত্রা বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট কিছু ব্লগ কোনো গোষ্ঠীকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আর আমরা অনেকে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অযথা অবতারণা করে ব্লগার হিসেবে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছি। দেশের ভিতরে বা বাইরে কোন প্রকার ষড়যন্ত্র বা নাশকতা সৃষ্টির হাতিয়ার ব্লগ নয়, তা আমাদের মনে রাখতে হবে। ব্লগগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় যে সমালোচনাই বেশি; আত্মসমালোচনা নেহাতই কম। দোষারোপের তুলনায় সত্ পরামর্শ কম। আত্মিক বিশ্লেষণ নয় বরং হেয় প্রতিপন্নতার প্রচেষ্টাই বেশি।
কিন্তু কেন? ব্লগের সুফলপ্রাপ্তরা গুটিকয়েক হলেও মনে রাখা দরকার কারণে বা অকারণে কুফল ভোগী হচ্ছেন অনেকে।
শুরুতেই বলেছি বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ব্লগের গুরুত্ব যে অপরিসীম, সেই সত্যটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা খুবই তাড়াতাড়ি অনুধাবন করতে পেরেছেন। তাদের সকল মিথ্যা প্রচারণাগুলো এই ব্লগের মাধ্যমে সারা দেশ তথা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসব অন্ধ কর্মীগুলো বিশেষ বিশেষ এজেন্ডা নিয়ে ব্লগে তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলা ব্লগেই তাদের কর্মকাণ্ড থেমে নেই, দলীয় অর্থায়নে ব্যাক্তিগত ব্লগ থেকে শুরু করে পাবলিক ব্লগ এমনকি বিদেশি ব্লগেও তারা লিখেছে।
ফ্রি ব্লগ ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে জনপ্রিয় ব্লগ সার্ভারে তৈরি করেছে অসংখ্য বাংলা ব্লগ। এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাভাষীর সকলেই যাতে এই মিথ্যাগুলো জানতে পারে তার জন্য ইংরেজিতে অনুবাদ ও ইংরেজিতে ব্লগিং করছে। আর এই তথ্যগুলো তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন দেশের পত্রিকার নিজস্ব ব্লগগুলোতে।
তাদের লেখায় আপনি সঠিক ইতিহাস তো দূরে থাক স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাবেন না, যদিও এক দুইবার কোথাও উল্লেখ থাকে তা গৃহযুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৌশলে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সময়কে এড়িয়ে গিয়ে তাদের অপকর্মের অস্তিত্ব বিলীন করার প্রয়াস নিয়েছে।
এই ব্লগগুলোতে প্রগতিশীলদের অনুপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে জামাতী-শিবির দালাল। আর এই মিথ্যা প্রচারণার ফলাফল আমরা দেখতে পাই তুরস্ক কর্তৃক গোলাম আজমেরর ফাঁসির আদেশ না দিতে অনুরোধ করার মাধ্যমে।
ব্লগ ও ব্লগিং চলার পথে কিছুদূর এসে বর্তমানে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বিতর্কিত হয়ে গেছে। দেশিয় ব্লগগুলোর বড় একটি অংশ ধর্মান্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্লগে ভূয়া আইডি বা নিক-এর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত।
পাশাপাশি ক্যারিকাচার বা অতিরঞ্জিত করে যেসব ছবি দেওয়া হচ্ছে তাতে মানুষ দ্বিধান্বিত হয়ে তথ্যসন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে।
সময়ের অন্যতম প্রবণতা ব্লগ হলেও এর গ্রহণযোগ্যতা আজ প্রশ্নের মুখে। ব্লগে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিরা যেভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকার এবং নাগরিক সবাই মিলেই এর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
তথ্যসূত্রে: দৈনিক ইত্তেফাক।
দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, লাইফ স্টাইল, ক্যারিয়ার, বিনোদন সহ বিভিন্ন ধরনের তথ্যবহুল ফিচারের বিশাল একটি আর্কাইভ দেখতে এখানে ক্লিক করতে পারেন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।