১৮-দলীয় জোটের নেতৃত্বাধীন দল বিএনপির সঙ্গে প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীর মৌন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। চলছে মারাত্দক টানাপড়েন। কেউ কাউকে আগের মতো আর বিশ্বাস করতে পারছে না এখন। সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জামায়াতবিহীন সমাবেশের পর থেকেই মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি। এ সমাবেশে জামায়াতের অনুপস্থিতিকে অনেকেই ১৮-দলীয় জোটের নয়া কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে মূল দল বিএনপির অবস্থানটা আসলে কী, এ নিয়ে খোদ জামায়াতও অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়েছে। বিএনপির প্রতি কিছুটা ক্ষোভও লক্ষ করা গেছে জামায়াত-শিবিরের মধ্যে। বিশেষ করে বিএনপির তিন-চারজন সিনিয়র নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্যে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জামায়াতের বেশ কজন মধ্যম সারির নেতা। তারা বলেছেন, এত রাখঢাকের কী আছে। জোট ভাঙার ঘোষণা দিয়ে দিলেই তো পারে বিএনপি। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র নেতারা কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে এখনো মুখ খুলছেন না। তারা হ্যাঁ কিংবা না বলছেন না কোনোটাই। তবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে এখন আর ভাবছে না বিএনপি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিতর্কিত এ দলটিকে সঙ্গে নিয়ে এখন পর্যন্ত বহু অপবাদের শিকার হতে হয়েছে বিএনপিকে। তাই এখন থেকে জামায়াতকে আর তেমন একটা গুরুত্ব দিতে চান না তারা। তবে এও সত্য ১৮-দলীয় জোট থেকে তাদের বাদ দেওয়ার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেওয়া হবে না বিএনপির পক্ষ থেকে। অন্য শরিকদের মতোই থাকবে জামায়াতে ইসলামী। জোটের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সব দলের মতো অংশ নেবে তারাও। তবে তাদের নিজস্ব কর্মসূচিতে যেমন বিএনপি যায় না, তেমনি বিএনপির দলীয় নিজস্ব কর্মসূচিগুলোতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাও অংশ নেবে না এটিই তো স্বাভাবিক। আর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তো নিজেও সম্প্রতি দলীয় বেশ কিছু কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি এলাকা সফর ও জনসভা করবেন। চেয়ারপারসন ছাড়াও দলের সিনিয়র নেতারাও সারা দেশে চালাবেন জনসংযোগ। তৃণমূলকে সুসংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এগুলো শুধুই বিএনপির নিজস্ব সাংগঠনিক কার্যক্রম। এসব কর্মকাণ্ডে জামায়াত-শিবিরের অংশগ্রহণের সুযোগও নেই। এদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সোমবারের সমাবেশে মঞ্চের সামনে উপস্থিত জনতার মধ্যে আগের সমাবেশগুলোর মতো জামায়াত-শিবিরের আধিপত্য দূরের কথা, গোটা সমাবেশস্থলের কোথাও ছিল না তাদের কোনো ব্যানার-ফেস্টুনও। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের এ অনুপস্থিতিকে মনে করা হচ্ছে, জামায়াত আর বিএনপির পাশে নেই। অন্য সব শরিক দলের নেতারা যথারীতি খালেদা জিয়ার দুই পাশেই ছিলেন সভামঞ্চে। বক্তৃতাও করেছেন তারা। পুরনোদের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন খণ্ড-বিখণ্ড জাতীয় পার্টির সর্বশেষ অংশের নেতা কাজী জাফর আহমদ। বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে কোনো সমাবেশে প্রথমবারের মতো বক্তৃতাও করলেন তিনি। এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ও বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থসহ বক্তৃতা করেছেন অন্য সব শরিক দলের নেতারাও। এমনটিই ছিল সোমবার বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দৃশ্যপট। বিএনপির একক সমাবেশ হলেও সেখানে ১৮-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর প্রায় সব নেতাই ছিলেন উপস্থিত। দেখা যায়নি কেবল জামায়াত-শিবির নেতাদের। নতুন এই দৃশ্য দেখে সব মহলেই প্রশ্ন উঠেছে, এবার বুঝি জামায়াতকে ছাড়ল বিএনপি।
কাগজে-কলমে ১৮-দলীয় জোট বলা হলেও বাস্তবে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ বরাবরই এটিকে 'বিএনপি-জামায়াত জোট' হিসেবেই আখ্যায়িত করেছে। এমনকি এটিকেই এত দিন সবচেয়ে বড় ইস্যু হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। জামায়াতকে ছাড়া বিএনপির পথচলা অসম্ভব বলে এত দিন ভাবতেন যারা, তারাও অবাক হয়েছেন সোমবারের জামায়াতবিহীন সমাবেশ দেখে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা বিএনপিকে অভিযুক্ত করেছে মূলত জামায়াতের সঙ্গে মাখামাখির দায়ে। চলমান রাজনৈতিক সংকটের জন্যও তারা বিএনপির জামায়াত-প্রীতিকেই দায়ী করেছেন। 'জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করলে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা বা সমঝোতা নয়'- কথাটি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার দলের নেতারাও বলেছেন অসংখ্যবার। একই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনও আদায় করতে পেরেছেন তারা। এ প্রেক্ষাপটেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও গত সপ্তাহে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কটা সাময়িক বলে উল্লেখ করেছেন একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। সর্বশেষ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাবেও জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছেদের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এ অবস্থায় কয়েক দিন ধরে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুঞ্জন। এ অবস্থায় বিএনপির নীতিনির্ধারকদেরও অনেকেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন নেত্রীকে। পাশাপাশি ঢাকায় দায়িত্বরত বিদেশি কূটনীতিকদের অনেকেই বিএনপিকে একই পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা যায়।
ভিন্ন মেরুতে চট্টগ্রাম বিএনপি : চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকবে কি না এ নিয়ে কেন্দ্রের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছে চট্টগ্রাম বিএনপি। সোমবার ১৮-দলীয় জোটের গণসমাবেশে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত উপস্থিত ছিল না। কিন্তু কেন্দ ঘোষিত এ কর্মসূচি চট্টগ্রামে পালিত হয়েছে জামায়াত-শিবিরের উপস্থিতিতেই। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের সহিংসতার দায়ভার নিতে হচ্ছে বিএনপিকে। তাই বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার এখনই সময়। দলীয় সূত্রে জানা যায়, ১৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশাপাশি দেশজুড়ে গণসমাবেশ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয় ১৮-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিএনপি আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ভোরেই জামায়াতকে গণসমাবেশে আসতে নিষেধ করে। কিন্তু কেন্দে র এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি চট্টগ্রামে। নগর আয়োজিত গণসমাবেশে জামায়াত-শিবিরের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। নগর বিএনপির কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত গণসমাবেশে মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আ জ ম ওয়াদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি মিছিল আসে। এ সময় মঞ্চে ওয়াদুল্লাহসহ অবস্থান নেন জামায়াতের মহানগর শাখার সহকারী সেক্রেটারি নুরুল আমিন ও প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ। বক্তব্য দেন শিবিরের মহানগর সেক্রেটারি মুহাম্মদ নুরুল হক, মহানগর (উত্তর) শিবির নেতা সওয়ার কামাল সিকদার, জামায়াত নেতা ফারুক-ই-আজম ও আবদুল কাদের। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ জেলা থেকেও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা যোগ দেন কর্মসূচিতে। এ সম্পর্কে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি কেন্দ ীয়ভাবে আলোচনা হবে। তাই এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, 'আমরা জোটবদ্ধভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করব। জনগণ এই অবৈধ সরকার চায় না।'
জানা যায়, ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১৮ দলের বৈঠকে সহিংসতা ছাড়তে জামায়াতকে কড়া নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু পরে ১৮ জানুয়ারি রাতে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে আসামি ধরতে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পুলিশসহ আহত হয় অর্ধশতাধিক। বৃহস্পতিবার জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপিকে পরামর্শ দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।