ফের আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার আগে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরাসরি দেখা করে কথা বলতে চান বিএনপির তৃণমূল নেতারা। বিশেষ করে থানা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা তাদের প্রিয় নেত্রীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করে কথা বলতে চান। জানাতে চান তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা। বলতে চান বিগত আন্দোলনে হতাহত সহকর্মীদের স্বজনদের বেদনা ও অমানবিক জীবন যাপনের কথা। কেন্দ্র থেকে যাদের কোনো খোঁজখবর পর্যন্তও নেওয়া হয়নি এখনো। আরও জানাতে চান, কেন্দ্রীয় নেতারা কীভাবে দল ও তাদের সঙ্গে বেইমানি করেছেন, ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ডেকে এনে কীভাবে বিপদে ফেলেছেন জেলা-উপজেলা থেকে রাজধানীতে আসা লক্ষাধিক নেতা-কর্মীকে। কিন্তু তৃণমূলের এ দাবির প্রধান বাধাই হচ্ছেন ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তৃণমূল নেতাদের খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে আছেন চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ভিত্তিক কতিপয় নেতা ও চাকুরে। এরা সবাই মিলেমিশে নতুন একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। আর এ সিন্ডিকেটে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। সাম্প্রতিক আন্দোলনে যারা ব্যর্থ এবং পুরো সময়টাই পলাতক ছিলেন, তারাই আজ লোকালয়ে এসে সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে আবারও চেয়ারপারসনের কার্যালয় দখলে নিয়েছেন। এদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে অাঁতাত করে চলছেন, এমনকি সরকার ও প্রতিবেশী একটি দেশের কাছ থেকে আর্থিকসহ কোন নেতা কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, বারিধারা, গুলশানসহ কে কোথায় ফ্ল্যাট কিনেছেন, বাড়ি করেছেন, তার একটি পূর্ণ তালিকা বেগম খালেদা জিয়ার কাছে ইতিমধ্যে পেঁৗছেছে বলে জানা গেছে। এ ইঙ্গিত দিয়েই সোমবার রাতে বেগম খালেদা জিয়া পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, দিনের বেলায় বিএনপি আর রাতের বেলায় আওয়ামী লীগ করা নেতাদের কারণেই ঢাকায় আন্দোলন সফল হয়নি। এদের বাদ দিয়ে ত্যাগী ও সক্রিয় নেতাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে।
বগুড়া, যশোর, নাটোর, সাতক্ষীরা, ফেনী জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও থানা পর্যায়ের তৃণমূল নেতারা জানান, ঢাকা শহরে থাকারও জায়গা ছিল না তাদের অনেকের। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো আগে থেকেই পুলিশ-র্যাব দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। আত্দীয়স্বজনও অনেকেই স্থান দিতে রাজি হননি সরকার তথা পুলিশ বাহিনীর হম্বিতম্বির কারণে। ফলে নির্মাণাধীন ভবনের বাথরুম থেকে শুরু করে মসজিদ, মন্দির, রেলস্টেশন, দোকানের পেছনে অফিস-আদালতসহ এহেন জায়গা নেই যেখানে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা জীবন বাঁচাতে অবস্থান করেননি। কিন্তু দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ঢাকায় যেসব কেন্দ্রীয় নেতার ওপর তৃণমূল নেতা-কর্মীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল, তারা সবাই ২৮ ডিসেম্বর থেকেই তাদের মুঠোফোন বন্ধ করে আত্দগোপনে চলে যান। আর লোকালয়ে আসতে শুরু করেন দীর্ঘ এক মাস পর। ফলে সে কয়েক দিন ঢাকায় অবস্থানকালে ভয়ানক বিপাকে পড়েন গ্রামাঞ্চল থেকে আসা নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টেসৃষ্টে তারা গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘরে ফিরে গিয়ে ফের আন্দোলনে যোগ দেন। ৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সংগত কারণেই তারা ঢাকার এসব পলাতক নেতাদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ। ফলে মাঠপর্যায়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফর কর্মসূচির ক্ষেত্রেও আর তেমন কোনো সাড়া দিচ্ছেন না তৃণমূল নেতারা। বরং অনেক এলাকা থেকে এ ধরনের সুবিধাবাদী কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক এ সফরে গেলে মারধর করা হবে বলে হুমকি পর্যন্তও দেওয়া হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত মার খাওয়ার ভয়ে জেলা-উপজেলায় সাংগঠনিক সফর স্থগিত করেছেন ঢাকার নেতারা। একই সঙ্গে মাঠপর্যায়ে দলকে চাঙা করতে এ সফর কর্মসূচির জন্য গঠিত ৫৬টি কমিটির কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়। তৃণমূল নেতাদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় ও পরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যর্থতা ছিল, মাঠের নেতাদের নয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। এখন সাংগঠনিক সফরে গিয়ে মাঠের নেতাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে ও তাদের ওপর দায় চাপিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা খবরদারি করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। মাঠপর্যায়ের নেতাদের মতে, সংকট দলের মাঠপর্যায়ে নয়, কেন্দ্রে বিরাজ করছে। তাই আগে কেন্দ্র ঠিক করতে হবে। বিশেষ করে রাজধানীতে দল গোছানো ও চাঙা করা বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। মাঠের নেতাদের এ মনোভাবের সঙ্গে দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাও একমত পোষণ করেন। তাদের মতে, এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর মাঠের নেতাদের অনাস্থাও পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এখন এমনিতেই মাঠের নেতারা বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় কেন্দ্রের এসব কমিটির সাংগঠনিক সফরকে নতুন 'উৎপাত' হিসেবে বিবেচনা করে তারা এ সফর কর্মসূচির বিরোধিতা করেছেন। কারণ যারা ঢাকা থেকে যাবেন, তাদের বেশির ভাগই আর্থিক বাণিজ্য করতে পারেন। কিন্তু গত কয়েক মাসের আন্দোলনের ফলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো নয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ঢাকার বাইরের নেতারা আন্দোলনে কষ্ট করেছেন। তারা সক্রিয় আছেন। তারা কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মেনেই আন্দোলন করেছেন। তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার দরকার আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, দলের স্থায়ী কমিটি মনে করে, ঢাকা মহানগর কমিটি ঢেলে সাজানো দরকার। চেয়ারপারসনও এতে একমত।
সারা দেশে বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার কার্যক্রম দেখভাল, স্থানীয় দুর্বল কমিটিগুলোর পুনর্গঠন, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শন, নেতৃত্ব পরিবর্তনের সুপারিশসহ নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বিএনপি দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরের কর্মসূচি নিয়েছিল। এ জন্য ৫৬টি কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিটি কমিটির নেতৃত্বে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের রাখা হয়।
স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, মাঠপর্যায়ের নেতারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলন করেছেন। বরং রাজধানী ঢাকায় বেশ দুর্বলতা ছিল। এখন কেন্দ্র থেকে এসব কমিটি গিয়ে মাঠের নেতাদের দুর্বলতা খুঁজে বের করে কোনো পরামর্শ দিতে গেলে তোপের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে দলের সহ-দপ্তর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম জানালেন ভিন্ন কথা। তার মতে, উপজেলা নির্বাচন, মামলার কারণে নেতা-কর্মীদের পালিয়ে থাকা, হত্যা-গুমের মতো ঘটনার কারণে এখন একত্র হওয়াটা অনেকের জন্যই কঠিন। এসব বিষয় বিবেচনা করে আপাতত সাংগঠনিক সফর কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।